Advertisement
Advertisement

স্বর্ণযুগের শেষ চিহ্নটুকুও মিশে গেল অনন্তে

'উত্তম-সুচিত্রা, হেমন্ত-সন্ধ্যা বাংলার এমন এক যুগক্ষণ, যার তুলনা কোথাও খোঁজে না বাঙালি।'

A tribute to a legendary singer Sandhya Mukherjee | Sangbad Pratidin
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:February 16, 2022 10:33 am
  • Updated:February 16, 2022 11:25 am

সরোজ দরবার: স্বর্ণযুগের দুয়ার যেন এতদিনে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলেন কেউ। যে যুগ বাঙালি অহংকার, শ্লাঘা আর সম্ভ্রমের; যে যুগ বাঙালিকে সর্বভারতীয় করে তোলে লহমায়; সেই যুগের শেষতম প্রতিনিধিও এবার যাত্রা করলেন অনন্তের পথে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের (Sandhya Mukherjee) প্রয়াণ বাঙালি কাছে এমনই এক ঘটনা, যার কাছে যে কোনও বিশেষণই তুচ্ছ হয়ে যায়। একটা গোটা যুগের চিহ্নই যেন মুছে গেল তাঁর সঙ্গে।

উত্তম-সুচিত্রা, হেমন্ত-সন্ধ্যা মিলে বাংলার এমন এক যুগক্ষণ চিহ্নিত হয়, যার তুলনা আর কোথাও খোঁজে না বাঙালি। এ সেই যুগ যখন বাঙালি তার সৃষ্টিশীলতাতেই রচনা করে নিচ্ছিল নিজের পরিচয়পত্র। স্বাধীনতা উত্তর সময়কালে বাংলার শিল্প-সংগীত-সিনেমা তখন খুঁজে পাচ্ছে আধুনিকতার নতুন আলো। সে বড় সহজ কাজ ছিল না। অনুশীলন, সাধনা তখন নিছক শব্দমাত্র হয়ে ওঠেনি। আজ আমরা বিস্ময়ে খেয়াল করি, কী অসামান্য নিষ্ঠায় সেই সব সোনার মানুষরা তৈরি করছিলেন স্বর্ণযুগের আখ্যানখানি। রক্তমাংসের মানুষ হয়েও তাঁরা নিজেদের ঊত্তীর্ণ করেছিলেন সাধকের পর্যায়ে।

Advertisement

আরও পড়ুন: যৌবনের দূত ‘ডিস্কো কিং’ বাপি লাহিড়ী! তরুণ প্রজন্ম তাঁর গানেই পেয়েছিল সমকালের হৃদস্পন্দন]

সুরের সাধনাই তো করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। পারিবারিক সূত্রেই সংগীত এসেছিল তাঁর কাছে। অল্পবয়সে সংগীতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সসম্মানে। গীতশ্রী স্বীকৃতি তো আজীবন তাঁর নামের সঙ্গে মিশে থাকল। কিন্তু সেটুকুই কি সব! খ্যাতি, স্বীকৃতির পেরিয়েও থেকে যায় সৃষ্টির এক ঐশ্বর্যময় অনুসন্ধান। সংগীতের সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজার ছলে আজীবন সেই মুক্তোটিরই সন্ধান করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের সাক্ষাৎ শিষ্যা তিনি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর দখল তুলনারহিত। সেই তিনিই যখন সুচিত্রা সেন নামক মহাকাব্যটিকে কণ্ঠের মাধুর্যে ফুটিয়ে তুলছেন, তখন তিনি একেবারে অন্য মানুষ। তিনিই আবার গাইছেন আধুনিক গান থেকে নজরুলগীতি। বাঙালির অনুরোধের আসর তাঁকে ছাড়া কবে আর সম্পূর্ণ হয়েছে! এই বৈচিত্র ধারণ করা সহজ তো নয়ই, বরং দুরূহ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তা পেরেছেন অনায়াসে।

