Advertisement
Advertisement
Britain

থমকে ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্যে, সুনাক কি সেই জট খুলতে পারবেন?

মূল সমস্যার জায়গা অভিবাসন নীতি, অ্যালকোহল ও গাড়ির আমদানি শুল্ক।

Will Rishi Sunak untie free trade knot between India and Britain | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 1, 2022 2:06 pm
  • Updated:November 1, 2022 2:06 pm

ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ থমকে আছে। মূল সমস্যার জায়গা অভিবাসন নীতি, অ্যালকোহল ও গাড়ির আমদানি শুল্ক। ঋষি সুনাক কি দ্রুত এই চুক্তি সম্পাদন করবেন? কলমে অমিতাভ সেন

ভিবাসন নীতি, অ্যালকোহল ও মোটরগাড়ি। এই ত্র্যহস্পর্শে দু’-বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’-র আলোচনা মাঝপথ পেরিয়েও থমকে দাঁড়াল। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সে-দেশের ঝোড়ো অর্থনৈতিক আবহাওয়া আর যুদ্ধ পরিস্থিতি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা’-র ধাক্কায় পর্যাপ্ত জ্বালানির অভাব, বিদ্যুৎ উৎপাদনের আকাশচুম্বী খরচ ও তীব্র চাহিদা (বিশেষ করে শীতের মরশুমে), শিল্পে মন্দা, বেকারত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কা, রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা- সবদিক থেকেই দুর্যোগপূর্ণ এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা ঋষি সুনকের কাছে নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে দেশের স্বার্থে যে কোনও কঠিন লড়াইয়ের জন্য তিনি প্রস্তুত- প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এই ছিল তাঁর প্রথম বার্তা।

Advertisement

চিনে সর্বসম্মতিক্রমে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কয়েক দিন আগে দলীয় স্তর, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন এনেছেন। লিজ ট্রাসের মতোই কট্টর চিন-বিরোধী সুনাক বর্তমানের ‘কঠিন নীতি’ আঁকড়ে ধরে থাকবেন, না কি নতুন কোনও দৌত্যের পথে চলবেন, তা-ও কম বড় প্রশ্ন নয়।

Advertisement

[আরও পড়ুন: ‘গোর্খাল্যান্ড’ শাঁখের করাত, বঙ্গভঙ্গের দাবি কি মানবেন মোদি-শাহ?]

তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা’ ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলির মধ্যে খুব হালকা হলেও মনান্তরের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আফ্রিকায় দুর্ভিক্ষের হাতছানি। রাষ্ট্রসংঘের অনুরোধে ও ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম’-এর (ডব্লিউএফপি) আবেদনে সাড়া দিয়ে অনাহারী ও দুর্ভিক্ষপীড়িত আফ্রিকি মানুষের জন্য রাশিয়া আপাতত ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য সরবরাহের অবরোধ তুলে নিয়েছে। ব্রিটেনে যে চরম জ্বালানি সংকট চলছে, এর প্রভাব সেখানকার বড়, মাঝারি ও ছোট- সব ধরনের শিল্পে পড়তে পারে বলে শঙ্কা। রপ্তানি বাড়িয়ে ও বিদেশি-কর্মী সংকোচন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়ে ব্রিটেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথা ভাবছে। আর, সে-কারণেই দেশের দোদুল্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সুনাক সরকারের কাছে ব্রিটেন-ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। সম্ভবত, এই অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত আঁচ করেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে চুক্তিটি সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন। জনসনের সেই পরিকল্পনাকে তখন ব্রিটেনের একাধিক প্রথম সারির নেতা ‘তাড়াহুড়ো’ করে চটজলদি ভারতকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলে কঠোর সমালোচনা করেন। সেসব সমালোচকের উদ্বেগ ও সন্দেহ দূরীভূত করতে সুনাক সরকারের বাণিজ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত
মন্ত্রী গ্রেগ হ্যান্ডস সদ্য পার্লামেন্ট বলেছেন- যতক্ষণ না এই চুক্তিকে ন্যায্য ও পারস্পরিক স্বার্থের অনুকূল বলে মনে হচ্ছে- ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রিটেন এই চুক্তি করবে না।

মূলত যে-তিনটি বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দর কষাকষি চলছে- অ্যালকোহল ও মোটর গাড়ির উপর ভারতের আরোপিত আমদানি শুল্ক হ্রাস করা, এবং কাজের উদ্দেশ্যে ভারত থেকে ব্রিটেনাভিমুখী কর্মপ্রার্থীদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। অনুমান, অ্যালকোহল ও মোটরগাড়ির উপর আমদানি শুল্ক হ্রাসে নরম মনোভাব দেখালেও ‘অভিবাসন’ (ইমিগ্রেশন) ইস্যুতে ভারতের কঠোর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই চুক্তি হলে ব্রিটেনে ভারতীয় অভিবাসনের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে লিজ ট্রাস মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম‌্যান মন্তব্য করেছিলেন। তাতে নয়াদিল্লি তো বটেই, ব্রিটেনের ভারতীয়দের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। ব্রাভারম‌্যান পদত্যাগ করেন। তারপর দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল না দিতে পারার ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে লিজ ট্রাসকেও সরে যেতে হয়।

