Advertisement
Advertisement

বাঙালি অভিনেতারা বাংলাও বলতে পারেন না, বিস্ফোরক সৌমিত্র

কেন একথা বললেন কিংবদন্তি?

Even Bengali actors don’t know vernacular well: Soumitra Chatterjee
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:July 12, 2018 5:44 pm
  • Updated:July 12, 2018 5:44 pm

ভাস্কর লেট: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছেই শুটিং হচ্ছে। মাঝে একটা ব্রেক পেতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চলে গিয়েছিলেন অকালমৃত কবি-বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। ফিরে আসার পর তাঁরই এক বাঙালি সহ-অভিনেতা সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেন,

–কোথায় গিয়েছিলেন?

Advertisement

কাছেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে।

Advertisement

–ওঃ! দেখা হল?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেন ধাক্কা খান। সংযত কণ্ঠে আবারও মনে করিয়ে দেন, তিনি গিয়েছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সহ-অভিনেতা তবু ইশারা বুঝতে পারেন না। অম্লানবদনে ফের জিজ্ঞাসা করেন

–দেখা হল তো ওঁর সঙ্গে?

ভুল ভাঙাতে আর উদ্যোগী হননি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুধু বলেছিলেন, বহুদূর থেকে ডাক না এলে তো এখন আর শক্তির সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়!

[বেলুড় সফরে মুগ্ধ রজনীকান্ত, সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন স্বামীজির বই]

বুধবার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চন্দ্রমুখী কাদম্বিনী হল’-এ অধ্যাপক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তর স্মরণে সপ্তম স্মারক বক্তৃতা দিতে দিতে এই স্মৃতি তুলে এনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সখেদে বলেন, একজন বাঙালি অভিনেতা কেন সমসময়ের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবির মৃত্যুর খবরটুকু রাখবেন না? অভিনয় কি কোনও দিন ভাষা ও সংস্কৃতির মরমী বন্ধনী থেকে বিচ্যুত হয়ে সার্থকতা পেতে পারে? আত্ম-সমালোচনার কুঠার চালাতে তাঁর হাত একবারও কাঁপেনি। স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছেন- আমি তো পেরুর অভিনেতা নই! তাহলে বাংলা বলতে পারব না কেন?

লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি। তার সাদা জমিতে ঘন রঙের ফুল-কাজ। সুপুরুষ মানুষটিকে করে তুলেছিল আরও সুশোভন আলোপুরুষ। বক্তৃতার শুরুতে উদ্যোক্তাদের তরফে অধ্যাপক চিন্ময় গুহ বারবার অনুরোধ করেছিলেন- চেয়ারে বসেই বলুন। কিন্তু সে আবেদনে সাড়া না দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি পেশ করতে ঋজু পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের ডানদিকে, তাঁর হাতে বক্তৃতার একটি লিখিত খসড়া ছিল বটে, কোনও আয়না তো ছিল না! অথচ বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর উচ্ছ্বসিত আবহাওয়ার মধ্যে সকলেরই যেন হুঁশ হয়, বিনা আয়নাতেই আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে শব্দের সামগানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নির্ভুল আত্মদর্শন করিয়েছেন। যে ‘বিষয়’ তিনি ধার্য করেছিলেন এই বক্তৃতার জন্য- ‘অভিনেতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতি’। তা নির্বাচন করার গুরুত্বও ততক্ষণে দ্বিধাহীনভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে।

গত শতকের নয়ের দশকে বাংলা রঞ্চমঞ্চে একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে নাটকে ৪০জন অপ্রধান ‘ভূমিকা’ অভিনেতার দরকার পড়ে। প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার অত সংক্ষিপ্ত চরিত্রে সাধারণত অভিনয় করেন না। বা, করলেও তার জন্য যেরকম চড়া অর্থমূল্যের দাবি উঠবে, ৪০ জনের ক্ষেত্রে তা বহন করা অসম্ভব। তখন উপায়হীন হয়ে কিছু মঞ্চমুগ্ধ, উচ্চাশাপীড়িত অভিনেতার দ্বারস্থ তাঁকে হতে হয়েছিল। কাজ করতে গিয়ে সৌমিত্রবাবু অনুধাবন করেন, তাঁরা প্রত্যেকে বাঙালি হলেও কেউই স্পষ্ট, সুন্দর, ত্রুটিহীনভাবে বাংলা ভাষাটা বলতে পারেন না। ওঁর সেই মনোবিচলন ক্রমে এই সুদৃঢ় দুর্ভাবনার জন্ম দেয় যে, ভাষার প্রতি অনবধানতা যাঁর আছে, তিনি কেমন করে সু-অভিনেতা হতে পারবেন?

[সঞ্জয় দত্ত অপরাধী, বায়োপিককে তুলোধোনা সংঘের মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’-এ]

এদিনের স্মারক বক্তৃতায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাই বলেন, ‘ভাষার ব্যবহারে আমি যে খুব এগিয়ে আছি তা বলছি না। আমি হয়তো খুব ছোট পরিসরের মাঠ, যা দিয়ে আরম্ভ করা যায়। কিন্তু এর চেয়েও যাঁরা কম হয়ে থাকছেন, তাঁরা কী করে অভিনয় করছেন তা আমার কাছে চিরকালই বিস্ময়ের বস্তু!’

বাঙালি অভিনেতা কেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অমনোযোগী হলেন? এর উত্তর খোঁজা, তাঁর কাছে, জীবনানুসন্ধানের অংশ। দেশভাগ, দাঙ্গা ও পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশ কি এর নেপথ্য কারণ? না কি এর জন্য দায়ী গ্ল্যামার জগতের হাতছানি ও আত্মকেন্দ্রিক নার্সিসাস হয়ে ওঠার প্রবণতা? একজন বাঙালি অভিনেতার সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দূরত্ব বেড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে যে কত বড় সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অভিঘাত থাকতে পারে, সেই তেপান্তর সম্ভাবনা স্মারক বক্তৃতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে উন্মোচিত করেছেন তিনি। ওঁর মতে, আজকের বাঙালি অভিনেতারা বাংলা ভাষা থেকে এতটাই দূরে চলে গিয়েছেন যে, সকলের অবস্থা হয়েছে হাতিয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো! অহংকার আছে। কিন্তু অহংকারের উপযোগী হয়ে ওঠার তেজটুকু নেই।

আত্মপ্রদর্শন, না সত্যপ্রদর্শন? বিনোদিত করা, না হিতচিন্তা? অর্থ কীর্তি সচ্ছলতা? না, উন্নততর মানুষ হওয়া? ‘অভিনয়’ এর কোনটা? অভিনেতার ‘লক্ষ্য’ কী?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ধাপে ধাপে অন্বেষণ শেষ করে সিদ্ধান্তে জানিয়েছেন, ‘উৎকৃষ্ট অভিনেতা’ হওয়া আর ‘উন্নততর মানুষ’ হওয়ার পথ অভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষার প্রতি ‘ভালবাসা’। এই ভালবাসাই পারে অভিনেতাকে বিরামহীন পথিক ও পথপ্রদর্শক করে তুলতে।

[বয়স নাকি তাঁর ৪৬? উত্তরে এটাই বললেন জয়া আহসান]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