Advertisement
Advertisement

Breaking News

মনের অন্ধকারে আলো ফেলা-‘ক্ষত’

নির্মল ধর: Advertisement আমার ভালবাসার জন্ম-মৃত্যু হয় না৷ আমার ভালবাসা শরীরে হিরের গয়না৷ সৃষ্টি-স্থিতিকে আমিই শাসন করি৷ কেউ কেউ বাঁধে ঘর, কেউ কেউ বেঘর৷ আমার কাছে সেক্স একটা অ্যাডভেঞ্চার৷ ঝড়-অশ্লেষা টর্নেডো আমার মতো ভয়ংকর হতে পারে না৷ আমি সেক্সকে এক্সপ্লোর করি৷ আমি শব্দ নয়, দেহ নিয়ে খেলতে চাই৷ জঙ্গল, মদ মেয়েদের শরীর….পোড়া পোড়া গন্ধ৷ ইউ […]

Throwing light on mind's darkness-'KHAWTO'
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:July 28, 2016 3:56 pm
  • Updated:July 28, 2016 3:58 pm

নির্মল ধর:

আমার ভালবাসার জন্ম-মৃত্যু হয় না৷
আমার ভালবাসা শরীরে হিরের গয়না৷
সৃষ্টি-স্থিতিকে আমিই শাসন করি৷
কেউ কেউ বাঁধে ঘর, কেউ কেউ বেঘর৷
আমার কাছে সেক্স একটা অ্যাডভেঞ্চার৷
ঝড়-অশ্লেষা টর্নেডো আমার
মতো ভয়ংকর হতে পারে না৷
আমি সেক্সকে এক্সপ্লোর করি৷
আমি শব্দ নয়,
দেহ নিয়ে খেলতে চাই৷
জঙ্গল, মদ মেয়েদের
শরীর….পোড়া
পোড়া গন্ধ৷
ইউ ক্যান কাট অল দ্য ফ্লাওয়ার্স, বাট ইউ
কাণ্ট কাট দ্য কামিং অফ স্প্রিং৷
আমি যেটা লিখি লোকে সেটা করে৷

Advertisement

এমন সব দুঃসাহসী সংলাপ বারুদে ঠাসা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘ক্ষত’৷ সত্যিই এমন ডার্ক নায়ক চরিত্র বাংলা সিনেমায় বড় একটা দেখা যায়নি৷ সাম্প্রতিক অতীতের দু-একজন বাঙালি লেখক এমনটি ছিলেন সেটা জানি৷ নিশ্চিতভাবেই কমলেশ্বরবাবুর কলমের অনুপ্রাণ তাঁরাই৷ না হলেও কিছু যায় আসে না৷ কারণ লেখক নির্বেদ লাহিড়ীকে (প্রসেনজিৎ) তিনি সাদা-কালোর মিশেলে সুন্দর এঁকেছেন৷
মহিলা-সঙ্গ তাঁর পছন্দ৷ তা নিয়ে কোনও লুকোচুরি নেই৷ যে পত্রিকা অফিসে তিনি চাকরি করেন (?) সেখানে মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর রোজকার ব্যবহারই বুঝিয়ে দেয় সেটা৷ কোনও অছিলা ছাড়াই তাঁদের শরীর ছোঁয়ার ছোঁকছোঁক বাইটুকুই যথেষ্ট৷ নির্বেদ সুযোগসন্ধানী, মদ্যপ, ডিবচ, সিনিক্যাল এবং তা নিয়ে তাঁর কোনও ভান-ভণিতা নেই৷ অথচ স্ত্রী সৃজিতাকেও (রাইমা) সত্যিই ভালবাসেন নির্বেদ৷ আবার চাকরি-খোয়ানো অলোকেশের (রাহুল) তরুণী স্ত্রী অন্তরাকে (পাওলি) সম্ভোগ করাটা তাঁর সত্যিই এক যৌন অ্যাডভেঞ্চার৷ কারণ স্বামীকে সে একটা চাকরি পাইয়ে দিয়েছে৷ সুতরাং অন্তরার শরীর সে দাবি করতেই পারে৷ উপরন্তু তাঁকে পার্টিতে প্রথম দৃষ্টি বিনিময় থেকেই তো নির্বেদের লিবিডো যথেষ্ট সজাগ হয়েছিল৷ সেটা বুঝিয়ে দেন পরিচালক৷ সুযোগ এসে গেল স্বামীকে চাকরি দিয়ে৷ তবে হ্যাঁ, দু-তিনদিনের শরীরী মিলনের পর অন্তরার দিক থেকে নির্বেদকে ভালবেসে ফেলার ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ কারণ শেয়ার বাজারের দালাল অলোকেশ নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতার বাঙালি৷ লোরকা বা সাহিত্য নিয়ে তার এতটুকু চুলকানিও নেই৷ তাই একটা প্রশ্ন ওঠে–তাহলে সাহিত্যপ্রেমী সংস্কৃতিমনা অন্তরা বিয়ে করেছিল কেন তাঁকে? অন্তরার নির্বেদের সাহিত্যভক্তি কি তাহলে শরীরী প্রেমে বদলে গিয়েছিল?

