Advertisement
Advertisement

Breaking News

sweet potato

মিষ্টি আলু চাষে তিনগুণ লাভ, কীভাবে মিলবে সুফল? জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা

মিষ্টি আলু চাষ কিন্তু বেশ লাভজনক।

Nutritious sweet potato showing new path to farmers | Sangbad Pratidin
Published by: Akash Misra
  • Posted:November 23, 2022 8:26 pm
  • Updated:November 23, 2022 8:26 pm

অসংখ্য পুষ্টিগুণে ভরপুর মিষ্টি আলু। সেই কারণে এটিকে সুপার ফুড নামে ডাকা হয়। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আমেরিকা, আফ্রিকা সহ প্রায় সব নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেই এই মিষ্টি আলুর চাষ ভাল হয়। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ফসলের মধ্যে না পড়লেও মিষ্টি আলু চাষ কিন্তু বেশ লাভজনক। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্য বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সুস্মিতা মঈ এবং বাপ্পা মণ্ডল। (পড়ুন শেষপর্ব)

বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এই মিষ্টি আলুর চাষ পদ্ধতি নিম্নে আলোচনা করা হল-

Advertisement

উপযুক্ত জমি ও মাটি
মিষ্টি আলু প্রায় সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। তবে দোঁআশ ও বেলে দোআঁশ মাটি মিষ্টি আলু চাষের জন্য ভাল। এছাড়াও জমি সুনিষ্কাশিত ব্যবস্থা যুক্ত হতে হবে। মাটির অম্লতার মান ৬.০ এর মধ্যে হওয়া উচিত।

Advertisement

জাত পরিচিতি
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সাদা রঙের মিষ্টি আলুর উন্নত জাত গুলোর মধ্যে বিধান জগন্নাথ, পুসা সফেদ, কালমেঘ, শ্রীভদ্রা, সম্রাট, শঙ্কর ইত্যাদি। এছাড়াও লাল/কমলা রঙের জাত গুলোর মধ্যে গৌরী, এসটি-১৪ এবং বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমলা সুন্দরী ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়। (সূত্র: সর্ব-ভারতীয় সমন্বিত কন্দ ফসল গবেষণা প্রকল্প, বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)।

[আরও পড়ুন: পুষ্টিগুণে ভরপুর, মিষ্টি আলু চাষই আয়ের দিশা দেখাচ্ছে কৃষকদের ]

চারা রোপণ
কার্তিক মাস (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) মিষ্টি আলু চাষাবাদের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এক একর জমিতে মিষ্টি আলুর চারা বপনের জন্য মিষ্টি আলুর লতা বা কাঁচা বীজ, মিষ্টি আলুর কন্দ প্রয়োজন। কান্ড বা লতা কাটা বপনের জন্য, ১ একর জমিতে ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ মিষ্টি আলুর লতা কাটা বা ৩৫-৪০ কেজি কন্দ প্রয়োজন। লতার মাথা থেকে ১ম ও ২য় খন্ড রোপণ করা উচিত। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি এবং আলু / লতা থেকে আলু / লতার দূরত্ব ৩০ সেমি। সমতল পদ্ধতিতে সারি তৈরি করে লাগাতে হবে যাতে ২-৩ টি গিট মাটির নিচে থাকে।

চারা কাটিং/লতা লাগানো
প্রতি খণ্ড ২৫-৩০ সেমি লম্বা হওয়া উচিত। আগার খণ্ড (অগ্রীয় কুঁড়ি সহ) সবচেয়ে বেশি ফলন দেয়। আগার খণ্ড পাাওয়া গেলে মাঝখানের খণ্ড না লাগানোই উচিত। বেশি বয়স্ক খণ্ড বীজ/কাটিং হিসেবে ব্যবহার বর্জনীয়। মাঝখানের খণ্ড লাগানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে গোড়ার দিক মাটিতে পোঁতা হয়।

সার প্রয়োগ
প্রতি শতকে ইউরিয়া লাগবে ৬০০ গ্রাম, টিএসপি লাগবে ৫০০ গ্রাম, এমওপি প্রয়োজন ৭৩০ গ্রাম এবং গোবর সার লাগবে ৪০ কেজি। গোবর সার, টিএসপি সম্পূর্ণ পরিমাণ এবং ইউরিয়া ও এমওপি. সারের এক চতুর্থাংশ বপনের সময় জমিতে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে বাকি ইউরিয়া এবং এমওপি সার বপনের দুই মাস পর সারির পাশে প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
এটি একটি খরা সহনশীল ফসল, তবে জমির আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। মিষ্টি আলুর ক্ষেত লতা দিয়ে পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।

