Advertisement
Advertisement
Prawn Farming

অণুজীবেই জব্দ জীবাণু, পরিবেশবান্ধব মাছ ও চিংড়ি চাষে জরুরি পুকুর প্রস্তুতিও

ভাল পুকুর প্রস্তুতি বাড়ায় মাছের উৎপাদন।

Here are some important tips about Prawn Farming | Sangbad Pratidin
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:July 17, 2022 2:01 pm
  • Updated:July 17, 2022 2:42 pm

মাছ ও চিংড়ির রোগজীবাণু দমনে নানাবিধ অ‌্যান্টিবায়োটিকের (জীবাণুনাশক) যথেচ্ছ ব‌্যবহার এ শিল্পকে ক্রমশ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ধারাবাহিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে মাছ চাষের জন‌্য পরিবেশ বান্ধব চাষ পদ্ধতি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ও বিদ‌্যমান রোগের ঝুঁকি কমাতে উপকারী অণুজীব বা প্রোবায়োটিকের ব‌্যবহার একটি উদীয়মান প্রযুক্তি। লিখেছেন রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শস্য শ‍্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (মৎস্য চাষ) ড. স্বাগত ঘোষ। শেষ পর্ব। 

প্রোবায়োটিক ব‌্যবহার করে মাছ ও চিংড়ি চাষ ব‌্যবস্থাপনা ও পুকুর প্রস্তুতি :

Advertisement

মাছ বা চিংড়ি চাষে (Prawn Farming) ভাল উৎপাদন প্রাপ্তির জন‌্য পুকুর প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, যা একাধিক ব‌্যবস্থাপনার সমন্বয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। নীচে ব‌্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ‌্য বিষয়াদি তুলে ধরা হল:

Advertisement

পুকুর শুকিয়ে তলার অতিরিক্ত পচা কাদা অপসারণ, তলা শুকিয়ে জীবাণুমুক্ত করা, তলা সমতল করা ও পাড় মেরামত করা। পুকুরের জল প্রবেশ ও নির্গমণ পথে ছাঁকনি স্থাপন করে রাক্ষুসে বা অবাঞ্ছিত মাছ/প্রাণীর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা। পুকুরের চারিদিকে বেড়া বা ঘেরা দেওয়া যাতে রাক্ষুসে অবাঞ্ছিত মাছ/প্রাণীর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা-সহ অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন‌্যা ও চুরির ক্ষতি থেকে মাছ বা চিংড়ি রক্ষা করা যায়। সব ধরনের আগাছা (ভাসমান নিমজ্জিত, লতানো ইত‌্যাদি) দূরীকরণ ও পাড় পরিষ্কার করা। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতার জন‌্য ২০-২৫ গ্রাম রোটেনন পাউডার (Rotenone Powder) প্রয়োগ করে রাক্ষুসে বা অবাঞ্ছিত মাছ/প্রাণী দূর করা। দোআঁশ মাটির নতুন পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে ও পুরনো পুকুরে ২ কেজি হারে পোড়াচুন বা কলিচুন (CaO) ছিটিয়ে প্রয়োগ করা। চুন প্রয়োগের পরে মাটি কেবল ভিজে যায় এমন অল্প পরিমাণে জল প্রবেশ করিয়ে প্রয়োগকৃত চুন দ্বারা মাটি শোধন করা। নতুন পুকুরের উর্বরতা বৃদ্ধির জন‌্য প্রতি শতাংশে ৮-১০ কেজি হারে কম্পোস্ট প্রয়োগ করতে হয়।পুকুরের আয়তন অনুযায়ী মাটিতে ব‌্যবহারযোগ‌্য প্রোবায়োটিক (Probiotic) পরিমাণ মতো প্রয়োগ করা যায়। যেমন, মাটিতে ব‌্যবহারযোগ‌্য সুপার পি-এস প্রোবায়োটিক প্রতি হেক্টরে ১৫ লিটার হারে ৭.৫ কেজি বালির সঙ্গে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহের প্রথম দিন প্রয়োগ করতে হয়। পুকুরে প্রয়োজনমতো (১.৫-২ মিটার) জল প্রবেশ করিয়ে প্রাকৃতিক খাদ‌্য উৎপাদনের জন‌্য প্রতি শতাংশে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০-৭৫ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা যায়। অবশ‌্য টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব‌্যবহার করলে ইউরিয়ার প্রয়োগ-মাত্রা অর্ধেক হবে। এসময় প্রয়োজনে প্রাকৃতিক খাদ‌্য উৎপাদনে সহায়ক প্রোবায়োটিক (যেমন : অ‌্যাকোয়া ফটো) ব‌্যবহার করা যেতে পারে।

[আরও পড়ুন: অণুজীবেই জব্দ জীবাণু, জেনে নিন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে মাছ ও চিংড়ি চাষের উপায়

পোনা বা পিএল লালন:

