জয়ন্ত ঘোষাল: সিনেমার শুটিংয়ে ঝড়ের আবহ তৈরি করা হয় হেলিকপ্টারের প্রপেলার চালিয়ে। প্রেক্ষাগৃহে ওই ছবি দেখার সময় মনে হয়, এ সত্যিকারেরই ঝড়! আজকাল ভোটের সময় মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জেতার জন্য প্রয়োজন হয় এই আগাম ঝড়ের। পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোট-রণের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) এবং তৎসহ আরও কিছু বিধায়ক নাটকীয়ভাবে মেদিনীপুরে অমিত শাহর জনসভায় বিজেপিতে যোগ দিলেন। অমিত শাহ শুভেন্দুকে আলিঙ্গন করে বিজেপির গৈরিক পতাকাটি তাঁর হাতে তুলে দিলেন। রাজ্য-রাজনীতিতে এ এক অভিনব প্রতীকী দৃশ্য বটে!
কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূল ছাড়ার তাৎপর্য কী? বিজেপি এবং অমিত শাহর (Amit Shah) রাজনৈতিক রণকৌশল বোঝা সহজ। মোদি-অমিত শাহ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যতটা প্রভাবশালী ও মহীরুহ ব্র্যান্ড, এই রাজ্যে ঠিক সেভাবে কেউ নেই। এ অবস্থায় ‘ধার করা’ নেতা, ‘অপমানিত’ তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বিজেপির গৈরিক পতাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা স্বাভাবিক ঘটনা! অমিত শাহ-র ‘প্যান ইন্ডিয়ান’ দল হয়ে ওঠার জন্য এই কৌশল-ই ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। শুভেন্দু অধিকারী ও বিধায়করা কীভাবে আসছেন, কেন আসছেন, কারা আসছেন-সেসব সূক্ষ্ম বিচারের বিষয়। কিন্তু প্রাথমিকভাবে মনে হয়, ঝড় উঠেছে। মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে এগিয়ে বিজেপি (BJP)। কিন্তু এই এমএলএ-রা ভোটের মুখে চলে আসা মানেই কি মমতার বিপর্যয়? দল ভেঙে এসে বিজেপিতে যোগ দিলেই কি তাঁরা সফল হবেন?
শুভেন্দুর রাজনীতি একেবারেই তাঁর নিজস্ব। শুভেন্দু নির্ঘাত অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুভেন্দুর নিশ্চয়ই অনেক রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল, তা না হলে তিন-তিনটি মন্ত্রক, এতগুলি সমবায় ব্যাংকের শীর্ষ দায়িত্ব, হলদিয়া ডেভলপমেন্ট অথরিটি, হলদিয়া বন্দরের উপর কর্মী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও সব ছেড়ে তিনি বিজেপিতে আসবেন কেন? আসলে, অতীতেও বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন বহু নেতা। গোবিন্দবল্লভ পন্থের পুত্র উত্তরাখণ্ডের মসিহা কৃষ্ণচন্দ্র পন্থ বাজপেয়ী-আডবানি জমানায় বিজেপিতে এসে কী হলেন? না, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান! একবার, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কংগ্রেস নেতা সুখরামের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। হিমাচলে ওঁর বাড়িতে তোশকের মধ্যে অনেক ক্যাশ টাকা পাওয়া যায়।
এদিকে, বিজেপি হিমাচলের রাজনীতির জন্য সুখরামকে গ্রহণ করে। তাতে সুখরাম তদন্তের হাত থেকে বাঁচলেও হিমাচলের রাজনীতিতে কতটা দাগ কাটতে পেরেছিলেন? আমার মনে আছে, একবার রাজ্যসভায় প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিজেপির শীর্ষনেতা সুষমা স্বরাজকে কংগ্রেস নেতারা জিজ্ঞাসা করেন, সুখরামের দুর্নীতির কী হল? ‘সুখরাম ক্যায়া আভি গঙ্গাজল মে নাহা লিয়া?’ সুষমা রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘সুখরামজি কা সুখ আপনে ছিন লিয়া। ইসি লিয়ে আভি উসকে সাথ স্রিফ রাম রহ গয়া।’ সুষমার বাকপটুত্ব ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল অসাধারণ!
একইরকমভাবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বুটা সিং ঝাড়খণ্ড এমপিদের ঘুষ কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হয়ে বিজেপিতে এসেছিলেন। সাম্প্রতিককালে মুকুল রায় (Mukul Roy) বিজেপিতে এসেছেন, কিন্তু তিনি কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিকল্প’ হতে পেরেছেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তি, যা বাংলার মানুষের কাছে তৈরি হয়েছে তিল-তিল করে, শুভেন্দু কি তা ভেঙে দিতে পারবেন? অসমে যেভাবে হিমন্ত বিশ্বশর্মা কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে রাজ্যে উপ-মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, সেভাবে কি পশ্চিমবঙ্গে দিলীপ ঘোষ (Dilip Ghosh) মুখ্যমন্ত্রী হলে শুভেন্দু উপ-মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন?
