Advertisement
Advertisement
Gujarat

গোধরা-মোরবির মতো ইস্যু কি হারিয়ে যায় মেরুকরণের রঙে?

ভারতের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের কি মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেল?

Will polarization remove the scar like Gidhra and Morbi | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 17, 2022 3:16 pm
  • Updated:November 17, 2022 3:16 pm

একজন সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করুন ভূপেন্দ্রভাই প্যাটেল কে? দেখবেন ৯৯ শতাংশ উত্তর দিতে পারবে না। এই ভদ্রলোকই এখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। অথচ কেউ তাঁর খোঁজ রাখে না। আজ থেকে ২০ বছর আগে এমনই এক বিধানসভা নির্বাচন ‘কভার’ করতে আহমেদাবাদে যখন পা রেখেছিলাম, তখন কিন্তু সারা দেশ বুঝে গিয়েছিল গুজরাটের দায়িত্ব কার হাতে যাচ্ছে। কলমে কিংশুক প্রামাণিক

ডিসেম্বরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যে ভোট। নভেম্বর মাসভর গুজরাটের দিকে সবার নজর থাকবে। ভারতীয় জনতা পার্টির কাছেও গান্ধীনগর-রক্ষা সম্মানের যুদ্ধ। কারণ, নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘ ক্ষমতার ভরকেন্দ্র আসলে গুজরাট-ই।

Advertisement

প্রায় সাড়ে ২৩ বছর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থেকে রেকর্ড করেছিলেন জ্যোতি বসু। মোদিও ২০০১ সাল থেকে প্রায় ১৩ বছর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর ২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী। ২০২৪ পর্যন্ত তিনি থাকছেনই। ফলে মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী- একটানা কুরসি সামলানোর নয়া রেকর্ড তিনি করবেন। এমন রেকর্ড আগামী দিনে কেউ ভাঙতে পারবে কি না সন্দেহ। এবারও মোদিকে সামনে রেখেই গুজরাটে বিধানসভা ভোটে লড়তে নেমেছে বিজেপি। এছাড়া বিজেপির কিছু করারও নেই। তাঁর অবিসংবাদিত নেতৃত্বই বিজেপির একমাত্র পুঁজি। ২০০২ সাল থেকেই এটাই বাস্তব।

Advertisement

একজন সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করুন ভূপেন্দ্রভাই প্যাটেল কে? দেখবেন ৯৯ শতাংশ উত্তর দিতে পারবে না। এই ভদ্রলোকই এখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। অথচ কেউ তাঁর খোঁজ রাখে না। আজ থেকে ২০ বছর আগে এমনই এক বিধানসভা নির্বাচন ‘কভার’ করতে আহমেদাবাদে যখন পা রেখেছিলাম, তখন কিন্তু সারা দেশ বুঝে গিয়েছিল গুজরাটের দায়িত্ব কার হাতে যাচ্ছে। ততদিনে সাম্প্রদায়িক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে মহাত্মা গান্ধীর রাজ্যে পরম্পরা, ঐতিহ্য ও অহংকার। গোধরায় করসেবকদের ট্রেনের মধ্যে পুড়িয়ে মারার পর রাজ্যজুড়ে ভয়ংকর দাঙ্গায় শত-শত মানুষের মৃত্যু সমাজকে বিভক্ত করে দিয়েছে।

[আরও পড়ুন: সংরক্ষণের সমীকরণ, দেশকে ফের নয়া সন্ধিক্ষণে দাঁড় করাতে পারে ‘ইডব্লিউএস’]

মোদি-শাসনের প্রারম্ভে সেই যে হিন্দু-মুসলমানে দু’ভাগ হল, গুজরাটে এখনও তার নিরিখে ভোট হয়। কারণ মুসলমানের চেয়ে হিন্দু জনসংখ্যা অনেক বেশি মোদির রাজ্যে। স্বভাবতই ভূপেন্দ্র প্যাটেল নিমিত্ত মাত্র। ম্যাচ ম্যানেজার আসলে মোদি-ই। গতবার তা-ও লড়াই হয়েছিল। কিন্তু এবার বিরোধী শিবির ছন্নছাড়া। কংগ্রেসের বিধায়ক ও নেতাদের কিনে নিয়ে দলটাকে কার্যত ভেঙে দিয়েছে বিজেপি।

মোদির উত্থান নাটকীয়ভাবে। ২০০১ সালে প্রবল অস্থিরতা শুরু হয় বিজেপি সরকারে। ভুজে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর ত্রাণ ও পুনর্গঠনে চূড়ান্ত ব‌্যর্থতায় চাপের মুখে পড়ে যান মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেল। নেতৃত্ব দেওয়ার দুর্বলতা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগে জেরবার কেশুভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন।

