Advertisement
Advertisement

Breaking News

ইরফান খান

ইরফান খান- যেন এক আশ্চর্য ডানার মানুষ

এই দেখনদারি জীবনে এক ভণিতাহীন আত্মার আরাম ছিলেন ইরফান।

Actor Irrfan Khan was an amazing man with great skills
Published by: Sulaya Singha
  • Posted:April 29, 2020 5:10 pm
  • Updated:April 29, 2020 5:10 pm

সরোজ দরবার: সে-এক আশ্চর্য মানুষ; এই অসময়ে কোন আকাশে তার নোঙর করার সময় চলে এল, কে জানে! সে চলে গেলেও, তবু চারদিকে ভেসে থাকে তার ডানার ঘ্রাণ। সে এক আশ্চর্য ডানার মানুষ। এই ঘাম-নুন-সমুদ্র ছুঁয়ে সে যে কী অক্লেশে জীবনকে পিঠে করে নিয়ে উড়ান দিত আকাশের অতীত কোন আকাশে! আজ, বিষণ্নতার ভিতর কেবল আবিষ্কার করা যায়, আমাদের সে-দিন ভেসে গেছে চোখের জলে। শ্রাবণআকাশে শুধু লেগে আছে তার দুখজাগানিয়া ছায়াটুকু।

ইরফান খান সন্দেহাতীতভাবেই এক আশ্চর্য ডানার মানুষ।

Advertisement

রূপোলি পর্দার মিথ্যের ভিতরও যিনি সত্যি সত্যি শোনাতে পারেন সমুদ্রের স্বর। কী এমন বিশেষত্ব ছিল সেই আলাপনে? তেমন কিছু চোখে পড়ার মতো তো নয়। অন্তত তাঁর জন্য কেউ উৎসবের আয়োজন তো করে রাখেনি। ফ্রেম থেকে ফ্রেমের নির্মাণে, ক্লোজ-শট আর নেপথ্য সংগীতের যুগলবন্দিতে নায়কোচিত স্বাগতম জানিয়ে কেউ তাঁর চিত্রনাট্য লিখে রাখেননি। এভাবে লেখা থাকেও না সচরাচর। মধ্যবিত্তের জন্য; সাধারণের জন্য- যে সমস্ত চরিত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ইরফান। যে-দিনের নেই রামধনুর ঐশ্বর্য, যে-দিনের গোপনে নেই পলাশের সর্বনাশ, কিংবা বাদলবেলার মিলন আকাঙ্ক্ষা, বিরহের বিষাদ- সেরকম সাধারণ একটা দিনকে কে আর আলাদা করে মনে রাখে! কে লিখে রাখে দৈনন্দিন ঘামের রোজনামচা। অথচ, কোনও এক সায়াহ্নে যদি জীবনকে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায়, তবে এই অগণিত সাধারণ দিনই তাদের অফুরন্ত জীবনীশক্তির প্রাচুর্য আর সমৃদ্ধি নিয়ে এক অপূরণীয় মনখারাপ হয়ে একা একা ঘুরে ঘুরে কথা কয়ে যায়। কে তখন নায়ক? যে দিনসমূহ ডায়রিতে লেখা থাকে না, একদিন তারাই তো লিখে ফেলতে পারে একটা সত্যিকার এপিটাফ।

Advertisement
Irfan
পান সিং তোমার-এ ইরফান

[আরও পড়ুন: ‘মাটিতে বসে একসঙ্গে খেয়েছি’, ইরফান-স্মৃতিতে ‘ডুব’ দিলেন অভিনেত্রী পার্ণো মিত্র]

