Advertisement
Advertisement
Budget

প্রদীপের তলায় আঁধার

অতিমারীর প্রথম ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছে ২৩ কোটি ভারতীয়ের ভাগ্য।

The rising tide of joblessness in India is worrisome | Sangbad Pratidin

ছবি: প্রতীকী।

Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:February 6, 2022 12:22 pm
  • Updated:February 6, 2022 10:12 pm

বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একাধিক স্থানে ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে ট্রেনে আগুন লাগিয়েছেন। এই হিংসাত্মক আচরণ অসমর্থনযোগ্য। কিন্তু এর মধ্যেই ফুটে উঠছে দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও কর্মহীনতার দুঃসহ জ্বালা-যন্ত্রণার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। কেন্দ্রের ‘সর্বব্যাপী সাফল্য’-র ঢক্কানিনাদের বিপ্রতীপে এই ক্ষোভ এক নিদারুণ পরিহাস। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথমে ভ্রম হয়েছিল, সংখ্যাটা ঠিক দেখলাম তো? কিন্তু নাহ্‌। বুঝলাম, চোখের দোষ বা দেখার ভুল নয়, সব গণমাধ্যমেই সংখ্যাটি এক। ভারতীয় রেলে ৩৫ হাজার ২৮১টি শূন্যপদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন ১ কোটি ২৫ লাখ প্রার্থী!

Advertisement

বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল ২০১৯ সালে। প্রথম দফার পরীক্ষার পর নিয়োগের প্রতিশ্রুতি ছিল তাতে। কিন্তু তিন বছর পর রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, দ্বিতীয় দফায় আরও একটা পরীক্ষা হবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ওই ঘোষণায় ‘প্রবঞ্চিত’ প্রার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সরকার যখন ধুমধাম করে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালনে ব্যস্ত, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একাধিক স্থানে ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা তখন প্রতিবাদী হয়ে ট্রেনে আগুন লাগান। ওই হিংসাত্মক আচরণ সমর্থনীয় অবশ্যই নয়। কিন্তু তার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছে চাকরিপ্রার্থীদের চূড়ান্ত হতাশা এবং দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও কর্মহীনতার দুঃসহ জ্বালা-যন্ত্রণার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ কোনও সরকারের পেশ করা লাগাতার কেন্দ্রীয় বাজেটের অসারত্বই শুধু নয়, সরকারের ‘সর্বব্যাপী সাফল্য’-র ঢক্কানিনাদের বিপ্রতীপে এই ক্ষোভ এক নিদারুণ পরিহাস।

Advertisement

অথচ দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে ভালবেসেছিল, তাদের প্রধানমন্ত্রী বছরে ২ কোটি চাকরি দেবেন। প্রতিশ্রুতি পালিত হলে ১৪ কোটি মানুষের চাকরি এতদিনে পাকা হত। অর্ধেক হলেও হত ৭ কোটি। কিন্তু বাস্তবের ছবিটা কী? দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী যখন ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তখন সেই সিদ্ধান্তকে ‘অবিবেচক’ জানিয়ে বলেছিলেন, এতে দেশের প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশ কমে যাবে। মনমোহনের শঙ্কা সত্য প্রমাণিত।

[আরও পড়ুন: বিনয়-বাদল-দীনেশ আসলে যোদ্ধা বাঙালির গল্প, সিনেমা নয়, বাস্তবে কেমন ছিল তাঁদের লড়াই?]