লালকৃষ্ণ আদবানি এই সুযোগটাই নিলেন। কেশুভাইকে সরিয়ে প্রিয় শিষ‌্য মোদিকে বসিয়ে দিলেন কুরসিতে। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন সংঘ অনুগত স্বয়ংসেবক নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। তাতে বিজেপির কোন্দল অবশ্য থামল না। মোদি দায়িত্ব নিয়ে এমন কিছু করতে পারছিলেন না- যাতে মনে হতে পারে- পরের বছর বিধানসভা ভোটে দল উতরে যেতে পারবে। কংগ্রেস তখন গুজরাটে রীতিমতো শক্তিশালী।

হাওয়া পুরো বদলে গেল ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে। অযোধ্যা থেকে করসেবকরা ফিরছিলেন সবরমতী এক্সপ্রেসে। গোধরা স্টেশনে পৌঁছনোর পর সামান্য ঝামেলা থেকে বড় সাম্প্রদায়িক সংঘাত। দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে প্রথমে আক্রমণ, পরে মোট চারটি কামরায় আগুন লাগিয়ে দেয় হামলাকারীরা। ৫৯ জন করসেবক পুড়ে মারা যান। যার মধ্যে বেশিরভাগ মহিলা ও শিশু। ঘটনার ভয়াবহতা দাবানলের মতো গুজরাটে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় দাঙ্গা। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই দাঙ্গায় সরকারি হিসাবে ১,০৪৪ জন মারা যান। এর মধ্যে ৭৯০ জন মুসলমান, ২৫৪ জন হিন্দু। আহত ২,৫০০ জন। নিখোঁজ ২২৩। বেসরকারি মতে মৃতের সংখ‌্যা আহতের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। গোধরার ঘটনা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র কি না, তা নিয়ে প্রশ্নও ওঠে।

গুজরাটের ভয়ংকর দাঙ্গার প্রভাব দেশজুড়ে পড়ে। সংঘাত থামানোর ব্যর্থতায় দায়ী করা হয় মোদিকেই। তখন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। মোদি সরকারকে বরখাস্তের দাবিতে সংসদে অচলাবস্থা শুরু হয়। এনডিএ-র দুই গুরুত্বপূর্ণ শরিক ডিএমকে ও তেলুগু দেশমও দাবি তোলে মোদিকে সরানোর। অবশেষে চাপের মুখে জুলাই মাসে গুজরাট মন্ত্রিসভা রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র দেয়। ভোট আসন্ন হওয়ায় রাজ্যপাল ভেঙে দেন বিধানসভা। ২০ বছর আগে এমনই এক নভেম্বরে ঘোষণা করা হয় গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন। যাঁরা ভেবেছিলেন মোদির প্রতি আস্থা হারিয়েছেন বাজপেয়ী-আদবানিরা, তাঁদের ভুল প্রমাণ করে প্রচারের ময়দানে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদিকেই তুলে ধরে সংঘ পরিবার। জমে যায় ভোটযুদ্ধ।

‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর অফিসে তখন চিফ রিপোর্টার সুমন ভট্টাচার্য। সুমন একদিন আমায় বলে, ‘গুজরাট বিধানসভা ভোট কভার করবি তুই। কালই রওনা হয়ে যা।’ একজন পলিটিক‌্যাল রিপোর্টারের কাছে খুবই লোভনীয় অ্যাসাইনমেন্ট। অস্বীকার করব না, প্রথমে পুলকিত হই। পরে নানা দুশ্চিন্তা গ্রাস করে। জঙ্গলেঘেরা ছোট আঙ্গারিয়া গ্রামে গণহত্যার খবর কভার করতে প্রথম সাংবাদিক হিসাবে একা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলাম। ওই সময় কেশপুর, গড়বেতা, পিংলা, সবং-এ নিত‌্য আমাদের যেতে হত গোলাবারুদের গন্ধ শুঁকেই।

২০০০ সালের রক্তাক্ত কলকাতা, পুরভোটে বেলেঘাটায় পায়ের উপর বোম পড়ছে দেখেও স্থান ত্যাগ করিনি। ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০১ হয় বিধানসভা, নয় লোকসভা ভোটে সংঘর্ষের মধ্যে জেলায়-জেলায় ঘুরেছি। কিন্তু গুজরাট সেদিন ভাবিয়েছিল। সিপিএম তৃণমূল গোলাগুলি আর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা তো এক নয়। কতদূর পৌঁছতে পারব, লিখতে পারবই বা কতটুকু?