Advertisement

কমলেশ্বরের চিত্রনাট্য মাকড়সার জালের মতো বিছানো৷ ছবি শুরু হয় দুই প্রেমিক-প্রেমিকা ঋষভ-সোহাগ (রণদীপ-ত্রিধা)কে নিয়ে৷ নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে দু’জনে একটু ‘একলা’ থাকার জন্য বাড়িতে বহরমপুর যাওয়ার চুপকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওড়িশার সমুদ্রসৈকতে৷ সেখানেই আচম্বিতে আলাপ কলকাতা থেকে বিশ বছর আগে পালিয়ে যাওয়া লেখক নির্বেদ লাহিড়ীর সঙ্গে৷ এই দু’জনকেই আগ্রহী শ্রোতা ও পানাহারের উপযুক্ত সঙ্গী হিসাবে পেয়ে নির্বেদ নিজের অতীতের পাতা ওল্টাতে থাকেন৷ ফলে চিত্রনাট্যে ‘সময়’ বারবার বর্তমানের বেড়া ডিঙিয়েছে৷ পরিচালক সেই ডিঙোনো পর্বগুলো বেশ বিচক্ষণ ভঙ্গিতেই করেছেন৷ ওদের এই কথোপকথনের মধ্যেই বেশ মসৃণভাবেই মিশে যায় নির্বেদের অতীত কাহিনি৷

ভাল লাগে নির্বেদকে একজন ভাল-মন্দয় মেশানো রক্তমাংসের স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে পরিচালকের উপস্থাপনার কাজটি৷ তিনি ‘বিচারক’-এর আসনে বসেন না৷ একজন মানুষকে ‘বিচার’ করার দায়িত্ব পরিচালকের নয়ও৷ নির্বেদ এমন একটা মানুষ, যিনি প্রথাগত বা চলতি সামাজিক ন্যায়নীতির জালে নিজেকে বেঁধে রাখতে রাজি নন৷ তিনি নিজেই তাঁর জীবনের ‘যাপন’ কর্মটি ঠিক করেন৷ স্ত্রী সৃজিতাকে অবশ্যই নির্বেদ ভালবাসেন৷ আর অন্তরাকে নিজের করে পাওয়ার প্রয়োজনটা অন্যরকম৷ যদিও অন্তরার দিক থেকে প্রেমের উন্মেষ ঘটতেই যাচ্ছিল, নির্বেদের নয়৷ যে কারণে বাড়ি না ফেরা সৃজিতাকে পাগলের মতো খোঁজেন নির্বেদ৷ খুঁজে পাওয়ার পর সাময়িক অনুশোচনায় এবং পরিস্থিতির চাপে নিজের অপরাধ স্বীকারও করেন৷ কিন্তু স্ট্রং লিবিডো নিয়ে নির্বেদ আবার অন্তরার শরীরে ঝাঁপ দিলে আরও একটি, একটি নয় দু-দু’টি বিপর্যয় ঘটে যায়৷ অলোকেশের আত্মহনন এবং অন্তরার মানসিক ভারসাম্য হারানো৷

