Advertisement
Advertisement
Harshad Mehta

আঙুল উঠেছিল খোদ প্রধানমন্ত্রীর দিকে! জেনে নিন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্নীতির কাহিনি

এই কাহিনি যেন হার মানায় সিনেমাকেও।

Here is how Harshad Mehta was responsible for one of India's largest stock market scam। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:July 29, 2022 4:55 pm
  • Updated:July 29, 2022 5:24 pm

বিশ্বদীপ দে: আবারও ফিরে ফিরে আসছে তাঁর নাম। আসলে এদেশে যতবারই নতুন নতুন আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে চর্চা হবে, ততবারই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন হর্ষদ মেহতা। ২০০১ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই মারা গিয়েছিলেন ‘দ্য বিগ বুল’ (The Big Bull)। তবু মৃত্যুর দু’দশক পরেও তিনি ‘অতীত’ হলেন কই? আজকের প্রজন্ম তাঁর নাম শুনে ভাবে, কে এই হর্ষদ মেহতা (Harshad Mehta)? কেন এভাবে মৃত্যুর পরও তাঁর কীর্তি নিয়ে বারবার আলোচনা চলতে থাকে?
অতীতে ফেরার আগে সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা বলা যাক। কয়েক সপ্তাহ আগে স্বামীর মৃত্যু নিয়ে মুখ খোলেন জ্যোতি মেহতা। বলতে গেলে গত দুই দশক হর্ষদকে নিয়ে প্রকাশ্যে সেইভাবে কোনও বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি তাঁকে। কিন্তু এবার হর্ষদকে নিয়ে তৈরি একটি ওয়েবসাইটে জ্যোতির অভিযোগ, তাঁর স্বামীর যথাযথ চিকিৎসা হয়নি জেলে। হলে এভাবে অকালে চলে যেতে হত না তাঁকে।

জ্যোতির অভিযোগ, ৫৪ দিন জেলে থাকার পর ২০০১ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিকেলে হর্ষদ মেহতার বুকে ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু বারবার সেকথা জেল কর্তৃপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। প্রায় ঘণ্টা চারেক পরে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ততক্ষণে অনেক ‘দেরি’ হয়ে গিয়েছে। জ্যোতির কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, তাঁর স্বামী বেঁচে থাকুন চায়নি জেল কর্তৃপক্ষ। স্বাভাবিক ভাবেই এমন দাবিতে ফের নতুন করে উসকে উঠেছে বিতর্ক। উসকে উঠেছে হর্ষদ মেহতার স্মৃতি।

Advertisement

[আরও পড়ুন: দিল্লি যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রীর ডাকা নীতি আয়োগের বৈঠকে]

Harshad Mehta
‘শেয়ার মার্কেটের অমিতাভ বচ্চন’

গত শতকের আটের দশক। তখনও অর্থনীতির উদারীকরণ শুরু হয়নি দেশে। আজকের ডিজিটাল যুগ তখন কল্পবিজ্ঞানের অংশ। সেই সময় কার্যত দেশের শেয়ার বাজারকে নিজের আঙুলের উপরে নাচাতে শুরু করেছিলেন যে ব্যক্তি, তাঁর নাম হর্ষদ মেহতা। স্টক মার্কেটে যাঁরা বিনিয়োগ করতেন, তাঁদের কাছে একজন ‘মসীহা’ স্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁকে বলা হত ‘শেয়ার মার্কেটের অমিতাভ বচ্চন’! এই নামকরণই বুঝিয়ে দেয় শেয়ার বাজারে (Share Market) হর্ষদের প্রভাব কত বড় হয়ে উঠেছিল।

Advertisement

তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। অথচ ১৯৫৪ সালের ২৯ জুলাই গুজরাটের রাজকোটে এক সাধারণ ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেওয়া হর্ষদের জীবন একটা সময় পর্যন্ত ছিল নেহাতই ছাপোষা। মুম্বইয়ের কান্দিবালিতেই কেটেছে শৈশব। স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়ে চাকরি জীবনে প্রবেশ। প্রায় আট বছর কেটেছে চাকরি করেই। তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ‘গুরু’র সঙ্গে সাক্ষাৎ। সেই গুরুর নাম প্রসন্ন প্রাণজীবনদাস। সেই ভদ্রলোক ছিলেন শেয়ার বাজারের এক নামকরা দালাল। তাঁর অধীনেই শেয়ার বাজারের ‘নেশা’য় আচ্ছন্ন হওয়া শুরু হর্ষদের। একটু একটু করে শিখে নিতে থাকা বিনিয়োগের নানা প্যাঁচপয়জার।

