Advertisement
Advertisement

ধর্ষণের ভারতে নারীর শক্তিকে কুর্নিশ করছে ‘দঙ্গল’

“মারো ছোড়িয়াঁ ছোড়োঁ সে কম হ্যায় কে?”

In The Background Of Rapist India, Dangal Promoting Women Empowerment
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:December 23, 2016 4:08 pm
  • Updated:December 23, 2016 4:29 pm

অনির্বাণ চৌধুরী: রামায়ণে বিশ্বামিত্র মুনি যখন রাম, লক্ষ্মণকে নিয়ে তাড়কা বধের জন্য রওনা দিয়েছিলেন, তখন এক সন্ধ্যাবেলা বিশ্বামিত্রকে এক অদ্ভুত কথা বলতে শোনা যায়। বাল্মীকি রামায়ণ বলছে, সেই সন্ধ্যায় বিশ্বামিত্র রামকে গঙ্গা নদীতে স্নান সেরে আসতে বলেন। রাম স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে এলে বিশ্বামিত্র বলেছিলেন, তিনি রামকে বলা ও অতিবলা নামে দুই মন্ত্র দেবেন। যে মন্ত্রশক্তি সঙ্গে থাকলে রাক্ষসরা রামকে বলাৎকার করতে পারবে না। রামায়ণ বলাৎকার শব্দটি এখানে ব্যবহার করেছে তার মূলগত অর্থে। বল বা গায়ের জোরে কাউকে হেনস্তা করাই তাই বলাৎকার! ধর্ষণ-দীর্ণ ভারতের ২০১৬ সালের শেষে এসে সেই বল আর বলপ্রয়োগের সূত্রেই নারীশক্তির মাহাত্ম্যকে বাঁধল ‘দঙ্গল’। স্রেফ এক স্পোর্টস ড্রামা বলে তাকে শ্রেণিভুক্ত করা গেল না!

dangal1_web
আসলে একেবারে আদিম যুগ থেকেই মানুষের সভ্যতায় বল আর তার প্রয়োগ বড় মহিমামণ্ডিত। তার উপরে ভিত্তি করেই ইতিহাস রচনা, তার উপরে ভিত্তি করেই যাবতীয় শ্রেণিবিভাগ। পুরুষ আর নারীর শ্রেণিবিভাগেও খুব প্রকট ভাবে থাকে এই শারীরিক ক্ষমতার বিষয়টি। নারীর শরীরে পুরুষের চেয়ে লোহিত কণিকা কম, তাই সে কম বলশালী। কিন্তু সেই কম বলের সঙ্গেই যদি যুক্ত হয় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, তবে কি নারী পুরুষের পক্ষে অপরাজেয় হতে পারে?
সেই উত্তর দিতে গিয়ে ‘দঙ্গল’ সবার প্রথমে ভাঙল পুরুষতান্ত্রিকতার প্রচলিত সংখ্যাকে। সেই জন্য ছবির শুরু থেকে মহাবীর সিং ফোগাটকে আমরা দেখি এক পুত্রসন্তানের জন্য ছটফট করতে। সংসারে অর্থের জোগান দিতে গিয়ে সে কুস্তি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ভেবে রেখেছে, তার ছেলে একদিন ভারতের জন্য সোনা জয় করে নিয়ে আসবে। নিয়তির পরিহাসে পর পর চারটি কন্যা জন্ম নেয় তার ঘরে। তার পর? পোস্টারে যা বড় বড় করে লেখা আছে, তা-ই! “মারো ছোড়িয়াঁ ছোড়োঁ সে কম হ্যায় কে?”