নোট বাতিলের পরের বছর জুন মাসে ‘সেন্টার ফর মনিটরিং দ্য ইন্ডিয়ান ইকনমি’ (সিএমআইই) জানিয়েছিল, দেশে বেকারত্বের হার ৪ শতাংশে পৌঁছেছে। ঠিক এক বছর পর তারা বলে, সেই হার পৌঁছেছে সাড়ে ৫ শতাংশে। সিএমআইই বেসরকারি সংস্থা। সরকারের চোখে তাই তারা ‘নির্ভরযোগ্য’ নয়। সরকারি তথ্য প্রথম জানাজানি হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি। কিন্তু লোকসভার নির্বাচন ঘাড়ের উপর বলে সেই তথ্য সরকার সংসদে পেশ করেনি। প্রকাশিত হয় ভোটের পর। সরকারের ‘ন্যাশনাল স্যাম্প্‌ল সার্ভে অফিস’-এর (এনএসএসও) রিপোর্টও দেখায় পরিস্থিতি কতটা মারাত্মক। তারা জানায়, ২০১২ সালে বেকারত্বের হার ছিল ২.২ শতাংশ। সেখান থেকে চড়চড় করে বেড়ে ২০১৮ সালে তা ৮.৯ শতাংশে পৌঁছয়! দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে। দারিদ্রসীমার নিচে নেমেছেন ৪ কোটি ৬০ লাখ নাগরিক। ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান ১১৬ দেশের মধ্যে ১০৪। গত ৪০ বছরে এমন হাল আগে হয়নি!

কথায় বলে, যে জেগে ঘুমোয় তাকে জাগানো যায় না। প্রধানমন্ত্রীর যোগ্যতা, দূরদর্শিতা ও সাফল্যের কাহিনিকার ও অন্ধ অনুগামীরা এখনও অর্থনৈতিক অবনমনের দরুন কোভিডের খাঁড়া খাড়া করে চলেছেন। যদিও পরিসংখ্যান বলছে, মোদি-নেতৃত্বে অর্থনীতির হড়কানোর শুরু ২০১৬ থেকেই। ২০১৮ সালে কর্মহীনের সংখ্যা ছিল ৫০ লাখ। সিএমআইই ২০২০-র জুলাইয়ে দেখিয়েছে, গত এক বছরে মাসমাইনে পাওয়া ১ কোটি ৮৯ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, যা বাঁধা-মাইনের চাকরিজীবীদের ২২ শতাংশ।

এসব তথ্য কোভিডের ছোবল শুরুর আগের। ২০২১ সালের তথ্য জানাচ্ছে, অতিমারীর প্রথম ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছে ২৩ কোটি ভারতীয়ের ভাগ্য। দারিদ্র হয়ে উঠেছে তাঁদের নিত্যসঙ্গী! অবস্থা কতটা ভয়ংকর বোঝা যায় ওই বছরের প্রথম তিনমাসের এক তথ্যে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, দেশের এক সোনা বন্ধককারী সংস্থা ওই তিন মাসে ৪০৪ কোটি টাকার গয়না বেচে দিয়েছে। কারণ, বন্ধক রাখা মানুষজন সুদ ও আসল মিটিয়ে গয়না ছাড়াতে পারেননি। সিএমআইই-র হাল তথ্য দেখাচ্ছে, গত ডিসেম্বরে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৯ শতাংশ। দেশে মোট বেকার ৫ কোটি ৩০ লাখ। এঁদের মধ্যে সাড়ে ৩ কোটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। বাকিরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এই বাকিদের মধ্যে ৯০ লাখ নারী!

হতাশাগ্রস্ত চাকরিপ্রার্থীরা ধৈর্য হারিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে যে দুই রাজ্যে ট্রেনে আগুন লাগিয়েছেন, তার অন্যতম উত্তরপ্রদেশে ভোট শুরু হতে বাকি আর মাত্র এক সপ্তাহ। কী আশ্চর্য, বেকারত্বের জ্বালা সেই রাজ্যের শাসক কীভাবে মেটাবে, ভোটের প্রচারে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্য নজরে পড়ছে না কারও। শাসক দলে যাঁর কণ্ঠে বেকারত্ব নিয়ে বিরুদ্ধ-স্বর শোনা যাচ্ছে, যাঁর মতে কর্মহীনতাই রাজ্যের প্রধান সমস্যা, সেই সাংসদ বরুণ গান্ধীকে দল এলেবেলে করে রেখেছে। বরুণ অনেক দিন ধরেই বিজেপির বিবেক। সত্যকথনের অপরাধে তিনি ও তাঁর মা দলে তাই একঘরে। ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনার পর দুয়োরানি মানেকা-র পুত্র নির্ভয়ে বলতে পেরেছেন, ‘বেকারত্বজনিত গনগনে পরিস্থিতি থেকে নজর সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা তুলো চাপা দিয়ে আগুন নেভানোর মতোই মূর্খামি।’