রোগ প্রতিকার
পাতা, বোঁটা ও কাণ্ডে
দাগ পড়া রোগ
অলটারনারিয়া ব্যাটাটিকোলা নামক ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে।
আক্রান্ত লতা, বিকল্প পোষক ও বায়ুর মাধ্যমে এই রোগ বিস্তার লাভ করে। বৃষ্টি, আর্দ্র ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া এই রোগ বৃদ্ধির সহায়ক। আক্রান্ত পাতার উপর ছত্রাকের বীজ কণা সৃষ্টি হয় এবং পরে বাতাসের মাধ্যমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায়। এই রোগ সাধারণত পুরাতন ও পরিপক্ব পাতায় বেশি দেখা যায়। রোগের আক্রমণে পাতার গায়ে বাদামি রঙের চক্রাকার দাগ দেখা যায় যা গোলাকার সীমারেখা দ্বারা আবৃত থাকে। অনেক দাগ একত্রিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে।

দাগগুলো পুরনো হয়ে গেলে পাতার আক্রান্ত স্থানের টিস্যু ভেঙে যায় ও পাতা ঝরে পড়ে।
দাগ কাণ্ড ও পাতার বোঁটায়ও দেখা যায়, দাগ গুলো বড় হয়ে কাণ্ডকে ঘিরে ফেলে।
রোগের প্রতিকার ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সুস্থ, সবল ও জীবাণু মুক্ত লতা ব্যবহার করতে হবে। জমিতে শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে। পাতায় দাগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন- রোভরাল ৫০ ডাব্লপি) প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম অথবা ডাইফেনাকোনাজল + এ্যাজোক্সিস্ট্রবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি) প্রতি লিটার জলে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।

নরম পচা রোগ
রাইজোপাস নিগ্রিক্যানস নামক ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত টিউবারের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এই রোগের আক্রমণের ফলে আলুতে জল ভেজা দাগ দেখা যায়। এই রোগ হলে আক্রান্ত স্থানের তন্তু খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আক্রান্ত আলু দুই প্রান্ত হতে দ্রুত নরম ও আর্দ্র হয়ে পচে যায়, দুর্গন্ধ বের হয়। আক্রান্ত আলুর উপরিভাগে সাদা মাইসেলিয়ামের পুরু স্তর দেখা যায়। এছাড়া প্যাথোজেনের কালো বর্ণের ফ্রুটিং বডি-ও দেখা যায়।

রোগের প্রতিকার
ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমি হতে টিউবার উত্তোলন, পরিবহন ও সংরক্ষণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে টিউবার আঘাত প্রাপ্ত না হয়। সংরক্ষণের আগে টিউবার ভাল করে কিউরিং করতে হবে। এই রোগ কমানোর জন্য কাটা ও থেঁতলানো টিউবার বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে। আলু গুদামজাত করার পরে সেই ঘরে বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা রাখতে হবে। আলু অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় সংরক্ষণ করতে হবে।
কালচে বা ব্লাক রট
/চারকোল রট রোগ
ম্যাক্রোফোমিনা ফ্যাজিওলিনা / ডিপ্লোডিয়া নাটালেনসিস নামক ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। গাছের পরিত্যক্ত অংশে জীবাণু বেঁচে থাকে এবং বাতাস, জল ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে রোগ ছড়ায়। এই রোগের আক্রমণে গাছ খর্বাকৃতির ও হলুদ রঙের হয়। পরে আক্রান্ত গাছ ধীরে ধীরে কাল হয়ে যায়। গুদামজাত অবস্থায় টিউবারেও এই রোগ দেখা যায়। টিউবারে এই রোগের আক্রমণে কালো দাগ পড়ে। পরবর্তীতে পচন শুরু হয়ে পুরো টিউবারটি পচে নষ্ট হয়ে যায়।