Advertisement

dangal2_web
এই কাহিনিসূত্র ছবির ট্রেলার থেকে এতদিনে জেনে গিয়েছেন সকলেই! ছবিটা দেখতে বসলে টের পাওয়া যাবে- যেমনটা আশা করা গিয়েছিল ট্রেলার দেখে, ঠিক তেমনটাই হয়েছে ‘দঙ্গল’। খুব বাঁধাধরা গতে দঙ্গল এক স্পোর্টস ড্রামা। এবং বলিউডের বায়োপিকের তালিকায় এক নতুন সংযোজনও! কিন্তু এতটাই নিখুঁত যা আফশোস করার কোনও জায়গা দেবে না। পাশাপাশি খেই ধরিয়ে দেবে নারীশক্তির উত্থানের।
সেই জন্যই শুধুমাত্র কুস্তি থেকে ভারতে সোনা এল- এই ব্যাপারটা আঁকড়ে পড়ে থাকেনি ‘দঙ্গল’। ছবির সংলাপে মহাবীর সিং ফোগাটকে বলতে শোনা গিয়েছে বটে- সোনা সোনাই হয়, তা সে ছেলেই জয় করে আনুক বা মেয়ে- কিন্তু সেটাই ছবির সবটুকু নয়। এই ছবি যে নারীর মাহাত্ম্যের কথা বলবে, তা প্রথম থেকে শেষ ফ্রেম পর্যন্ত স্পষ্ট। সেই জন্যই টাইটেল ট্র্যাকে কুস্তির আখড়ার খয়েরি মাটি, কুস্তিগিরদের প্যাঁচ-আছাড়, মুগুর ভাঁজা, পেশি ফোলানো, পুরুষতন্ত্রের প্রতীক হয়ে হাওয়ায় উড়তে থাকা লাল ল্যাঙটকে খুব বেশি করে ফোকাস করে হয়। বুঝিয়ে দেওয়া হয়, পৌরুষ আর পেশির বাঁধা গতের সম্পর্ককে চুরমার করবে ‘দঙ্গল’।

Advertisement

dhaakad_web
কার্যত তা করেছেও ছবিটি। ক্রমান্বয়ে ছেলেদের সঙ্গে গীতা আর ববিতা সিং ফোগাটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জিতে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে তা স্পষ্ট করেছেন পরিচালক নীতেশ তিওয়ারি। নারীশক্তির কথা বলবেন বলেই ফোগাট পরিবারের ছেলেটিকে রেখে দিয়েছেন দুর্বল করেই! সে নিতান্তই এক মিনমিনে পুরুষ! মহাবীর সিং ফোগাট তার জেঠু হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে সেই জোর নেই যা গীতা-ববিতার মধ্যে আছে! অবশ্য এও তো সত্যি- গীতা আর ববিতা সিং ফোগাটের জোর ছিল বলেই তাঁরা সোনা জয় করে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই দিকটা তুলে ধরতে গিয়ে ছেলেদের দুর্বল করেই রেখে দিল ‘দঙ্গল’। না কি সেটা ফোগাট-জিনের মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য?
প্রশ্নটার সদুত্তর ছবি থেকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাওয়া যাবে এক অনাবিল আনন্দ যা বহু কাল কোনও ভারতীয় ছবি দেয়নি। কেন না ‘দঙ্গল’ তৈরিই হয়েছে সার্বজনীন এক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। ছুটির মরশুমে সারা পরিবার নিয়ে দেখার জন্য। সেই জন্য এমন অনেক সমস্যাকে স্পোর্টস ড্রামার মধ্যে নিয়ে এসেছে ‘দঙ্গল’ যা নিয়ে ভারতের প্রতিটি পরিবারই জেরবার! যেমন, জেনারেশন গ্যাপ, দুই প্রজন্মের ভুল বোঝাবুঝি, গ্রাম এবং শহরজীবনের দ্বন্দ্ব। এই তিনটি দিকই ছবির দ্বিতীয়ার্ধে মহাবীর সিং ফোগাট এবং গীতার সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। এরকম ছোট ছোট সাব-প্লট অবশ্যই ‘দঙ্গল’ ছবির এক বড় পাওনা।

