Advertisement
Advertisement

মৃত্যুর দু’দশক পরে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল ফাটাকেষ্টর কালীপুজো

আসতেন তাবড় তাবড় সেলেব্রিটিরা৷

Fata Keshto’s Kali Puja in Kolkata
Published by: Sayani Sen
  • Posted:November 5, 2018 3:27 pm
  • Updated:November 5, 2018 3:27 pm

ছুরির কোপ। গালে বসন্তের দাগ৷ কালীভক্ত। মধ্যরাতে তাঁর ডাকে হাজির অমিতাভ-উত্তমকুমার-আশা ভোঁশলে। ফাটাকেষ্ট ও তাঁর কালীপুজো নিয়ে লিখছেন সম্বিত বসু

কলকাতা। সাতের দশক আসতে চলেছে। মাঝে মাঝেই দু’-একটা খুন। রক্ত। বোমা। পুলিশি টহলদারি। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের কাছাকাছি সেদিন অবশ্য পুলিশি টহল ছিল না। ছিল জনা দুই রহস্যময়, ওত পেতে। অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। হাতে সুচতুরভাবে লুকনো বহু অভ্যস্ত ছুরি। দু’জনের একজন এ পাড়ারই নকুল। আরেকজন বরানগরের। নীলু। কেষ্টা কখন আসবে, সেজন্য যেন তাদের ঘড়ির কাঁটাও ধারালো হয়ে উঠছে। সময় একটু পরেই যেন রক্তে ভেসে যাবে।
কিন্তু সেরকম সুবিধে করে উঠতে পারল না এই দুই জাঁদরেল। কারণ ‘কেষ্টা’কো পকড়না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়। ছুরির কোপ লেগেছিল বটে, তবে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিলেন একলা যুবকটি। ভরতি হতে হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজেও, তবে যখন ফের পা রাখছেন পাড়ায়, ততক্ষণে নাম হয়ে গিয়েছে ‘ফাটাকেষ্ট’। কয়েকটা ছুরির কোপ তাকেই নয়, আঘাত করেছিল তার নামকেও।
কে এই ফাটাকেষ্ট? আসল নাম ‘কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত’।

Advertisement

[অভিনয় থেকে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি, সবেতেই এখনও তিনি বাদশা]

বাবার পানের দোকান কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে। দোকানের দেখাশোনা করতেন ফাটাকেষ্ট নিজেও। কালীভক্ত এই মানুষটি ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে ভাবতেন জমিয়ে পুজো করার কথা। ১৯৫৫ সালে প্রথমবারের জন্য শুরু করেন কালীপুজো। সেই পুজো অবশ্য আজকের মতো বিরাট করে হত না। শুরুর ঠিকানা ছিল গুরুপ্রসাদ চৌধুরি লেনে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মনোমালিন্য। ফলে পুজো তুলে আনেন সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের একটি ঘরে। বছর দুই পরে পারমিশন নিয়ে যা নেমে এল রাস্তায়।
কিন্তু এতে তার পরিচয়ের ইন্টারভ্যালও হল না। শরীরচর্চার রেওয়াজ ছিল তাঁর। ডাম্বেলও ভাঁজতেন মাঝেসাঝে। পেটাই চেহারা। গালে বসন্তদাগ। কংগ্রেস-বিরোধী ও নকশালরা দিনে দিনে তাঁর উপর হয়ে উঠেছিল খাপ্পা। ‘ফাটাকেষ্টর মুন্ডু চাই’- এ লাইন তখন দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরছে। ছুরিকাহত হওয়ার পর পেটোবোমাও পায়ের কাছে এসে গড়িয়েছিল ফাটাকেষ্টর। ফাটেনি। হয়তো বোমাও খানিক সমীহ করেছিল তাঁকে। সমঝে চলেছিল। যে ছুড়েছিল বোমা, সেই লোকাল ছেলে ‘গন্ডার’-এর দিকে বোমাটি ফেরত পাঠান দুঃসাহসিক ফাটাকেষ্ট।
১৯৭৩ সাল। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘নমকহারাম’ ছবিটি তখন সিনেমা হলগুলোয় চলছে রমরমিয়ে। রাজেশ খান্না-অমিতাভ-রেখা। সুপারহিট। অমিতাভ-রাজেশ খান্না ডুয়েলে দর্শক কার ফ্যান রূপে পরিচয় দেবেন তা ভাবতে ভাবতেই কুপোকাৎ!

Advertisement

[টার্নিং পয়েন্ট ‘অন্ধাধুন’! কী বললেন আয়ুষ্মান?]

