Advertisement
Advertisement

Breaking News

নচিকেতা, রূপঙ্করদের আড্ডা ছিল শ্যামবাজারের এই চায়ের দোকানে

সকালের প্রথম চা খেতে আসতেন বিকাশ রায়।

This tea shop patrons include Nachiketa, Rupankar

ন্যাশনাল ইকোনমিক রেস্টুরেন্ট। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

Published by: Suparna Majumder
  • Posted:August 25, 2018 4:07 pm
  • Updated:August 25, 2018 10:15 pm

শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে ঐতিহাসিক সব চায়ের দোকান। সিসিডি-বারিস্তার বাজারেও যা জলজ্যান্ত বেঁচে। এমনই কিছু চায়ের আড্ডার সন্ধানে সম্বিত বসু।

শ্যামবাজারের শশীবাবু সকালবেলা সাইকেলে চড়ে শসা নিয়ে সদরে যাচ্ছেন- ‘ওগো বধু সুন্দরী’তে এ সংলাপ মুখে বসেছিল উত্তমকুমারের। ‘স’ আর ‘শ’ এই দুয়ের উচ্চারণের আড় ভাঙতে এমন টাংটুইস্টার কি মহানায়ক আর কোনও দিন আওড়েছেন কোনও সিনেমায়? এ দীনের জানা নেই।

Advertisement

তবে সকালবেলা, জিভের আড় ভাঙতে টাংটুইস্টারের থেকে চা-ই জনপ্রিয়। শ্যামবাজারের নেতাজির ঘোড়া যে দিকে পা ছুড়ছে, সেই রাস্তার কোনায় ৯৮ নট আউট ‘ন্যাশনাল ইকোনমিক রেস্টুরেন্ট’। স্থাপিত সেই ব্রিটিশ আমলে, ১৯২০ সালে। সেই ’২০ সালে জওহরলাল বসাক শ্যামবাজারের মোড়ে, এই অনতিবিস্তীর্ণ জায়গাটিকে বেছে নিলেন ব্যবসার জন্য। তখনও ‘অঁতপ্রনার’ শব্দটা বাজারে হইচই ফেলেনি। জোড়ামন্দিরে ভাড়াবাড়ি থেকে রোজ এই দোকান সামলানো। প্রথমে পাইস হোটেল গোছের। ভাত-তরিতরকারি-মাছ—মাংস। রাতের দিকে কাটলেট-চা-ফ্রাই। কিন্তু রাজনৈতিক উথালপাথালে কোনও কর্মচারীই বেশি দিন টেকে না দোকানে। ও দিকে মূল্যবৃদ্ধি। জওহরলাল তবু দমে যাননি। কেবল বদল হল আইটেম।

Advertisement

চা, ডিমটোস্ট, জেলিটোস্ট, ওমলেট, ডিমসেদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। সে দোকান এখন ৯৮ বছরে। পঞ্চম প্রজন্মের হাতে। এখন দোকানের দেখাশোনা করেন সেই বসাক পরিবারেরই দু’ভাই। রাজীব বসাক ও শুভাশিস বসাক। রাজীব বসাক জানালেন, “দোকানের ভিড় সবথেকে বেশি সকালবেলায়। অনেকেই প্রথম চা এখান থেকে খেয়ে যান। সন্ধেতেও আঁটসাঁট ভিড়।” দোকানের ধারাবাহিক চা খেতে আসা সকলের ‘রজতদা’ বলে উঠলেন, “এখানে চায়ের সঙ্গে মেশানো হয় আন্তরিকতা, যা এখন হারিয়ে গিয়েছে। কোনও চায়ের দোকানে কুড়ি টাকা খরচ করে দু’টো মাখন-টোস্ট আর দুধ চা খেয়ে এক-দেড় ঘণ্টা কাটাতে পারবেন আজকাল?”

[‘আমার জগৎ সাধারণ মানুষ নিয়ে, যাঁদের কোনও বডিগার্ড নেই’]

দেওয়াল অনেকাংশেই খসে পড়ছে। খসে খসে কোথাও বিশ্বের ম্যাপের মতোও লাগছে। কিন্তু তাতে কারই বা ভ্রুক্ষেপ। লোকে আসছে, বসছে, নিদারুণ গল্প করছে। চায়ের পর চা উড়ে আসছে ভিতর থেকে।