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, সরকারি তথ্যে তা-ও প্রতিফলিত। উত্তরপ্রদেশে বেকারের সংখ্যা গড়পড়তা ভারতের চেয়ে বরাবরই বেশি। ২০১২ সালে রাজ্যের স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ২১ শতাংশ! ২০১৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের প্রথম দু’বছরেই তা হাফ সেঞ্চুরি পার করেছে। ডিপ্লোমাধারী ইঞ্জিনিয়ারদের বেকারত্ব হার ২০১২ সালে ছিল ১৩ শতাংশ, যোগী জমানায় তা পৌঁছেছে ৬৬ শতাংশে! ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ারদের বেকারত্ব ১৯ শতাংশ থেকে ৪৬ শতাংশ হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পাস বেকারের হার বেড়েছে ৪ গুণ! অপরাধবোধের তীব্র দংশন এড়াতে শাসকগোষ্ঠী উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে তা একরকম হত। কিন্তু সমস্যা চিহ্নিতকরণে শাসকের যুক্তি কাটা ঘায়ে নুন ছেটানোর মতো। ট্রেনে আগুন লাগানোর পর রেলমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্যাটা বেকারত্বের নয়, সমস্যা একটা চাকরির জন্য সওয়া কোটি প্রার্থীর আবেদন জানানো!’

প্রধানমন্ত্রী নিত্যনতুন স্বপ্ন দেখানোর জাদুকর। অর্থমন্ত্রীর পেশ করা বাজেটেও তার ঝলকানি। নির্মলা দেখালেন নতুন স্বপ্ন, ৭৫ বছরের ভারতকে শতবর্ষী করার অর্থনৈতিক ব্লু প্রিন্ট। বাজেট বক্তৃতা শুনছি আর ভাবছি, উন্নয়নের সরকারি ফিরিস্তি সত্য হলে সাধারণতন্ত্র দিবসে বিহার-উত্তরপ্রদেশের চাকরি প্রার্থীদের বিক্ষোভের হেতু মিথ্যে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর বিকাশ ও উন্নতির দাবি সত্য হলে বলতে হয়, বেকারত্বের জ্বালা মিথ্যে ও আরোপিত। শাসকের রাজনৈতিক দাবি ও সরকারি পরিসংখ্যান- দুটোই সমান সত্যি হতে পারে না। সরকার সত্যি হলে পরিসংখ্যান মিথ্যা। পরিসংখ্যান সত্যি হলে সরকার অসত্য। কিন্তু সেদিকে কে তাকাবে? কে করবে সেই বিচার? সরকারই যেখানে বিতর্কে ঢুকতে প্রস্তুত নয়?

উত্তরপ্রদেশ জেতা শাসকের বড় দায়। এই রাজ্য দখলে রাখা না-রাখার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই। ভোটের প্রচারে তাই উন্নয়ন, বিকাশ, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি, সোনালি ভবিষ্যৎ- শিকেয় উঠেছে সব। আগাপাশতলা দখল করে নিয়েছে ‘জিন্না বনাম গন্না (আখ)’, ‘ঔরঙ্গজেব বনাম শিবাজি’, ‘আলি বনাম বজরঙ্গবলি’, ‘ভাইসাব বনাম আব্বাজান’, ‘হিন্দুস্তান বনাম পাকিস্তান’, ‘রাম বনাম রহিম’। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং হুংকার দিয়েছেন, লড়াই ৮০ বনাম ২০-র। মাভৈঃ!

[আরও পড়ুন: শতবর্ষপ্রাচীন কংগ্রেসের পরিস্থিতি দেখে দুঃখ হয়, কংগ্রেস যুগের অবসান?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