উপরের তথ্যটি প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু ‘নমকহারাম’-এর ডায়লগ অমিতাভ কেবলমাত্র সিনেমাতেই দেননি, দিয়েছিলেন এই কলকাতার খাস একটি কালীপুজোর মঞ্চে। ‘নমকহারাম’ সিনেমার বছর এক পরেই। মানুষের স্মৃতি তখনও টাটকা। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটার কাছাকাছি। এক হাত পকেটে দিয়ে, মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে বাঁদিক থেকে ডানদিকে, ভ্রুকুঞ্চন সহযোগে ও বচ্চনভঙ্গিমায়, সেই আদি, জলদগম্ভীর গলায়: কওন হ্যায় ওহ্‌ মাইকালাল…’
তখনও বচ্চন ‘বিগ-বি’ হয়ে ওঠেননি। কলকাতায় এসেছিলেন ‘দো আনজানে’ ছবির শুটিংয়ে। পরিচালক দুলাল গুহ। অভিনয়ে অমিতাভ-রেখা-প্রেম চোপড়া। দুলাল গুহর কলেজ স্ট্রিটের একটি পুজো কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘গ্র‌্যান্ড হোটেলে এসো। দেখা করো অমিতাভের সঙ্গে। তোমাদের পুজোতে আসতে বলো ওঁকে।’ এই মওকা কেই বা ছাড়ে।
কথামতো কাজ। গ্র‌্যান্ড হোটেলে উপস্থিত ফাটাকেষ্ট! দোসর সুকৃতি দত্ত। দুলাল গুহ ফাটাকেষ্টর পরিচয় দিতেই অমিতাভ জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। কালো রঙের হাতকাটা গেঞ্জি পরা অমিতাভকে পুজোয় আসার কথা বলতেই তিনি একপায়ে খাড়া। রাত সাড়ে ন’টায় আনতে যাওয়া হল তাঁকে। ১২টা থেকে ‘দো আনজানে’-র শুটিং আগে থেকেই স্থির, তবু এলেন। এলেন, দেখলেন, ডায়লগ বললেন, জয় করলেন। কালী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ঠায় বেশ কিছুক্ষণ। পরবর্তীকালে হিরে বসানো সোনার একটি নাকছাবিও পাঠিয়েছিলেন অমিতাভ। যদিও পরে চুরি হয়ে সেটি। চোর ধরাও পড়ে। যে দোকানে বেচে দিয়েছিল, দেখা গেল, তা গলানোও হয়ে গিয়েছে। ফলে নতুন করে গড়া হল আবার।

[#MeToo নিয়ে তোলপাড় দেশ, এরই মধ্যে উঠে এল নারীশক্তির কথা]

’৮২ সালের কলকাতা। কলকাতার ত্বকে তখন একটু আগেই খড়ি ফুটত। আগেভাগেই এসে জুটত শীত। কলেজ স্ট্রিটে, বাটার মোড় থেকে একটা রহস্যজনক গাড়ি বাঁক নিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে। রহস্যজনক এই কারণেই যে পুজোমণ্ডপ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মাইকে ঘোষণা হয়েছিল: আমাদের মধ্যে এসে পড়েছেন মুম্বইয়ের বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁশলে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। ঘোষণামাত্র পাড়া তোলপাড়! বেপাড়া থেকেও লোকজন ছোটে। পাড়ায় এ-ওকে হাঁক পেড়ে পেড়ে ডেকে আনছে। পুলিশ ততক্ষণে মোতায়েন হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিনে আশাপূরণ হয়নি। দ্বিতীয় দিনে আশা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ‘পঞ্চম’কে-আর. ডি বর্মন! ভারতীয় সংগীত ইতিহাসের দুই কিংবদন্তি কিনা পাড়ার মণ্ডপে বাঁধা একটি মাচায় গান গেয়েছিলেন। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের রাস্তাটা তখন লোকে লোকারণ্য। সকলে বিস্ময়াভিভূত! আবিষ্ট। সবই মায়ের কৃপা। কালীর টানেই তো এসে পড়া এতদূরে। সঙ্গে অবশ্যই রয়েছেন ফাটাকেষ্ট! তাঁরই উদ্যোগেই তো এই পুজো।
উত্তমকুমার, হ্যাঁ, স্বয়ং উত্তমকুমারও মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্ত একটানা এসেছেন এই ফাটাকেষ্টর পুজোয়। যখন নেমন্তন্ন করতে যাওয়া হত, বলতেন, ‘শুটিং না পড়লে পুজোর সময়ে যাব, নইলে আগেভাগেই যাব।’ প্রণাম সেরে প্রতিবারই মঞ্চে কিছু না কিছু বলে যেতেন উত্তমকুমার। এভাবেই এসেছেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, রাজেশ খান্না, বিনোদ খান্না, উষা উত্থুপ, আরও অনেকে। কোনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেজ নেই, খোলা রাস্তায় মঞ্চ বাঁধা, সেখানেই অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন তনুশ্রীশংকর-আনন্দশংকর। শুধু বলেছিলেন, একটা দিক ঘিরে দিতে, তাহলেই হবে। পুজো কমিটি তাঁদের এটুকু অনুরোধ যে রেখেছিল তা আর বলতে!