পালন মাছের ছোট পোনা বা চিংড়ির পিএল সরাসরি মজুত ছাড়া ঠিক নয়। কমপক্ষে দেড়-দুই মাস নিবিড় পরিচর্যায় রেখে লালন-পালন করে মাছ বা চিংড়ি বা চিংড়ি মজুত পুকুরে মজুত করা উচিত। নার্সারি পুকুরে শতাংশ প্রতি ১০০০-২০০০ টিপিএল মজুত করা যায়। এই সময় মাটি, জলে এবং খাদ্যের সঙ্গে ব‌্যবহারযোগ‌্য প্রোবায়োটিক প‌্যাকেটে বর্ণিত ব‌্যবহারবিধি অনুসরণে প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ‌্য, গবেষণাকালে মাটিতে ব‌্যবহারযোগ‌্য সুপার পি-এস পূর্ববর্ণিত নিয়মানুযায়ী ১৫ লিটার/হেক্টর/সপ্তাহে ১ দিন ৭.৫ কেজি বালির সঙ্গে মিশিয়ে এবং প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ব‌্যবহারযোগ‌্য ৫ গ্রাম আন্ত্রিক/জাইমেটিন প্রোবায়োটিক ২০ গ্রাম মিউটাজেন বাইন্ডার সহযোগে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহের প্রথম ৪ দিন প্রয়োগ করা হয়েছে। পোনা বা পিএল মজুত পুকুরের ধরন, চাষের সময়কাল, পোনার খাদ‌্য, খাদ‌্যাভ‌্যাস, চাষ ব‌্যবস্থাপনায় চাষির দক্ষতা, বিনিয়োগের ইচ্ছা ও সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে পোনার মজুত ঘনত্ব নির্ধারণ করতে হয়। গলদা চিংড়ির একক চাষের ক্ষেত্রে শতাংশ প্রতি ৮০-১২০টি জুভেনাইল অতিরিক্ত প্রাকৃতিক খাদ‌্য নিয়ন্ত্রণের জন‌্য গলদা চিংড়ির সঙ্গে প্রতি শতাংশে ৫-১০টি রুই জাতীয় মাছ মজুত করা যায়। মজুত পুকুরেও লালন পুকুরের মতো প্রোবায়োটিক ব‌্যবহার করতে হবে। গবেষণাকালে মজুতের পর থেকে সম্পূর্ণ চাষকালে পূর্ববর্ণিত একই হারে সুপার পিএস ও আন্ত্রিক/জাইমেটিন প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়েছে। খাদ‌্য প্রয়োগমাছ ও চিংড়ির দ্রুত বৃদ্ধির জন‌্য তাদের পুষ্টি চাহিদার আলোকে নিয়মিত পরিমাণমতো খাদ‌্য প্রয়োগ করা অত‌্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চিংড়ি নার্সারির ক্ষেত্রে প্রতি হাজার পিএল:

এর জন‌্য প্রথম সপ্তাহে ২০ গ্রাম, দ্বিতীয় সপ্তাহে ৪০ গ্রাম, তৃতীয় সপ্তাহে ৬০ গ্রাম, চতুর্থ সপ্তাহে ৮০ গ্রাম, স্টার্টার ফিড প্রয়োগ করা উচিত। চতুর্থ সপ্তাহ পর থেকে চিংড়ির দেহের গড় ওজনের ১০-১৫% হারে সম্পূরক খাবার দেওয়া, দুই মাস লালন শেষে জুভেনাইল মজুত করার পর চিংড়ির দেহ ওজনের ১০% হারে সম্পূরক খাবার দেওয়া এবং দৈহিক ওজন ২৫-৩০ গ্রাম হলে ৫% হারে ৪০ গ্রাম বা তার বেশি হলে ৩% এবং শীতকালে ডিম দেওয়ার পর খাদ‌্য চাহিদা কম থাকে বলে ২% হারে বা প্রয়োজনে সাময়িকভাবে কিছুদিনের জন‌্য খাবার দেওয়া বন্ধ রাখা যেতে পারে। প্রতিদিনের মোট খাবারকে দুই ভাগ করে সকালে ও সন্ধ‌্যায় একবার করে মোট ২ বার ছিটিয়ে দিতে হয়। চিংড়ির জন‌্য পিলেট জাতীয় শুকনো খাবার ব‌্যবহার করাই উত্তম। লালন পুকুরে প্রয়োগকৃত খাদ্যে ৩৫% এবং মজুত পুকুরে খাদ্যে ৩০-৩২% প্রোটিন থাকা উচিত। খাদ‌্য পরীক্ষণ ট্রে ব‌্যবহার করে খাদ্যের চাহিদা ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করলে খাদ‌্য বাবদ ব‌্যয় সংকোচন ও পরিবেশ ভাল রাখা যায়। খাদ‌্য প্রয়োগের সময় খাদ্যে ব‌্যবহারযোগ‌্য প্রোবায়োটিক পরিমাণমতো প্রয়োগ করতে হয়। গবেষণাকালে প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ব‌্যবহারযোগ‌্য ৫ গ্রাম জাইমেটিক/আন্ত্রিক প্রোবায়োটিক ২০ গ্রাম মিউটাজেন বাইন্ডার সহযোগে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহের প্রথম ৪ দিন প্রয়োগ করতে হবে।