ইরফান আমাদের সেই সাধারণের অসাধারণ এপিটাফ।

মধ্যবিত্তের স্বপ্নিল বাসনা আর স্বপ্নের সীমাবদ্ধতা যেখানে ধাক্কা খায়, যেখানে নেপথ্যে থাকে না বিদেশি লোকেশনের রোমাঞ্চকর পটভূমি, সেখানে, প্রতি ফ্রেমকে গরিমাময় করে দিতে পারে একজন আবেগী মানুষের গভীর-গহন দৃষ্টি। ওই যে লাঞ্চবক্স হাতে মানুষটি নাকের ডগায় নেমে আসা চশমার ফাঁক দিয়ে স্মিত তাকান, ঠোঁটের কোণে ওই যে ফুটে ওঠে বাদলাবেলায় পাওয়া আলোর মতো একচিলতে হাসি, ওটুকুই জীবনের সফল উড়ান। ওই যে যানবাহনের ঝুলোঝুলির ভিতর নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিকে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক করে রেখে চোখের মণির অভ্রান্ত নড়চড়া, মুখের পেশির সামান্য সংকোচন– ওখানেই যাবতীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান। ওখানেই একটা নেহাতই ছাপোষা মানুষের যাবতীয় গুপ্তধনের খোঁজ। হয়তো তাকে কোনও এক শহরের জীবনে দেখা যাবে, সামান্য খ্যাপাটে হয়ে। তার এলোমেলো চুলে হয়তো কোথাও পড়ে হিমু কি নীললোহিতের ছায়া। তবু ওই যে পিকুর অপলক চাহনিকে স্তব্ধ করে দিয়ে তার নিষ্পাপ হেসে ওঠা, ওটুকুতেই ধুয়ে যায় সকল দারিদ্র্য। যে-দারিদ্র্য নায়কনির্ভর চিত্রনাট্য, স্পেক্টাকলের বিনোদন বহু কষ্টে পাঁজরে গোপন করে রাখে। যেখানে বিচিত্রবর্ণের বিনোদনী উদ্ভাসকেই চাদর করে জড়িয়ে নিতে বাধ্য হয় দর্শক, সেখানে ইরফান এক আটপৌরে দুপুর হয়ে জড়িয়ে থাকেন সেই দর্শকেরই সমগ্রে। দর্শকের সত্তা ছুঁয়ে ফেলে তাঁর সাধারণ হয়ে ওঠার অসধারণ অভিনয়, আর, কে না যেন সেই স্বাদ- গভীর-গভীর; ওই যে যখন তিনি বলেন ‘জেদ করলে তো ধরে রাখতাম, ভালবাসি বলেই যেতে দিচ্ছি’, তখনই এক লহমায় তিনি হয়ে ওঠেন শেষের কবিতা। কিংবা ভাস্কর চক্রবর্তীর কোনও লেখা। স্বর্গ আর স্যারিডনহীন সে জীবন, তবু সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যায়। ইরফানের সাধারণের অভিনয় ছুঁয়ে ফেলে সেই সরগম। এমন এক জীবনকে তিনি তুলে ধরেন কবরখানায় বসে যেন সে দেখে নাম না-জানা ফুলের জন্ম। যেন সে মৃতদেহ নয়, ছুঁয়ে বসে থাকে আত্মাকে। ইরফান বলেন, তিনি তাঁর কাজে ওই আত্মাকেই, আত্মার আরামকেই স্পর্শ করতে চান।

ইরফান আমাদের এই দেখনদারি জীবনে এক ভণিতাহীন আত্মার আরাম।

Irfan
পিকু ছবিতে অমিতাভ বচ্চন ও দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে ইরফান খান

বলা যায়, এ-এক পরম্পরা। বলরাজ সাহানি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি হয়ে যা তিরতিরিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে আজকের পঙ্কজ ত্রিপাঠি অবধি। সন্দেহাতীতভাবে ইরফান সেই প্রবাহের সফলতম তীর্থ। ১৯৮০ দশকের শেষ থেকে, নব্বইয়ের বিনোদনের বাঁক-বদল, তিন খানের সাম্রাজ্য বিস্তার ও প্রতিপত্তি, মুক্ত অর্থনীতি, বদলে যাওয়া দর্শকের মনন, বিনোদনের সংজ্ঞা, ভেঙে যাওয়া পরিবারের ধারণা, সম্পর্কের বদল, স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের মেটা ল্যাংগোয়েজ, স্বেচ্ছাচার আর একাকীত্বের ভিতর মানুষ যখন কোনও এক অজানা বেদনার সন্তান, সেখানে অভিনেতা ইরফানের রাস্তা খুঁজে পাওয়াই ছিল মুশকিলের। সময় লেগেছে বিস্তর; দর্শকমনে এক পশলা রোদের চাদর মেলে দিতে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেকটা। এই অপেক্ষাই বস্তুত সেই ভিয়েন যেখানে কড়াপাকের খুশবুর জন্ম। এরপর একটা সময় এল, যখন দর্শকের তাতে আবিষ্ট না হয়ে আর উপায় রইল না। ইরফান পরম্পরা ধরে তাঁর নিজস্ব ভাষাকে জায়গা করে দিতে পারলেন বলিউডের বিনোদন মানচিত্রে। কেন যে ইরফান মনের এত কাছাকাছি একজন মানুষ, এ প্রশ্ন বারবার করা যায়। অভিনয় স্কুলের শিক্ষকরা বলবেন, থিয়েটারি অভিনয়ের সঙ্গে পর্দার অভিনয়ের অন্বয় ইরফান যে পথে করেছিলেন, এবং যে সময়ে করেছিলেন, সে পরীক্ষা একেবারে অব্যর্থ ও যেন অনিবার্যই ছিল। এই সময়ের জন্য এমনটাই উপযুক্ত এবং বিকল্পরহিত। ফলে ইরফান তাঁর দর্শক পেয়ে গিয়েছিলেন শেষমেশ। চরিত্র পেয়ে গিয়েছিলেন। চিত্রনাট্যও পেয়ে গিয়েছিলেন। শুধু ইরফান আছেন বলেই মানুষ হলের টিকিট কেটেছে, এ আর কোনও ব্যতিক্রমী গল্প নয় বরং মূলস্রোত হয়ে উঠেছিল।