[ব্যোমকেশের ডেরায় ঘুরে এলেন ব্যোমকেশ]

কেবলমাত্র সেলিব্রিটি দিয়ে এ পুজোকে তবু বুঝে নেওয়া যায় না। খাস মুম্বই কেন, বিদেশেও এ পুজোর নাম দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়েছে ফাটাকেষ্টর কালী জাগ্রত এই ধারণা থেকে। তাই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষ। তাই মানত করা, নিজের ইচ্ছেটুকুর ভার এখানে নিশ্চিন্তে মায়ের উপর ছেড়ে দেওয়া যায়। একবার দক্ষিণেশ্বর থেকে এক মহিলা এসে উপস্থিত হলেন। দিব্যি মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎই ভর হয় তাঁর উপর। ঘোরের মধ্যে বলে ওঠেন, “লালপেড়ে শাড়ি পরাস আমাকে।” আরও একবার এক ভর-হওয়া মহিলা বলে উঠেছিলেন, “আমার বড় তেষ্টা, তোরা বড় গ্লাসে জল দিতে পারিস না!” কর্মকর্তারা খেয়াল করে দেখেন, সত্যিই পুজোতে নিবেদিত যে গ্লাসটি তা আকারে বড়ই ছোট। দু’বারই কথা শোনা হয়েছিল। লালপেড়ে শাড়ি হয়েছিল মায়ের, জলের গ্লাসও হয়েছিল বড় আকারের।
দুম করে চলে আসা এই সেলিব্রেটি অতিথিদের প্রথমেই মিশিয়ে ফেলা হত না ভিড়ে। তাহলে তো শোরগোল বেধে যাবে। নিরাপত্তার ব্যাপারখানাও রয়েছে। নব যুবক সংঘের উল্টোদিকের রাস্তাতেই রয়েছে ‘দত্তভিলা’। গোপন রাস্তা দিয়ে বিশেষ অতিথিরা সেখানেই প্রথমে যেতেন। তারপর মাইকে ঘোষণা ও পাড়া তোলপাড়। এই চমকে দেওয়ার আইডিয়া যাঁর, তিনিও ফাটাকেষ্ট!
এ পুজোর কথা জনে জনে ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে কারণ একটাই লোক-ফাটাকেষ্ট! কেবলমাত্র পুজো করেই ক্ষান্ত নন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অন্নকূট, দুঃস্থ মানুষের শীতের জামাকাপড় দেওয়া-উদ্যোগ নিয়ে করেছিলেন তিনিই। পুজোর সময়ে তিনি যে সমাজসেবীর মুখোশধারী তা কিন্তু একেবারেই নয়। কোনও দুঃস্থ পরিবারের সন্তানটির বিয়ের টাকা জোগাড় করা থেকে কারও বাড়ির ছাদ খসে পড়া-একডাকে সাড়া দিতেন ফাটাকেষ্ট। কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই নয়, ‘নব যুবক সংঘ’-র সুভেনির যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন কী পরিমাণ গুছিয়ে কাজ করা হত। তা কোনও রিসার্চ পেপারের থেকে কম কিছু ছিল না। কলকাতা নিয়ে একের পর এক অনবদ্য কাজ উপহার দিয়ে গিয়েছে এই সুভেনিরটি। অবশ্য এখন, বেশ কয়েক বছর তা বন্ধ হয়ে রয়েছে।

[লাইভ কিশোর কুমারের গান শুনতে চান? ঢুঁ মারুন বেনিয়াটোলা লেনে]

প্রতিবারই কোনও না কোনও তাবড় ব্যক্তিত্ব উদ্বোধন করে থাকেন এই পুজো। যেমন এবারে উদ্বোধন করলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু বলে নেওয়া দরকার, ফাটাকেষ্টর পুজো কমিটি অদ্যাবধি কাউকে টাকাপয়সার বিনিময়ে উদ্বোধন করাতে নিয়ে আসেনি। যাঁরা এসেছেন, এসেছেন নিজের ভক্তি থেকে। পুজোর ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে। ফাটাকেষ্টর প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসায়।
১৯৯২ সালে হৃদরোগে ফাটাকেষ্টর মৃত্যু হলেও, তাঁর পুজোর ধারা আজও একইরকমভাবে বহমান। আজ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট সেইসব রোমাঞ্চকর ইতিহাস নিয়ে স্থির হয়ে আছে।তাঁর নাম এখনও এমুখে-ওমুখে ঘুরে বেড়ায়। তাঁরই নাম ধার করে হয়ে গিয়েছে জমজমাট সিনেমা ‘এম এল এ ফাটাকেষ্ট’। তাঁরই কথায় বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত এককালে। দাপুটে, হোমরাচোমরা, গনগনে কিন্তু বন্ধুবৎসল, অতিথিসদয়, এক বাঙালি রবিনহুড। ফাটাকেষ্ট! যাঁর নামের পাশে দাঁড়ির থেকে বিস্ময়সূচকই মানায় বেশি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