কিশোর ঘোষ: ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি….।’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই আবেগের উচ্চারণ সবাই করে। কিন্তু ঠিকঠাক অধিকার জম্মু ও কাশ্মীরবাসীর। সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি পাইন, চিনার ঘেরা পাহাড়, খড়স্রোতা নদী, বরফ সাদা হিমবাহ, ঢেউ খেলানো প্রান্তর দিয়ে ‘ফুরসত সে’ অর্থাৎ কিনা সময় নিয়ে কাশ্মীর উপত্যকাকে গড়ে তুলেছেন। যদিও রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে সেই ডাকসাইটে সুন্দরীর মতো দশা হয়েছে কাশ্মীরের, যার প্রেমে কবি-শিল্পীরা যেমন পড়েন, তেমনই শকুনেরও চোখ থাকে ভোগদখলের ইচ্ছায়। তারই সাম্প্রতিক নমুনা পহেলগাঁওয়ে পর্যটক হত্যাকাণ্ড। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে ‘শকুনে’র নাম পাকিস্তান। এখন প্রশ্ন হল, নতুন করে কাশ্মীরকে অশান্ত করতে চাইছে কেন পাকিস্তান? কোন খেলা খেলতে চাইছে তারা?
ভারতে জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান অন্যতম কারণ। যার ফলে অশান্তি বেড়েছে ইসলামাবাদের। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান এবং জম্মু-কাশ্মীরের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে। অতীতের তুলনায় উপত্যকায় অনেক বেশি আগ্রাসী ভারতীয় সেনা। এনকাউন্টারে খতম হয়েছে বহু কুখ্যাত জঙ্গি, নিয়ন্ত্রণ রেখায় কড়া নজরদারিতে লস্কর, জইশদের অনুপ্রবেশের ষড়যন্ত্র রোখা গিয়েছে। এই পর্বে পুলওয়ামা হামলার পর নিয়ন্ত্রণ রেখা ডিঙিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছে। এর মধ্যেই ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা দানকারী ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করেছে কেন্দ্র। রাজ্যের মর্যাদা হারিয়েছে উপত্যকা। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ— দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে।
৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের ফলে ভারতের আর পাঁচটি রাজ্যের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের আর কোনও পার্থক্য নেই। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসলামাবাদের প্রচার ‘কাশ্মীর সমস্যা’ জোরালো ধাক্কা খেয়েছে। পাকিস্তানের জন্য কফিনে শেষ পেরেকটি ছিল এক দশক পর জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচন। গত বছর অক্টোবরে যে ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকার। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ওমর আবদুল্লা। ভোটের আগে অনন্তনাগ-সহ একাধিক ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণ রেখায় ধুন্ধুমার সংঘর্ষ হয়েছে জঙ্গি-সেনার। লাগাতার জঙ্গি নিকেশের খবর এসেছে। কর্তব্যরত অবস্থায় শহিদ হয়েছেন ভারতের বীর জওয়ানরাও। এই পর্বে নিরীহ পরিযায়ী শ্রমিকদের হত্যা করে উপত্যকার আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত কার্যসিদ্ধি হয়নি। কেন?
আসলে পর্যটনের পথ ধরে ক্রমশ ‘খুশালি’ ফিরছিল ভূস্বর্গে। সুন্দরী কাশ্মীর মোটের উপর শান্ত থাকায় বছরে বছরে বাড়ছিল পর্যটকের সংখ্যা। একটি হিসাব বলছে, গত বছর জম্মু ও কাশ্মীরে ২৯ লক্ষ ৫০ হাজার পর্যটক সমাগম হয়েছিল। ২০২৩ সালে যা ছিল ২৭ লক্ষ ১০ হাজার। ২০২২ সালে ২৬ লক্ষ ৭০ হাজার পর্যটক ঘুরে গিয়েছেন কাশ্মীর। পুরনো রেকর্ড ভাঙার দিকেই এগোচ্ছিল চলতি বছর। জানুয়ারি থেকেই দেশ-বিদেশের পর্যটকে উপচে পড়ছিল উপত্যকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাশ্মীরের এই ভালো থাকা, পর্যটকদের আনাগোনা, স্থানীয়দের মানুষ হাসিখুশি জীবন কাটানো জনবিচ্ছিন্ন পাক জঙ্গিদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠছিল। অস্বস্তি বাড়ছিল তাদের মদতদাতা পাকিস্তানের জন্যও। সেই কারণেই পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপরেই হামলার ছক। হিন্দুদের বেছে বেছে হত্যার পিছনেও রয়েছে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য। কাশ্মীর উপত্যকা থেকে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর ভিনরাজ্যের মানুষও এখন কাশ্মীরে জমি-বাড়ি কিনতে পারেন। ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে ভারতীয় নাগরিক হওয়ার অধিকারে। তা বন্ধ করতে এবং হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদী একটি সরকারকে বার্তা দিতেই নতুন করে অশান্তি পাকাতে চাইছে পাকিস্তান। পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে লস্করের যে ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট বা টিআরএফ, তাদের জন্মই হয়েছে ৩৭০ ধারা বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এখন কী করণীয়?
ভারতীয় সেনা তো আছেই। তবু কাশ্মীরবাসীই পারেন ‘শত্রু’র মুখে ছাই দিতে। তাগিদ তাদেরই সবচেয়ে বেশি। কারণে পর্যটনের উপরে আঘাতে পেটে লাথি পড়েছে আমজনতার। তাছাড়া ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’…এই গান তো তাদের। আমাদেরও গর্বের সঙ্গীত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.