যাই হোক, দেরি না-করে আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসে টিকিট কেটে ফেললাম। জীবনের কোনও অঙ্কে যখন কাপুরুষের মতো পিছিয়ে আসিনি, নিজের ভিতর সুপ্ত জেদ জাহির না করে সাংবাদিকতা করেছি, তেমনই দাঙ্গার আগুনে পোড়া গুজরাটে পৌঁছে গেলাম জীবনের সেরা সেরা প্রতিবেদনগুলি লেখার সংকল্প নিয়ে।

লক্ষ ছিল একজনই- নরেন্দ্র মোদি। তাই কোনও দিকে না তাকিয়ে আহমেদাবাদের মুসলিম মহল্লা খানপুর রোডে একটি হোটেল নিয়ে ফেললাম। কারণ, এখান থেকে বিজেপির রাজ্য অফিস হাঁটাপথ। তারপর ১৫ দিন ধরে গুজরাটের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত চষে যখন নিশ্চিত হলাম এই ভোটে সাম্প্রদায়িক বিভাজনই একমাত্র মাপকাঠি, তখন পোরবন্দরে মোহনদাস করমচাঁদের জন্মগৃহ থেকে লিখেছিলাম- আরব সাগরের বুকে যে-সূর্যাস্ত দেখছি, তা এত লাল কেন? ভারতের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের কি মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেল? দেশ কি তবে ‘গুজরাট মডেল’-এই এগোবে!

একদিন খুঁজে খুঁজে হাজির হলাম মাহেসনা জেলার বড়নগর গ্রামে। এই সেই গ্রাম যেখানে মোদির পৈতৃক বাড়ি। এক গুজরাটি সাংবাদিক বলেছিলেন, এখনও গৃহত্যাগী ছেলের পথ চেয়ে বসে আছেন এক মা। হ্যাঁ, নরেন্দ্র মোদির মা হীরাবেনের কাছে পৌঁছেছিলাম। তাঁর ন্যাশনাল এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ পরদিন বেরিয়েছিল ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ। আজ দেখি মায়ের পা ধুইয়ে শতবর্ষ পালন করছে ছেলে। সেদিন কিন্তু এই গুজরাটি বৃদ্ধার গলায় পেয়েছিলাম একরাশ অভিমানের সুর।

নির্বাচনের দিন এসে গেল। সুমনও তখন এসে গিয়েছে আহমেদাবাদে। ভোটে আমার দায়িত্ব পড়ল গোধরা। শেষ সফর। এক আশ্চর্য ছবি। তীব্র উত্তেজনায় জনপদটি দু’ভাগ। যেখানে মুসলিমদের বাস, সেখানে উড়ছে শুধু হাত চিহ্নের তিরঙ্গা ঝান্ডা। যেখানে আদিবাসী তথা হিন্দুরা, সেখানকার বুথে নেই অন্য কোনও দলের এজেন্ট, শুধুই গেরুয়া। অথচ ইতিহাস বলছে, এই গোধরার আদিবাসীরা বরাবর ভোট দিত কংগ্রেসকেই।

সেদিন নিশ্চিত হয়ে গেলাম, নরেন্দ্র মোদি-ই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। সংখ্যাগুরু হিন্দুরা বিজেপিকেই ভোট দিচ্ছে, মুসলিমরা কংগ্রেসকে। অচিরেই ১৮২ আসনের মধ্যে ১২৭ আসন নিয়ে ক্ষমতা দখল করল বিজেপি। ট্র্যাডিশনাল কংগ্রেস আসনগুলোতে ধস। সফল হল মেরুকরণ থিওরি। ২০ বছর পর যা আজ বিজেপির যে কোনও ভোটের একমাত্র মন্ত্র।

যদিও পরে দাঙ্গার ক্ষত ও বিভেদের ছবি মুছতে গুজরাটের মুখ বদলের চেষ্টা করেন মোদি। বিশ্ব দরবারে শিল্পায়ন হয় হাতিয়ার। সাড়া ফেলে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’। কিন্তু এখনও ২০ বছর আগের স্মৃতি তাড়া করে ফেরে মানুষকে। ভোট এলে বেশি বেশি করে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, যাতে মোরবিতে সেতু ভেঙে দুশো মানুষের মৃত্যুশোকের মতো হাজারো ইস্যু হারিয়ে যায় মেরুকরণের রঙে।

[আরও পড়ুন: মরুভূমির মৃত্যু! মরু-গরিমায় মুগ্ধ হওয়ার দিন কি ফুরিয়ে আসছে?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