রোগের প্রতিকার
রোগ মুক্ত মিষ্টি আলুর লতা লাগাতে হবে। শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন প্রোভ্যাক্স ২০০ ডাব্লুপি) প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে তার মধ্যে লতা ডুবিয়ে শোধন করে নিয়ে জমিতে লাগাতে হবে। সংরক্ষিত টিউবারকে এই রোগের আক্রমণ হতে রক্ষা করতে টিউবারকে সংরক্ষণের পূর্বে ভালভাবে কিউরিং করে নিতে হবে। এই রোগ কমানের জন্য কাটা, ছেঁড়া ও থেঁতলানো টিউবার বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।
ফসল উঠানোর পর ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-ডাইথেন এম ৪৫) প্রতি লিটার জলে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে টিউবারে স্প্রে করে সংরক্ষণ করতে হবে। পাতা কোঁকড়ানো বা লিফ কার্ল ভাইরাস রোগ লিফ কার্ল ভাইরাসের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। এই রোগ সাদা মাছি পোকার মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগে আলুর পাতা মারাত্মক ভাবে ছোট হয়ে যায়। মিষ্টি আলুর পাতা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে কুঁকড়িয়ে যায়। ফলন মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রোগের প্রতিকার

রোগ মুক্ত লতা লাগাতে হবে। জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সাদা মাছি পোকা দমনের জন্য ডায়াফেনথিউরন গ্রুপের কীটনাশক (যেমন-পেগাসাস ৫০ এসসি) প্রতি লিটার জলে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

পোকা ও প্রতিকার
উইভিল নামক একটি মাত্র পোকা ছাড়া অন্যান্য পোকা গৌণ। পূর্ণ বয়স্ক উইভিল পোকা কন্দ-মূলের ভিতর আঁকা-বাঁকা সুড়ঙ্গ করে ক্ষতি করে থাকে। উইভিল আক্রান্ত কন্দমূল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে মিষ্টি আলু গাছের গোড়ার আলুতে মাটি তুলে দিলে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রান্ত মিষ্টি আলু ভাল আলুর সঙ্গে রাখা যাবে না। সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমনঃ ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০ লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার।

হেক্টর প্রতি ফলন
চারা রোপণের ১২০-১৪০ দিনের ভিতর মিষ্টি আলু তুলে সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত একর প্রতি ফলন হয়ে থাকে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ কুইন্টাল। স্থান ভেদে ফলন কম বেশি হতে পারে। এটা নির্ভর করে জাত বা চাষ পদ্ধতি, মাটির অবস্থা ও আবহাওয়ার উপর। এই সুমিষ্ট ফসল মিষ্টি আলুর চাহিদা অনুযায়ী বর্তমান বাজার দর প্রতি কেজি প্রায় ৩০-৪০ টাকা হয়ে থাকে। এক একর জমিতে মিষ্টি আলু চাষের জন্য প্রায় ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। চাষের খরচ বাদ দেওওয়ার পর প্রায় ৩ গুণ টাকা আয় করতে পারবেন চাষিভাইরা।

মিষ্টি আলু সংরক্ষণ
এই আলু সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অনেকটা গোল আলুর স্থানীয় পদ্ধতির মতোই। ফ্রেস/ক্ষত/কাঁটাহীন আলু সংরক্ষণ করতে হবে। গুদামে রাখার আগে কন্দমূল ছায়ায় বিছিয়ে লতা পাতা দিয়ে কয়েক দিন ঢেকে রাখলে ভাল হয়। প্রায় ৯০-১২০ দিনে মিষ্টি আলু পরিপক্ক পুষ্ট হয়। তখন এর খোসায় আঁচড় দিলে ঘন সাদা দুধের মতো রস বের হয়। এই অবস্থায় বর্ষা আসার আগে লতা কেটে লাঙ্গল/ কোদাল দিয়ে ভাল করে আলু তোলা দরকার। সংরক্ষণের জন্য গোলায় বা মাচায় ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি বালি স্তর বিছিয়ে তার উপর ২৮ থেকে ৩০ ইঞ্চি উঁচু মিষ্টি আলুর স্তর রেখে পুনরায় ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি বালি স্তর দিয়ে ঢেকে দিন। এই ভাবে কয়েক স্তরে মিষ্টি আলুর রাখলে মিষ্টি আলুর উইভিল পোকা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

[আরও পড়ুন: চাষের জমিতে রাসায়নিকের অপব্যবহারে ক্ষতির সম্ভাবনা, মুক্তির পথ দেখাচ্ছে জৈব কৃষি ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