প্রায়ই দেখা যাবে, শেষ টেবিলে সলিল চৌধুরির গান প্রায় অন্তাক্ষরী ভঙ্গিমায় গেয়ে চলেছেন দু’-একজন। ওটা গানের টেবিল। চায়েরও। রজতদা জানালেন, “এখানে যাঁরা আসেন, আসতেই থাকেন, তাই মুখের যে বিরাট বদল দেখা যায়, তা নয়। আসলে তাঁরা প্রেমে পড়ে যান এই ৯৮ বছরের কলকাতার স্মৃতির। হয়তো তাঁরা এখানেই প্রেম করেছেন, বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মেরেছেন। এখন সেই স্মৃতিকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়া। এক-দু’কাপ চা সেই স্মৃতিকে টাটকা করে দেয়।” স্মৃতি তো একরকমের গাছ, যা জলের বদলে চায়ের উপর বেঁচে থাকে।

এখানে আসতেন বিকাশ রায়। বসতেন, চা খেতেন। টুকটাক ভাবার কাজ, স্বল্প মিটিং। কুমার শানু যখন ‘কুমার শানু’ হয়ে ওঠেননি, সিঁথির বাড়ি থেকে প্রায়ই আসতেন এই দোকানে। আসতেন নচিকেতা। প্রতিবেশী রূপঙ্করও। এখনও তরুণ তুর্কি থেকে অশীতিপর, সকলেই। কখনও ফিল্মের শুটিং। কখনও অফিসের অনলাইন মিটিং। কখনও নিছকই পুনর্মিলন। সকলের কাছে নিরুপদ্রব একটা ছাদ।

দশ টাকায় গরমাগরম পোচ, তাতে চামচ ঠেকালে মনে হয় সূ্র্যের ভুঁড়ি ফেঁসে গেল, পাবেন এ দোকানেই। উপরে একটু নুন-গোলমরিচ। খুব বেশি খিদে পায়নি, কিন্তু মনটা খাই খাই করছে, শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে পাঁচমাথা ঘামাচ্ছেন- তখন এর থেকে ভাল আশ্রয় আর কী হতে পারে?

ন্যাশনাল ইকোনমিক রেস্টুরেন্ট। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

রাজীব বসাক জানালেন, “একবার ‘আবহমান’ ছবির শুটিং হয়েছিল। ভোরের দিকে। এসেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সঙ্গে যিশু সেনগুপ্ত, দীপঙ্কর দে। এখানেই বসে খেয়েছিলেন ডিম টোস্ট, চা। মনে পড়ে সব এখনও। হঠাৎ কী যে হল! উনি চলে গেলেন।”

“সিনেমায় অবশ্য দোকানের দৃশ্যটা ছিল না। বুঝতেই পারি, সব দৃশ্য তো থাকে না, যা শুট হয়। কিন্তু তবু যদি থাকত, একটা সিডি নিজের কাছে রেখে দিতাম। অবশ্য ভাবি, যে অভিজ্ঞতা, তা তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারছে না। এই দোকানের সঙ্গে তা জড়িয়ে রয়েছে।” গলায় একটু বিষাদ, মুখে হাসি রাজীবদার।

[উত্তমকুমারের খাবার যেত এই দোকান থেকে, আসতেন সুচিত্রা সেনও]

পরের প্রজন্ম কী করবে, জানেন না রাজীবদা। তারা কি গ্রহণ করবে এই বয়স্ক দোকানটিকে? কে জানে। তবে দোকান রং করার কথা খদ্দেরদের বললে, অনেকেই আপত্তি করেন। বলেন, ‘সকলেই তো ঝকঝকে-চকচকে। কেউ তো একটা নিজের মতো পুরনো হয়ে থাকল।’ রাজীবদা যদিও জানালেন, “পুরনো ব্যাপারখানা বজায় রেখেই, নতুন করার চেষ্টায় রয়েছি।”

এখনও বসাকদের ঠিকানা সেই জোড়াবাগানের ভাড়াবাড়ি। যে বাড়ি থেকে একদিন বেরিয়ে এই দোকানের দেখভাল করতেন জওহরলাল, সেই বাড়ি থেকেই বেরিয়ে আসেন রাজীব ও শুভাশিস বসাক। এখনও সেই ভাড়াবাড়িই।

নিজেদের বাড়ি না হলেও, অন্যদের জন্য ছাদের ধারাবাহিক জোগান দিতে তাঁদের কোনও তুলনা নেই।

পুনশ্চ: এ দোকানে ধূমপান নিষেধ। ফলে শ্যামবাজারের রাস্তায় নেমে পাঁচমাথার মোড় দেখতে দেখতে একখানা ধরানো যেতেই পারে। বেশিক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে দেখবেন, আপনি হয়ে যাচ্ছেন পথনির্দেশিকা। ঠিক কেউ না কেউ কোনও ঠিকানা জিগ্যেস করবেন। যে কাউকে পথ বাতলে দেওয়া নিঃসন্দেহে বড় একটা কাজ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