Cn3v8QHUsAEDdPd

এ পর্যন্ত গল্প এবং চিত্রনাট্য গড়ে উঠেছে ঠিকঠাক৷ কিন্তু অলোকেশের আত্মহত্যা নিয়ে সৃজিতার স্পষ্ট অভিযোগের তির ছিল নির্বেদের দিকেই৷ তদন্তকারী পুলিশের সামনেই তাঁকে ‘খুনি’ বলে সৃজিতা৷ সুতরাং প্রশ্ন থাকে কোনও পুলিশি তদন্ত বা মামলা হল না কেন? জনপ্রিয় লেখক নির্বেদ লাহিড়ী বিশ বছর পাশের রাজ্য ওড়িশায় একটি সুদৃশ্য বাংলোয় এমন বিলাসী জীবনযাপন করেন কীভাবে? প্রশ্ন থাকে ছবির অন্ত নিয়েও৷ নির্বেদের খুন বা আত্মহনন সত্যিই কি প্রয়োজন ছিল? এতো সেই আপ্তবাক্যকেই সত্য প্রমাণ করল–‘পাপের বেতন মৃত্যু’ নয়কি? আরও কিছু লুজ এন্ডস আছে চিত্রনাট্যে৷ তবে সেগুলোর অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায় কমলেশ্বরবাবুর পরিপাটি পরিচালনায়৷ শুরু থেকেই শট টেকিং-এ, ফ্রেমের কম্পোজিশনে তিনি ‘আর্ট’-এর পোশাক চড়িয়ে দেন৷ রক্ত, শুকনো গাছের শাখা, ফেনিল সমুদ্র, নির্জন বালুকাবেলা, পেনের কালি, শান্ত জঙ্গল–সত্যিই চরিত্র হয়ে ওঠে এক সময়৷ বিশেষ করে মন্তাজের কিছু জায়গা অ্যাঁলা রেঁনের ‘হিরোশিমা মাই লাভ’কে মনে করিয়ে দেয়৷ ইমেজ নিয়ে সিনেমাটিক খেলাটি জমিয়ে দেন তিনি৷ ‘ক্ষত’-র গায়ে এগুলো সত্যিই অলংকার৷ সৌমিক হালদারের ক্যামেরা তো বটেই, বিনীত রঞ্জন মৈত্রর ‘আবহ’-ও ছবিটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়৷ অনুপম রায়ের লেখা-সুর-গানে চরিত্রের সংঘাত ও অন্তর্দ্বন্দ্বকে গভীরতর করে৷ বিশেষ করে ‘বড় এলোমেলো হয়ে আসে সব’ গানটি৷

শিল্পীদের অভিনয়ও কমলেশ্বরের হাতে সুন্দর ফুটেছে৷ প্রসেনজিত্‍ হয়েছেন লেখক নির্বেদ৷ দু’টি বয়সের ব্যবধান বা পার্থক্যটিও তিনি অভিনয়ে আনতে পেরেছেন৷ তাঁকে বেশি ভাল লাগে তরুণ বয়সে৷ সহকর্মীদের সঙ্গে ছিনালি করার পর্বগুলো সুন্দর৷ আবার স্ত্রী সৃজিতার সঙ্গে ঝগড়ার সময় নিজের দ্বিচারিতাকে ডিফেন্ড করার সময়ও তিনি বেশ পাওয়ারফুল৷ বয়স্ক প্রসেনজিত্‍ অনেক বেশি শান্ত, কাঁচাপাকা দাড়িতে বেশ ব্যক্তিত্বময়, অভিনয়েও চাপা গলায় অনেকটাই স্বাভাবিক৷ অন্তরার চরিত্রে পাওলি দাম সম্ভবত এ পর্যন্ত তাঁর সেরা অভিনয়টি দিলেন৷ অন্তরার আত্মসমর্পণের প্রাথমিক দ্বিধা ও পরে নির্বেদকে ভালবাসা জানানোর সময় পাওলির আর্তি সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়৷ রাইমা সেন হয়েছেন স্ত্রী সৃজিতা৷ বেচারি এত সুন্দরী যে ও ঝগড়়া করবে এটা মানাই যায় না৷ কিন্তু ফ্লেয়ার-আপ মুহূর্তে অভিনয় করেছে দুর্দান্ত৷ এটা জারি রাখো ডলু৷ ঋষভের চরিত্রে রণদীপ বসুর অভিনয় খুবই ন্যাচারাল, নাটকীয় মুহূর্তে একটু জড়সড়৷ ত্রিধা হয়েছেন সোহাগ৷ আলগা গ্ল্যামার সুন্দরী ত্রিধা৷ কপট অভিমান, আনন্দ, দুঃখ প্রকাশে এমনকী খুনসুটি প্রকাশেও মুখের মাসলগুলো আরও সচল হওয়া দরকার৷ আর অলোকেশের চরিত্রে রাহুল ফাটাফাটি এককথায়৷

কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বেশ দুঃসাহসী হয়েই বানিয়েছেন ‘ক্ষত’৷ এমন বহু বহু ক্ষত আমাদের এখনকার সমাজে সচল৷ কিন্তু নির্বেদের মতো প্রকাশের বুকের পাটা নেই৷ মানব চরিত্রের এই অন্ধকারময় দিকটায় আলো ফেলার জন্য ধন্যবাদ তাঁকে৷

পরিচালনা: কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

প্রযোজনা: শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস

অভিনয়ে: প্রসেনজিত্‍ চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন, পাওলি দাম, রাহুল, রণদীপ বসু, ত্রিধা চৌধুরি

রেটিং: ৩.৫/৫

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