বিধায়করা হলেন ভোটের মুখে সংখ্যা। অনেকরকমের বিধায়ক আছেন। অনেকেই টিকিট পাবেন না জানেন, তাই তাঁরা এখনই বিজেপিতে যোগ দিয়ে টিকিট পাওয়ার জন্য ইট পেতে রাখছেন। এমনটা সব রাজে্যই ভোটের আগে হয়। ‘বহুজন সমাজ পার্টি’ ও ‘সমাজবাদী পার্টি’ থেকে ভোটের আগে জার্সি বদল সহজ স্বাভাবিক ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রাক-নির্বাচনী জার্সি-বদল আগে খুব জনপ্রিয় ছিল না। লক্ষ্মণ শেঠ (Laxman Seth) সিপিএম থেকে বিজেপি-সফর করেছেন। এখন তিনি ঠিক কোথায়, জানি না। আবারও মেদিনীপুর থেকে শুভেন্দু অধিকারী এক নব সংযোজন।
শুভেন্দুর গৃহত্যাগ নিশ্চয়ই তৃণমূলের (TMC) জন্য ‘হ্যাপি আওয়ার্স’ নয়। কিন্তু বিজেপির শীর্ষ এক নেতা সেদিন বলছিলেন, ‘মমতা ইজ আ সাকসেসফুল পলিটিশিয়ান। স্মার্ট গুড পলিটিশিয়ান।’ শুভেন্দু-সহ আরও ১০-১২ জন এমএলএ চলে গেলেন, আর মমতা নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোবেন-এমনটা হতে পারে না। মমতার পালটা রণকৌশল কী হবে? প্রথমত, মমতা চেষ্টা করবেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কমিউনিকেশন গড়ে তুলতে। তিনি মেদিনীপুরের পূর্ব ও পশ্চিমের ১৬ ও ১৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে নিম্নবর্গ, গরিব, তফসিলি জাতি-উপজাতি, সংখ্যালঘু-নানা ধরনের মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছে যাবেন। তৃণমূল নেত্রী মেদিনীপুর-সহ সমগ্র রাজ্যের আমজনতার থেকে শুভেন্দু ও চলে-যাওয়া বিধায়কদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইবেন। দ্বিতীয়ত, ‘ব্যক্তি’ শুভেন্দু নন, মমতা এখন এই লড়াইকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা’র লড়াই, বাঙালি সত্তা বা অস্মিতার বিরুদ্ধে বহিরাগত আক্রমণকারী বঙ্গ-সংস্কৃতির ধ্বংসকারীর লড়াই-এই প্রচারে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হবেন। শুভেন্দু অধিকারী ও সহ-বিধায়করা শেষ পর্যন্ত মমতার কতটা ক্ষতি করতে পারবেন, তা তো ভবিষ্যৎ বলবে।
কিছু মাস বাকি নির্বাচনের। তাই এখনও ‘শেষ কথা’ বলার সময় হয়নি। কিন্তু অতীতেও দেখেছি, নানা রাজ্যে ভোটের মুখে দল ভেঙে অনেকে বেরিয়ে এসেছেন। অনেক সময় তাঁরা নিজের নাক কেটে যাত্রাভঙ্গ করলেও লাভ হয়নি। যেমনটা রামবিলাস পাসোয়ানের পুত্র চিরাগ পাসোয়ান নীতীশ কুমারের দলের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়ে এনডিএ-র মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে করেছিলেন। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং দল ভেঙে প্রধানমন্ত্রী হয়েও ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি পৃথক দল করেছিলেন। পাওয়ার, সাংমা, রাজেশ পাইলট, জি. কে. মুপানর, পি. চিদম্বরম-এঁরা সকলেই আলাদা দল করেছেন, কিন্তু তাঁদের দলের আজ কী পরিস্থিতি?
আবার বিজেপিতে এসেছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া (Jyotiraditya Sindhia)। তিনি সংসদ সদস্য হলেও এখনও মন্ত্রী হতে পারেননি-যেটা তিনি চেয়েছিলেন। মন্ত্রী হতেও হয়তো পারেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দল বা সরকারে ওভাবে ‘বিনিময় প্রথা’ চলে না। ইউ আর অন কিউ। জ্যোতিরাদিত্য হয়তো কমল নাথের সরকারকে ফেলেছেন, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন শিবরাজ সিং চৌহান। ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস ভেঙে অনেক নেতা যোগ দেন। প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা সমীর বর্মনের পুত্র সুদীপ যোগ দেন। এখন, সেই সমীরের নেতৃত্বে, ১০ জন বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। গদি বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রী দিল্লিতে এসে দীর্ঘদিন বসেছিলেন। সরকার টলমল। হাইকম্যান্ড বিব্রত! তাই দল ভেঙে বিজেপি-র দীর্ঘমেয়াদি লাভ কী হল? অতএব, বঙ্গ-রাজনীতিতেও দল-ভাঙার প্রতিক্রিয়ায় কতটা বিজেপির লাভ, আর কতটা আখেরে শুভেন্দুর মতো বিধায়কের লাভ, তা আগামী দিনই বলবে। তবে, বিভীষণ যতই রামভক্ত হন না কেন, বাঙালির রামায়ণে বিভীষণ খুব সম্মাননীয় চরিত্র নন। আমরা
বলি, ‘ঘর শত্রু বিভীষণ’। যেমন ছিলেন জগৎ শেঠ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.