Advertisement

A tribute to a legendary singer Sandhya Mukherjee

ঈশ্বরদত্ত প্রতিভার অধিকারী তিনি ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার পরেও এসে যায় সেই সাধনার কথা। যে সাধনা ওই যুগেরই চিহ্ন। বাংলা গানের গায়নরীতির যে আধুনিকতা, তার একদিকের কাণ্ডারি যদি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে হন, তবে অন্যদিকে অমোঘ উপস্থিতি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। নায়িকা চরিত্র রূপায়ণে তখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে ফেলেছেন সুচিত্রা সেন। পূর্বসূরিদের থেকে অনেকটাই আলাদা তিনি। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন বাঙালি-জীবন খুঁজে পায় তার কাঙ্ক্ষিত শান্তিনিকেতন। আর বাঙালির সেই সমবেত স্বপ্নকেই কণ্ঠে ধারণ করছেন সন্ধ্যা, রূপদান করেছেন এক অন্য পৃথিবীর। তিনিও বদলে ফেলছেন গায়ন শৈলী। পূর্বসূরিদের আশীর্বাদ নিয়েই বাংলা গানের এক নতুন দরজা খুলে দিচ্ছেন সন্ধ্যা। সৃষ্টির আধুনিকতার এই নবজাগরণ তখন বাঙালির হাতেই।

আরও পড়ুন: ‘শেষ জীবনে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা বোঝালেন’, প্রয়াত গীতশ্রীর স্মৃতিচারণায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী]

সারা ভারতবর্ষ বুঁদ হয়ে আছে শচীন দেব বর্মণsandhya mukherjee কিংবা হেমন্ত কুমারে। সিনেমা থেকে আধুনিক গান পাচ্ছে তার নিজস্ব পরিচয়। সেই সময়েরই আকাশে উজ্জ্বলতম তারা হয়ে ফুটে উঠেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যে বিপুল বৈচিত্র তিনি তাঁর গায়নে ধরে রাখলেন, তাঁর সাধনা ছুঁয়ে ফেলল সুরের আকাশের যে ব্যাপ্তি- তা ইতিহাসে একবারই হয়। এ কথা ঠিক যে বাংলা গানই তাঁকে জড়িয়ে ধরবে চিরআপন করে। তবে সুরের কোনও রাজ্য নেই, দেশ নেই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাই বাংলার হয়েও, আসলে ভারতবর্ষ নামক দেশটিরই রত্ন। এ দেশের সামগ্রিক সংগীতের ইতিহাসই সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁকে পেয়ে, তাঁর কণ্ঠ-ঐশ্বর্য পেয়ে।

সময়ের নিয়ম তবু লঙ্ঘন করা যায় না। চলে গিয়েছেন বাঙালির হেমন্ত, মান্না। এই সেদিন চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উত্তম-সুচিত্রার স্বপ্নকুঞ্জ আজ বাঙালির কাছে কেবল জেগে আছে স্মৃতিতে। বাংলার আধুনিক ইতিহাস যাঁদের হাতে গড়া, তাঁদের প্রায় সকলেই আজ অন্যলোকের বাসিন্দা। প্রযুক্তি-বাণিজ্য শাসিত এই যুগে এসে সৃষ্টি কিংবা সাধনার অর্থও বদলে যাচ্ছে দ্রুত। তবু ভাবতে ভাল লাগত যে, সোনার সময়ের জাগপ্রদীপ হয়েই এতদিন আমাদের মধ্যে ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আজ তাঁর না-থাকা আসলে এমন এক শূন্যতার সামনে বাঙালিকে এনে দাঁড় করায় যা সর্বার্থেই অপূরণীয়। স্মৃতির স্বর্ণযুগ হয়তো এখন চিরতরে বন্ধই হল বাঙালির জন্য। খুলে গেল এক অনন্ত সম্ভাবনা। যেখানে জেগে থাকবে তাঁদের সৃষ্টি।

[আরও পড়ুন: সব প্রজন্মের কাছেই তাঁর গান সুপারহিট, বাপি লাহিড়ীর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ মোদি-মমতার]

মায়াবতী মেঘে আবার যেদিন তন্দ্রা নেমে আসবে সেদিন বাঙালি অবধারিত খুঁজে নেবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। ছুঁয়ে দেখবে তার হারিয়ে ফেলা সোনার সময়কে। আগামীর সেই পথ যে দিকেই বাঁকুক না কেন, বাংলা আর বাঙালির ইতিহাস চিরকালীন এই উপলব্ধিতেই থিতু হবে যে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে একটা জাতি একবারই পায়। তাঁর আর কোনও দ্বিতীয় হয় না বলেই তিনি এক এবং অদ্বিতীয়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