dangal4_web
এছাড়া ‘দঙ্গল’ দেখতে দেখতে আরও এক সমস্যার কথা মনে পড়ে গেল যা নিয়ে খুব বেশি তিতিবিরক্ত স্পোর্টস দুনিয়া। মিলখা সিং একবার এক সাক্ষাৎকারে আমায় বলেছিলেন সেই কথাটা। তাঁর দাবি ছিল- স্পোর্টসের দুনিয়ায় শহুরে মুখ খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিলের ব্যাপার! সাফ বলেছিলেন মিলখা- গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রমী হয়। সেই পরিশ্রমের ফলটাই তারা পায় প্রতিযোগিতার ময়দানে। ‘দঙ্গল’ কথাটা আবার মনে করিয়ে দিল। ওই যে গ্রাম আর শহরজীবনের দ্বন্দ্বের কথা বলছিলাম, সেই প্রেক্ষাপটে।
অর্থাৎ ‘দঙ্গল’-এর প্যাকেজিং নিয়ে কোনও কথা হবে না! আমির খানের হালফিলের প্রায় প্রতিটি ছবিরই সম্পদ এই প্যাকেজিং। এক মোড়কে এমন অনেক কিছু হাতে তুলে দেওয়া যা দর্শক আশাও করছেন না। কিন্তু আচমকা পেয়ে যাওয়ায় উপচে পড়ছে প্রাপ্তির ঝুলি। সেই জায়গাতে একেবারে সঠিক লক্ষ্যভেদ করেছে ছবিটা। শুধুই স্পোর্টস নিয়ে বসে থাকেনি। বাবার শাসন, ভারতীয় পরিবারতন্ত্রের গঠন, মেয়েদের নিয়ে সমাজের মানসিকতা- খুব ছোট ছোট ফ্রেমে তুলে ধরে বাজিমাত করে ফেলেছে ছবি। যাঁরা স্পোর্টস ভালবাসেন এবং যাঁরা বাসেন না- কোনও দলই নিরাশ হবেন না ‘দঙ্গল’ দেখে।

dhaakad3_web
আর এই নিরাশ না হওয়ার কারণ যতটা না লুকিয়ে রয়েছে ছবির চিত্রনাট্যে, সমানে সমানে রয়েছে অভিনেতাদের পারফরম্যান্সেও। এই জায়গায় বাধ্য হয়েই সবার আগে বলতে হবে আমির খানের কথা। অদ্ভুত ভাবে যে পুরুষতন্ত্রের কাঠামোকে ভাঙতে চাইছে ‘দঙ্গল’, ছবি বানানোর সময়ে কিন্তু সেই পুরুষতান্ত্রিকতা বজায় থেকেছে হামেহাল। এখনও যে ছবিতে বলিউডের তিন খান থাকেন, সেখানে নায়িকাদের প্রায় কিছু করার থাকে না। আমির খানের ক্ষেত্রে কথাটা আরও ভয়ঙ্কর ভাবে সত্যি! তিনি এতটাই জোরালো অভিনেতা যে কাউকে জায়গাই ছাড়েন না। এখানেও মহাবীর সিং ফোগাটের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, জেদ, অসহায়তা, রাগ- সব কিছু নিয়ে আমির একশোয় একশো! ‘দঙ্গল’ তাই আমির খানের ছবি হয়েই থেকে গিয়েছে। বেশ কষ্ট করেই মনে করতে হচ্ছে পরিচালকের নামটা।

