সরোজ দরবার: প্রথমত, আজও ঋতুপর্ণ ঘোষকে চাই- বাংলা ছবির স্বার্থে।
দ্বিতীয়ত, আজও ঋতুপর্ণকে চাই- অনুনকরণীয় গদ্যরীতি, বিশেষত জার্নালধর্মী সাহিত্যের জন্য।
তৃতীয়ত, ঋতুপর্ণ ঘোষকে চাই- ছকভাঙা প্রতিবাদের মুদ্রা হিসেবে।
শেষপর্যন্ত ঋতুপর্ণকে চাই, বাঙালির বহুমুখিনতার আপাতত অন্তিম বাতিঘর হিসেবে।
বছর চারেক আগে জীবনের উৎসবে ‘কাট’ বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন পরিচালক। আজ দেখি, তাঁর জন্মদিনে দাঁড়িয়ে বাঙালির ‘চাই’-এর পাল্লা এভাবেই ক্রমাগত ভারি হয়ে চলেছে। মৃত্যু নিছকই এক সমাপ্তিসূচক যতিচিহ্ন। সৃষ্টি ও স্রষ্টার অভিযাত্রা তাতে থামে না। আসলে একজন আদ্যন্ত সৃষ্টিশীল মানুষের উদ্ভাস যখন নতুন সৃষ্টিতে, তখন তিনিই আমাদের হাত ধরে নিয়ে যান তাঁর গন্তব্যে। কিন্তু তারপরের যাত্রা আমাদের নিজস্ব। স্রষ্টা সেখানে স্থির। হয়তো চেনা কোনও অলৌকিক সোফায় বসে আছেন। আর আমাদের বিস্তার তখন তাঁর সৃষ্টির পরিধি থেকে কেন্দ্রাভিমুখে। তাঁকে চেনা তাঁর সৃষ্টির সংসারে ঢুকে পড়েই। আমরা দেখি সে সবের ভিতরেই স্রষ্টার হাত বাড়ানো আছে। এবার সে হাত খুঁজে ধরার পালা আমাদেরই।
এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম তিন মিনিট কল্পনাতীত। বিজ্ঞান চেষ্টা করেছে সে রহস্য উন্মোচনের। কিন্তু এই প্রথম তিন মিনিটের রহস্যের কিনারা পাওয়া বেশ মুশকিল। এই যে ঋতুপর্ণমণ্ডল, যার মধ্যে একদা নিয়ত আবর্তিত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির ছোট ছোট গ্রহ ও উপগ্রহগুলি, তারও সূচনালগ্ন রহস্যাবৃত বলেই আমার ধারণা। তাঁকে আমরা প্রথমত ও প্রধানত একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেই ভেবে নিই। তার থেকে বড় ভ্রান্তি বোধহয় আর কিছু নেই। তবু সেই ফাঁদে পা দিলেই ঋতুপর্ণ প্রকল্পের একটা দিশা পাওয়া যাবে। এই চলচ্চিত্রের আকর্ষণেই তিনি তাঁর দিকে টেনে নেন যে কাউকে। তাপর বিরাট এক মেধা গহ্বরের অনতিক্রম্য আকর্ষণে ক্রমাগত নিমজ্জন। মেধা-মননের ধারে, যুক্তির তীব্রতায় তিনি ভেঙে তছনছ করে দেন চেনা চিন্তার ছক। অথচ বিরোধাভাষ এমনই যে, তাঁর সাজানো সেটে ফুলদানির গায়ে একবিন্দু ধুলো পর্যন্ত লাগে না। সবকিছু এত সাজানো, গুছানো, এত প্রমিত যে একটু খটকা লাগে, এই সব সত্যি তো! সত্যি না হয়ে কোনও উপায় নেই। কিন্তু আজ খানিকটা হলেও বোঝা যায় নান্দনিকতার এই সুতীব্র উদযাপন আসলে একধরনের মায়াবিভ্রম। বাঙালি তাতে পা দিয়েছে। এবং ঋতুপর্ণপ্রকল্পের একটি উদ্দেশ্য তখনই সাধিত হয়েছে। কোন বঞ্চনা, কোন অভিমান থেকে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল আমার জানা নেই। মহাবিশ্বের গোড়ার মতো হয়তো ওই প্রথম তিন মিনিট সমাজবিজ্ঞানের ব্যাখ্যারহিত। অথবা ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু এই প্রকল্পের মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে আমরা দেখব, ক্রমাগত রাজার মতো টানছেন তিনি। কখনও তাঁর গদ্য। কখনও তাঁর ব্রজবুলি ভাষায় লেখা গান। কখনও তাঁর বিজ্ঞাপন। কখনও টেলিভিশন প্রোগ্রামের ছকভাঙা ভাবনা। আসলে মেধার এই সেলিব্রেশনে তিনি শেষমেশ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন, ঋতুপর্ণ ঘোষ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর অনুকৃতিও অসম্ভব