[আরও পড়ুন: জীবনযুদ্ধে হার মানলেন অভিনেতা ইরফান খান, শোকস্তব্ধ চলচ্চিত্র জগৎ]

কিন্তু এই সা-রে-গা-মা পেরিয়ে থাকে এক ভণিতাহীন মানুষের গল্প; যাঁর মা বলতেন, অভিনয় মানে নাচ-গানের ব্যাপার; নাক সিঁটকোতেন। ইরফান আশ্বস্ত করেছিলেন, নাচ-গান তিনি করবেন না, কাজের কাজ করবেন; সে কথাই রেখেছিলেন তিনি। তিনি পর্দায় এমন একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, চরিত্র থেকে চরিত্র মিলিয়ে যাকে আমরা নাচ-গানের ক্লান্তির বিপ্রতীপে একজন ভণিতাহীন একান্ত নিজস্ব মানুষ হিসেবে ছুঁয়ে থাকতে পারি। এ আমির আবরণ ফেলে দিয়ে, আত্মাকেই যিনি সরাসরি পর্দায় এনে ফেলতে পারেন। যার দিকে তাকালে মনে হত, এই ইটকাঠের ভিতর এখনও এক টুকরো আলো দেখা যায়। তথ্য, প্রযুক্তি, আকাশছোঁয়া জীবন, সাফল্যের ব্যর্থতা, সম্পর্কের হাঁসফাঁস- তথাকথিত আধুনিক জীবনের সমস্ত ক্লেদ যখন একজন মানুষকে পেড়ে ফেলে, বহুরূপী হয়ে থাকার দমবন্ধকর ক্লান্তি যখন তাকে আচ্ছন্ন করে, জীবনের ভূমিকায় অভিনয়ের সীমাহীন ব্যর্থতা যখন তাকে মুখ থুবড়ে ফেলে দেয় জীবনেরই কোনও চাতালে, তখন সে একজন ডানার মানুষ হয়ে উঠতে চায়।

irfan
তলোয়ার ছবিতে মন ছুঁয়েছিল ইরফানের অভিনয়

সমস্ত ভণিতা ছেড়ে ফেলে, সমস্ত আয়োজিত বিনোদন আর ক্লান্তির শেষে, সমস্ত মিথ্যে মিলনের কাহিনির অন্তে যে কিনা একজন সাধারণ মানুষ হয়ে ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসিটুকু নিয়ে সন্ন্যাসীরাজা হয়ে চলে যেতে পারে জীবনের কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে। উষ্ণতা থেকে সেই আশ্চর্য শীতলতার দিকে; বিনোদন থেকে বিনোদনহীনতার দিকে। অর্থ থেকে অর্থহীনতা এবং সমূহ বিপর্যয়ের দিকে; আসলে তখন আপাত ভিখারী যে জীবন, তাই-ই হয়ে ওঠে মহারাজা। সে যে কী সাজে আসে, আমরাই তা ঠাহর করতে পারি না। সমস্ত নাগরিক হাঁসফাসের ভিতর আমাদের সেই ঠান্ডা, শান্ত অকৃত্রিম জীবনের অবাধ ছাড়পত্র হয়েই পর্দায় আসতেন। সমস্ত মুখ থুবড়ে পড়া নাগরিক ব্যর্থতাবোধকে যে তার গোপন ডানায় বসিয়ে তুলে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারত জীবনের অতীত কোনও এক জীবনের পরপারে। এই জীবনের ভিতরই দেখিয়ে দিতে পারতেন জীবনের আরও এক গোপন সাতমহলা।

সন্দেহ নেই যে, ইরফান খান, আমাদের কাছে ধরা দেওয়া সেরকমই একজন সফলতম আশ্চর্য ডানার মানুষ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