কিশোর ঘোষ: যুদ্ধের অস্ত্র যেমন বন্দুক-গোলা-বারুদ। তেমনই জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সবেচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হয়তো শিল্প। যেমন-কবিতা, ছবি, গান। জেনে বা না জেনে সেই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন ১০ বছরের এক বালক! সেটা ১৯৬২ সাল। চিন-ভারত যুদ্ধের মধ্যেই দাদা সঙ্গীত শিল্পী মনোহর উদাসের এক অনুষ্ঠানে প্রথমবার সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ পান পঙ্কজ উদাস। গেয়ে ছিলেন লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে আসমুদ্রহিমাচলের শোনা ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’। গানটি চিন-ভারত যুদ্ধে নিহত শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতেই তৈরি করেছিলেন কবি প্রদীপ এবং সঙ্গীত পরিচালক সি রামাচন্দ্র। সেই গান বছর দশকের বালকের কণ্ঠে শুনে মুগ্ধ হন উপস্থিত শ্রোতারা। তাঁরা ৫১ টাকা পুরস্কার তুলে দেন শিশুশিল্পীর হাতে।
১৯৫১ সালের ১৭ মে গুজরাটের জেটপুরে জন্ম পঙ্কজ উদাসের। বাবা কেশুভাই উদাস, মা জিতুবেন। তাঁদের তিন সন্তানই কালে কালে সরস্বতীর বরপুত্র! সকলেই ভবিষ্যতে সঙ্গীত দিয়ে শক্ত জীবনের অঙ্ক মেলান। শৈশবেই সন্তানদের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ দেখে রাজকোটের সঙ্গীত অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে দেন পিতা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন পঙ্কজ। বড় ভাই মনোহর উদাস। অসংখ্য হিন্দি ছবির নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী। পঙ্কজের চেয়ে বড় নির্মল উদাস গজল গায়ক হিসেবে বিখ্যাত হন। তবে খ্যাতিতে বড় দুই ভাইকে ছাপিয়ে যান পঙ্কজ।
নেপথ্যে ছিল শিল্পী হিসেবে তৈরি হওয়ার গল্প। গুলাম কাদির খানের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন পঙ্কজ। পরবর্তীকালে গোয়ালিয়র ঘরানার জনপ্রিয় শিল্পী নবরং নাগপুরকরের কাছে তালিম। এর পরেই পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। জনপ্রিয় হয় তরুণ পঙ্কজ উদাসের ‘নশা’, ‘পয়মানা’, ‘হসরত’, ‘হামসফর’-এর মতো অ্যালবামগুলি। অন্যদিকে সিনেমার গানে সেই আশির দশকেই শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। ‘চান্দি জ্যায়সা রঙ্গ’, ‘না কাজরে কি ধার’, ‘দিওয়ারোঁ সে মিল কর রোনা’, ‘আহিস্তা’— পঙ্কজের গাওয়া একের পর এক গজল আজকের শ্রোতাদেরও মুগ্ধ করে। তবে ১৯৮৬ সালে ‘নাম’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘চিঠঠি আয়ি হ্যয়’ গানটি তাঁকে জনপ্রিয়তা শিখরে পৌঁছে দেয়। পিছন পিছন থাকবে ১৯৯১ সালে ‘সাজন’ ছবির ‘জিয়ে তো জিয়ে’ গানটিও।
ছয় দশকের সুরের সফরে দেশ-বিদেশের একাধিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন পঙ্কজ উদাস। ২০০৬ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানেও ভূষিত করে। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হয়তো শ্রোতাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠা। গান ছিল যে সম্পর্কের বন্ধন। মনে রাখতে হবে, জগজিৎ সিংয়ের পরে পঙ্কজ উদাস সেই শিল্পী, যিনি গজলকে সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। দশ বছর বয়সে চিন-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যে প্রতিভার বিস্ফোরণ, তাঁর অন্ত হল ৭২ বছর বয়সে। কিংবদন্তি গজলসম্রাটের গানের চিঠি বা ‘চিঠঠি’ চিরটাকাল বুকে করে রাখবেন শ্রোতারা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.