ব্রাভারম্যানের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনে ভিসার মেয়াদ-উত্তীর্ণ অভিবাসীদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দু’-বছর আগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে ভিসার মেয়াদ-উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে অথচ সে-দেশে থেকে গিয়েছেন এমন ভারতীয় অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৭০০ বা তার সামান্য বেশি। ‘দ্য স্পেক্টেটর’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রাভারম‌্যান বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে অভিবাসনের ক্ষেত্রে খোলা সীমান্ত-নীতি গ্রহণ করার জন্য দেশের মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসা সমর্থন করেনি। কিন্তু যেটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ- ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রাক্‌-মুহূর্তে এ-ধরনের মন্তব্য করা সত্ত্বেও সুনাক তাঁর মন্ত্রিসভায় গোঁড়া ডানপন্থী বলে পরিচিত সুয়েলা ব্রাভারম‌্যানকে ফিরিয়ে নিয়েছেন!

গত মাসের গোড়ায় পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক চুক্তি কমিটির অন্যতম সদস্য কনজারভেটিভ পার্টির ড্যানিয়েল জন হান্নান-ও ভিসা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তবে তিনি মনে করেন- এই চুক্তির ফলে দু’-দেশের সবচেয়ে বড় পারস্পরিক লাভ হবে কারিগরি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও সংকেতায়নের (কোডিং) ক্ষেত্রে। কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন মেধার পেশাগত বিনিময় তো রয়েইছে। এর জন্য বর্তমানে চালু ভিসা নীতিতে পরিবর্তনের প্রয়োজন। ড্যানিয়েল হান্নান ভারতকে এই বার্তাও দিতে চান যে, ভিসা-সংক্রান্ত ইস্যুর সমাধান ত্বরান্বিত করতে হলে ব্রিটেনে কর্মরত যেসব ভারতীয় পেশা-ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে, তাদেরকে এবং বেআইনিভাবে যেসব ভারতীয় ব্রিটেনে রয়েছে, তাদেরও দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হতে হবে ভারতকে। অন্যদিকে, লর্ড হান্নানের দেওয়া তথ্যে ভর করেই ভারতীয়দের জন্য আরও বেশি করে ‘ওয়ার্ক পারমিট’ ও ‘টায়ার থ্রি’ ভিসার জন্য কেন্দ্র সরকার ব্রিটেনের উপর চাপ দিচ্ছে।

দু’-দেশের মধ্যে এমন চুক্তি করা কি সম্ভব- যেখানে ভারতীয়দের পক্ষে আইনসম্মতভাবে ব্রিটেনে আসা যত সহজ হবে, বেআইনিভাবে প্রবেশ করা অত সহজ হবে না? তবে ব্রিটেনে বসবাসকারী ১৫ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় বংশোদ্ভূতের অবদানের কথা বলতে গিয়ে আন্তর্জাতিক কমিটির আর-একজন সদস্য ভিসকাউন্ট ইয়ঙ্গার (ফিফ্‌থ) মনে করিয়ে দেন- করোনার প্রতিষেধক উৎপাদনে ব্রিটেনের অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছিল। ভারতীয় মালিকানাভুক্ত কিন্তু ব্রিটেনে তৈরি ‘জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার’-এ ৩৫ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করে। দু’-দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।

অ্যালকোহলের উপর ভারতের আরোপিত শুল্ক (১৫০ শতাংশ) পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই যুক্তি দেখিয়ে, শুল্কের হার কমপক্ষে ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি করেছে ব্রিটেন। এতে ভারতের আমদানি শুল্ক থেকে আয় অনেক কমে যাবে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত, শুল্ক হ্রাসের ফলে বিক্রি বাড়বে, আখেরে ভারতেরই লাভ হবে। চিনের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে- আমদানি শুল্ক হ্রাস করার পর সে-দেশে সুরা বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। সুরাপায়ীরা অনেক উন্নত মানের সুরা কিনতে পারবে ও সুরাপানজনিত মৃত্যুর হারও কমে আসবে- এমন যুক্তিও উঠে আসছে। কিন্তু ভারতীয় সুরাপায়ীদের সিংহভাগ মধ্যবিত্ত
ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী উন্নত সুরার দাম নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে না-থাকলে বিক্রি বাড়বে কী করে! অনুমান, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে সুরাপায়ীর সংখ্যা ৩৮ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ‘দ্য ল্যানসেট’-এর রিপোর্ট বলছে, ভারতে মহিলা (১৫-৩৯) সুরাপায়ীর সংখ্যা এখন প্রায় ৪০ লক্ষ।

‘স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’-র হিসাব অনুযায়ী, ৪০ হাজার ডলারের বেশি দামের গাড়ির উপর ভারতের আমদানি শুল্ক ১০০ শতাংশ। ৪০ হাজার ডলারের নিচে অন্যান্য গাড়ির জন্য আমদানি শুল্কের হার ৬০ শতাংশ। ব্রিটেন তাই ভারতের কাছে গাড়ি উপর আমদানি শুল্ক হ্রাসের দাবি রেখেছে। ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পথ কণ্টকাকীর্ণ নয়- এরপরে বলি কী করে?

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]

[আরও পড়ুন: ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা কি সবসময় একশো শতাংশ সুরক্ষিত?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