[আরও পড়ুন: অণুজীবেই জব্দ জীবাণু, মাছ ও চিংড়ি চাষে জরুরি নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার]

মজুত পরবর্তী পরিচর্যা ও ব‌্যবস্থাপনা :

চিংড়ির দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ও রোগজীবাণু হতে মুক্ত রাখতে জলের গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় রাখা অত‌্যন্ত জরুরি। জলের গুণাগুণ ঠিক রাখতে প্রয়োজনে চুন (১২৫ কেজি/হেক্টর) প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত দৈহিক বৃদ্ধি ও স্বাস্থ‌্য পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। সময়মতো ও পরিমাণমতো খাবার দেওয়া এবং জলের গুণগত মান সঠিক রাখতে পারলে কাঙ্ক্ষিত ফলন আশা করা যায়।চিংড়ি আহরণ ও বাজারজাতকরণ :জুভেনাইল চিংড়ি মজুতের ৫-৬ মাস পর দেহের ওজন ৬০ গ্রাম বা তার বেশি হলে সেগুলি আহরণ করে বাজারজাত করা যেতে পারে। আংশিক আহরণের জন‌্য ঝাঁকি জাল ও বিশেষ ধরনের বাঁশের চাই ব‌্যবহার করা যায়। চাষকাল (৮-১০) মাস) শেষে একবারে সব চিংড়ি আহরণ করার জন‌্য পুকুর শুকিয়ে নেওয়া ভাল। আহরিত চিংড়ি পরিষ্কার জলে ধুয়ে বরফ-জলে (প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ১০-১৫ মিনিট রেখে আকার অনুযায়ী পৃথক করে জীবাণুমুক্ত প্লাস্টিকের ঝুড়িতে পরিমিত বরফ-সহ ভরে ছায়াযুক্ত যানবাহনে দ্রুত বাজারজাত করতে হবে। খামারের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চিংড়ির মাথা বিচ্ছিন্ন করা একেবারেই ঠিক নয়। আহরণের পর পুকুর প্রস্তুত করে পুনরায় চাষের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

সাম্প্রতিক একটি পরীক্ষামূলক প্রদর্শন, পুকুর (OFT) থেকে আয় ব‌্যয়ের হিসাব:

শস‌্য শ‌্যামলা কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের পরীক্ষামূলক প্রদর্শন পুকুরে গলদা চিংড়ি পিএল দুই মাস লালনপালন করে প্রতি শতাংশে ৭৫-৮০টি গলদা জুভেনাইল মজুত করে ৬-৭ মাস ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চাষ করা হয়। এর ফলে প্রোবায়োটিকবিহীন চাষে হেক্টর প্রতি প্রায় ৭০০ কেজি প্রোবায়োটিক ব‌্যবহার করায় হেক্টর প্রতি প্রায় ৯০০-৯২০ কেজি গলদা চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রোবায়োটিকবিহীন গলদা চাষে প্রতি হেক্টরে ব‌্যয় প্রায় ২,০০,০০০ টাকা, নিট আয় প্রায় ১,৩০,০০০ টাকা। অন‌্যদিকে প্রোবায়োটিকযুক্ত গলদা চাষে হেক্টর প্রতি প্রোবায়োটিক বাবদ ব‌্যয় প্রায় ৫০,০০০ টাকা ও অন‌্যান‌্য ব‌্যয় নিয়ে সর্বমোট ব‌্যয় প্রায় ২,৫৫,০০০ টাকা, নিট আয় প্রায় ২,২৫,০০০ টাকা। চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রোবায়োটিক ব‌্যবহার করে একই ব‌্যবস্থাপনায় গলদা চাষ করে হেক্টর প্রতি ২৪০-২৫০ কেজি গলদা চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি করে নিট প্রায় ৮০,০০০ টাকা বেশি আয় করা সম্ভব।দেশের মাছ ও চিংড়ি শিল্পকে আরও মজবুত ও পরিবেশ বান্ধব করতে সম্ভাবনার অপার দিগন্ত খুলে দিতে পারে প্রোবায়োটিক। প্রোবায়োটিক ব‌্যবহার করে ক্ষতিকারক ভাইরাস ও ব‌্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ ও বিভিন্ন রোগজীবাণুর প্রকোপ থেকে সুরক্ষা দেওয়া গেলে চিংড়ি চাষেই রুপোলি বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। অ‌্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকের পরিবর্তে উপকারী অণুজীব ব‌্যবহার করে জৈবিকভাবে চাষ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের চিংড়ির গুণগত মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি গ্রাহকদের নিকট গ্রহণযোগ‌্যতা ও মূল‌্য উভয়ই বাড়বে।  আমাদের দেশের গলদা চিংড়ির অন্ত্রে এবং এই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা উপকারী অণুজীবগুলির সাহায্যে বাণিজ্যিকভাবে প্রোবায়োটিক তৈরি করা গেলে উৎপাদন ব‌্যয় যে আরও কমবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই জন‌্য আরও গবেষণা/পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