কোয়েল মুখোপাধ্যায়: কেউ বলছেন অবসাদ। আবার কেউ তাল ঠুকছেন প্রেমে ব্যর্থতার জেরেই এমন চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুশান্ত। কেউ কেউ আবার যুক্তির পসরা সাজাচ্ছেন বলিউডের স্বজনপোষণের বস্তাপচা ‘থিওরি’ আউড়ে, কিংবা অভিনেতার অন্তর্মুখীনতাকে কাঠগড়ায় তুলে। এগুলোর মধ্যে কোনটা ঠিক, আর কোনটা আজগুবি, ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সুশান্ত সিং রাজপুত আমাদের মধ্যে আর নেই। কিন্তু এই সব তর্ক-বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে, মানুষ হিসেবে ‘কাই পো ছে’, ‘এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’, ‘ছিঁছোড়ে’, ‘কেদারনাথ’-এর মতো ছবির অভিনেতা সুশান্ত ঠিক কেমন ছিলেন, জীবন নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল? কিংবা তাঁর অভীপ্সাগুলোই বা ঠিক কেমন ছিল? আর কেনই বা এত কম বয়সে এমন চরম সিদ্ধান্ত নিলেন? সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম বিজ্ঞান। কীভাবে? হাতের লেখা বিশ্লেষণ করে। গ্রাফোলজির মাধ্যমে।
কখনও প্রয়াত মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে কবিতা লিখতে, আবার কখনও নিজের ৫০টি স্বপ্নের তালিকা তৈরি করতে, তারকা সুশান্ত হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। সেই সমস্ত লেখা পর্যবেক্ষণ করেই ‘মানুষ’ সুশান্ত কেমন ছিলেন, তার খোঁজ মিলেছে। কলকাতা ইনস্টিটিউট অফ গ্রাফোলজির ডিরেক্টর মোহন বসু জানাচ্ছেন, “নিঃসন্দেহে সুশান্ত ছিলেন সফল তারকা। নাম, যশ, অর্থ-স্বল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং নিজের প্রতি অতিরিক্ত আশাবাদী। এই উচ্চাভিলাষের জন্যই সম্ভবত তিনি কেরিয়ার বদল করেন। পড়াশোনার জগৎ ছেড়ে চলে আসেন অভিনয়ে।”
মোহনবাবুর দাবি, “প্রযুক্তি সম্পর্কে সুশান্তর আকর্ষণ ছিল তুখড়। পাশাপাশি তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল, পরিশ্রমী এবং অত্যন্ত উদ্যমী। সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম জিনিসের প্রতি নজর ছিল তাঁর। কিন্তু সমস্যা তখনই বাঁধল, যখন কেরিয়ারের অভিমুখ বদলে ফেললেও স্বপ্নগুলোকে ছেড়ে আসতে পারলেন না তিনি। তাঁর হাতের লেখা থেকে এই আভাস অত্যন্ত জোরালোভাবে মিলেছে। শুধু তাই নয়, পর্যবেক্ষণে আরও জানা গিয়েছে যে, সুশান্ত বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে ভালই বাসতেন। কিন্তু বন্ধু পাতাতেন বেছে বেছে। তাঁর ‘সোশ্যাল বাউন্ডারি’ ছিল সীমিত।”
মোহনবাবুর অভিমত, “অভিনেতার আচরণের বৈপরীত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর হাতের লেখার ‘slant’ থেকে বোঝা যায়, নিজের অভিমত প্রকাশের ক্ষেত্রে, কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, তা তিনি ঠিক করতে পারতেন না। কখনও কোনও গুরুত্বহীন বিষয়ে বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া দিয়ে বসতেন আবার কখনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে থাকতেন নির্বিকার হয়ে। হয়তো আচরণের এহেন আকাশ—পাতাল ফারাকের কারণেই অজান্তে, অনেককেই নিজের শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলেন সুশান্ত। হাতের লেখায় স্পষ্ট, তাঁর মনের মধ্যে সারাক্ষণ চলত সাংঘাতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর তাতে এতটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন এই তারকা যে কোনওভাবে সেই জাল কেটে বেরোতে পারছিলেন না। এগোবেন না ফিরে এসে, আবার নতুন করে শুরু করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। আর এর থেকেই মনে বাসা বাঁধে তীব্র হতাশা। নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে শুরু করেন সুশান্ত।”
গ্রাফোলজির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “সুশান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন কিন্তু উচ্চাশা চরিতার্থ করতে গিয়ে নিজেরই বেঁধে দেওয়া নিয়মনীতির জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মানসিকতা, এই বাস্তববাদী দুনিয়ার সঙ্গে লড়ার উপযুক্ত ছিল না। তাঁর গভীর আবেগ—অনুভূতি তাঁকে প্রতিকূল পরিস্থিতি ভুলতে দিত না। বরং তা মনে জমতে জমতে, তাঁর লড়াই করার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল। বিশেষ করে শেষের দিকে, পতন এড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সুশান্ত। প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সুশান্তর হাতের লেখায় তাঁর মধ্যে পরিস্থিতিগত বা প্রতিক্রিয়াজনিত অবসাদের (রিঅ্যাকটিভ ডিপ্রেশন) লক্ষণ স্পষ্ট, যা সম্ভবত বড় ক্ষতি (কাজের ক্ষেত্রে বা আর্থিকভাবে) বা কারও মৃত্যু বা কাউকে হারানোর ভয় অথবা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় থাকার কারণে হয়েছিল, আর আত্মঘাতী হওয়ার ভাবনাই ছিল এর চরম পরিণতি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.