dangal6_web
তবে অন্য দুই খানের চেয়ে আমির অনেক বেশি বুদ্ধিমানও। তাই তিনি এমন ছবিই সই করেন যার বাকি অভিনেতারা তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে। সেই নিরিখে মহাবীর সিং ফোগাটের স্ত্রীর চরিত্রে সাক্ষী তনওয়ার, বড় মেয়ে গীতার ছোটবেলার চরিত্রে জারিরা ওয়াসিম আর বড়বেলায় ফতিমা সানা শেখ, ববিতার ছোটবেলা-বড়বেলায় যথাক্রমে সুহানি ভাটনগর এবং সানিয়া মালহোত্রা, মহাবীরের ভাইয়ের চরিত্রে রাজকুমার রাও, ভাইয়ের ছেলের চরিত্রে অপরশক্তি খুরানা একেবারে যথাযথ বাছাই! তবে সাক্ষী তনওয়ারকে চিত্রনাট্যে খুব একটা জায়গা দেওয়া হয়নি। যে পরিবারের মেয়েরা চুল ছোট করে কেটে, হাফপ্যান্ট পরে ছেলেদের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার জন্য কুস্তির আখড়ায় নামছে, সেই পরিবারের গৃহিণীটি কিন্তু আখেরে অবদমিত গৃহবধূই! স্বামীর মতে সায় দেওয়া ছাড়া, স্বামীর কষ্টে কষ্ট পাওয়া ছাড়া, মেয়েদের সাফল্যে খুশি হওয়া ছাড়া তার আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। এত বিদ্রোহ ঘোষণা করে এভাবে ফের পুরুষতন্ত্রের চেনা খোলসে ঢুকে পড়ায় শুধু এই জায়গায় ‘দঙ্গল’ হতাশ করে!

dangal5_web
যদিও সেই হতাশা সুদে-আসলে পুষিয়ে দেয় গীতা আর ববিতার চরিত্রাভিনেত্রীরা। তাঁদের চরিত্রে শিশুশিল্পী জারিরা-সুহানি নজর কেড়েছেন বিশেষ করে। তাঁরা এতটাই প্রাণবন্ত যে সেই জায়গায় পাসমার্ক তুলতে পারেননি ফতিমা-সানিয়াও! ছবির দ্বিতীয়ার্ধে তাঁরা বড় হয়ে গেলে তাঁদের আনন্দে দর্শক হাসবেন, দুঃখে কাঁদবেন, চোখ ছলছল করে উঠবে ভারতের সোনা জেতার দৃশ্যে। কিন্তু মাথার ভিতর থেকে জারিরা-সুহানিকে দেখার হ্যাংওভার কাটবে না! খুব ছোট চরিত্র হলেও মুগ্ধ করবেন রাজকুমার রাও। বিশেষ করে ভাল লাগবে তাঁর ছেলের চরিত্রে অপরশক্তি খুরানাকে। বোনেদের কাছে কুস্তির আখড়ায় হেরে গিয়েও যার মনে কোনও ক্ষোভ তৈরি হয় না। এরকম পুরুষ প্রতিটা পরিবারে থাকলে ভারতে নারীদের লাঞ্ছনা আজ অনেকটা কম হত, নির্দ্বিধায় বলা যায়!

dangal3_web
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: সেতু শ্রীরামের খুব মসৃণ সিনেম্যাটোগ্রাফিতে ‘দঙ্গল’ এই বছরের মাস্ট ওয়াচ ছবির তালিকায় থাকলেও, চোখকে আরাম দিলেও পা’দুটিকে কিন্তু আরাম দেবে না! ছবি শুরুর আগে একবার উঠে দাঁড়াতে হবে জাতীয় সংগীত বাজলে! ফের উঠে দাঁড়াতে হবে ছবির শেষের দিকে, যখন গীতা সিং ফোগাট সোনা জেতার পর কমনওয়েলথের নিয়ম মেনে ছবির মধ্যে বাজবে জাতীয় সংগীতের সুর! তখনও ফের উঠে দাঁড়াতে হবে! এই ঝক্কিটার জন্য কিন্তু তৈরি থাকবেন ‘দঙ্গল’ দেখতে গেলে!

ছবি: দঙ্গল
পরিচালনা, কাহিনি ও চিত্রনাট্য: নীতেশ তিওয়ারি
সিনেম্যাটোগ্রাফি: সেতু শ্রীরাম
অভিনয়: আমির খান, সাক্ষী তনওয়ার, ফতিমা সানা শেখ, সানিয়া মালহোত্রা, জারিরা ওয়াসিম, সুহানি ভাটনগর, রাজকুমার রাও, অপরশক্তি খুরানা প্রমুখ

৩.৫/৫

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