প্রায়। এইটাই বোধহয় দেখিয়ে দেওয়া তাঁর অভিপ্রায় ছিল। তাই নিজেকে কখনও গোপন করেননি। সৃষ্টিশীলতার প্রকাশের মতো নিজের যৌনতা, সে সংক্রান্ত চিন্তাভাবনাও। আসলে এই প্রকাশ একধরনের অতিক্রমণের পথও করে দেয়। আমবাঙালির অহেতুক কৌতূহলের, অনর্থক চর্চাকে পিছু ফেলে তিনি এতটা এগিয়ে যান, তাঁর স্বাতন্ত্র, বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে, একটা সময় বিস্মিত হতে হয়। এই বিস্ময়বোধক যতিচিহ্নটিই তিনি বোধহয মুচকি হেসে তুলে রেখেছেন তাঁর একান্ত সিন্দুকে।
তাঁর সিনেমা নিয়ে চলচ্চিত্র বিশারদরা বিশেষ আলোচনা করেছেন। হ্যাঁ, তিনি নিজের মতো করে গল্পই বলে চলেছেল। সাধারণভাবে অবশ্য বলা হয় যে, তিনি নতুন ধারার সিনেমার ভগীরথ। কিন্তু আমার মনে হয় বাংলা ছবির ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা অনেকটাই আরণির মতোই। ছবিতে গল্প বলার যে চিরন্তন ধারা, তাতে ঢুকে পড়ছিল বেনোজল। ঋতুপর্ণ আলের ধারে পেতে দিয়েছিলেন তার মেধা। ফলত অতীতে-বর্তমানে দেখা হয়ে এক নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল বইকি। সিনেমা শিল্প যে ভাঙচুর প্রত্যাশা করে ফর্মে, তা হয়তো তাঁর কাজে কমই মিলবে। তবু অস্বস্তির চপেটাঘাত না থাকুক, একটা তেহাই তিনি ছবিতে রাখতেন, যেটুকু না হলে এই অস্বস্তির নকশাটুকুও অসম্পূর্ণ থাকে। কিছু ব্যতিক্রম মাথায় রেখেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল, বাংলা ছবির সংসারে আবার দশচক্রে ভগবান ভূত। এই পরিস্থিতে আমাদের মন দেওয়া উচিত ওই ঋতুপর্ণ-প্রকল্পে। কী করে এই এলোমেলো জল ঢোকা বন্ধ হয়, তা তো তিনি দেখিয়েছেন। আমরা আজ তা দেখতেই বা পাই না কেন!
দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষা যখন এখন ভালবাসাহীন এক পৃথিবীর বাসিন্দা, সেখানে ঋতুপর্ণর গদ্যচর্চার দিকেও আমাদের নজর ঘোরানো উচিত। ছবির সংলাপে বাঙালির মুখের প্রমিত ভাষাটাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। যে গদ্য তিনি লিখতেন, তা খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, সাহিত্যকে তিনি আলাদা করে কখনও ভাবেননি। বরং অখণ্ড সংস্কৃতির একটা অংশ হিসেবেই আত্মীকরণ করেছিলেন। এই বোধ আজ ভীষণ জরুরি। এই সেদিনও এমন বাঙালি ছিলেন যাঁরা বহুমুখী কাজে নিজেদের ব্যক্ত করতে পারেন। যিনি নাটক করেন, তাঁর লেখনিতে কবিতাও ধরা দেয়। যিনি সিনেমা পরিচালনা করেন, তিনি ভৈরবীতে গানও বাঁধতে পারতেন। অভিনয় যাঁর পেশা, তিনিও হারমোনিয়ামের বেলো টানতেও পারতেন। আসলে এগুলো তো কোনও আলাদা বিভাগ নয়। প্রতিভা প্রদর্শনের রিয়ালিটি শো নয়। সংস্কৃতির অবিছিন্ন ধারার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে পারলে, এই অভিজ্ঞান মুদ্রা আমাদের হাতে আসে। বলা বাহুল্য তা হারিয়েই একরৈখিক ও এককেন্দ্রিক যাত্রা এখন আমাদের। এই বিক্ষিপ্ত সময়ে তাই ঋতুপর্ণ চর্চা তাই একান্ত জরুরি। বহিমুখিনতার ধারা ক্ষীণ হলেই সংস্কৃতিতে পলি পড়ে। বাঙালির অন্তত তা কাঙ্খিত নয়। অতিক্রমের পথ মেলে অতীতে তাকালেই।
ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্মদিন তাই শুধু স্রেফ নস্ট্যালজিয়ায় গা সেঁকা নয়। বরং এই চর্চার দহন থেকে বহুমুখিনতার উৎসবে পৌঁছলেই হয়তো তাঁকে জন্মদিনে একটা ফুল হাতে তুলে দেওয়া যাবে।