Harshad Mehta
হর্ষদ মেহতার জীবন হার মানায় বাণিজ্যিক ছবিকেও

[আরও পড়ুন: কেন অশোকস্তম্ভকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল জাতীয় প্রতীক হিসেবে? জানুন ইতিহাস]

এরপর ১৯৮৪ সালে নিজের সংস্থা খুলে ফেলেন হর্ষদ। নাম ‘গ্রো মোর অ্যান্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’। বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকার হিসেবে সেই তাঁর যাত্রা হল শুরু। নয়ের দশক আসতে না আসতেই বহু লোক বিনিয়োগ করতে লাগলেন হর্ষদের সংস্থায়। কিন্তু তাঁর ‘দ্য বিগ বুল’ হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর ছিল এসিসি সিমেন্ট সংস্থায় বিনিয়োগ। এসিসির শেয়ার দর যেখানে ছিল দুশো টাকা। সেখানে তিন মাসের মধ্যে শেয়ারের দর লাফিয়ে পৌঁছে যায় প্রায় ন’হাজার টাকায়! রাতারাতি বিপুল মুনাফা হর্ষদকে করে তুলল বিজনেস টাইকুন! কিন্তু কোন ম্যাজিকে সম্ভব হল এমনটা? ১৯৯২ সালে সেই রহস্য ভেদ করেন নামী সাংবাদিক সুচেতা দালাল।

Harshad Mehta web series
হর্ষদ মেহতাকে নিয়ে তৈরি হওয়া টিভি সিরিজ

জানা গেল হর্ষদ প্রথমে ব্যাংক রসিদ অর্থাৎ বিআর তৈরি করিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সেই টাকাই অবৈধ ভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে দিতেন। পরে অন্য কোনও শেয়ার থেকে লাভ করতে পারলেই ব্যাংকের টাকা ব্যাংককেই ফিরিয়ে দিতেন। এইভাবে নানা টেকনিক্যাল ফাঁকফোকড় বের করে ব্যাংকের জমা টাকা শেয়ার বাজারে লাগাতে শুরু করেন তিনি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, ব্যাংক ‘ক’ শেয়ার বিক্রি করতে চায়। অন্যদিকে ব্যাংক ‘খ’ শেয়ার কিনতে চায়। এবার হর্ষদ মেহতা ‘ক’ ব্যাংকের কাছে গিয়ে জানালেন, তিনি একজন ক্রেতা পেয়েছেন। এবার তিনি ব্যাংকটির থেকে রসিদ তুলে নিয়ে ১ সপ্তাহ সময় চাইলেন। আর সেই সময়ে ‘খ’ ব্যাংককে গিয়ে জানালেন তিনি বিক্রেতা পেয়েছেন। এইবার সেই ব্যাংকের থেকে এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নিয়ে নগদ টাকা নিজের কাছে রাখলেন। এইভাবে কিছু সময়ের জন্য তাঁর কাছে বিআর থেকে নগদ টাকা সবই চলে এল। আর এই কাজে তাঁকে পুরোদস্তুর সাহায্য করতেন বিভিন্ন ব্যাংক কর্মচারী। ক্রমে পুরো বিষয়টি প্রকাশ্য়ে আসতেই সব ব্যাংক হর্ষদের থেকে টাকা ফেরত চাইতে শুরু করে। আর তার জেরে শেয়ার বাজার মুখ থুবড়ে পড়ে।

বহু ব্যাংক থেকেই মোটা টাকা তুলে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন হর্ষদ। রাতারাতি এত টাকা ফেরত দিতে না পেরে ক্রমেই বেকায়দায় পড়ে যান তিনি। একের পর এক অভিযোগ জমা পড়তে থাকে। রুজু হয় মামলা। ভরাডুবির সেই সূচনা হর্ষদের। এমতাবস্থায় না ঘাবড়ে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু এখানেও অব্যাহত ছিল তাঁর ‘চাল’। তিনি সকলকে সেই সব সংস্থাতেই বিনিয়োগের পরামর্শ দিতেন, যেখানে উনি বিনিয়োগ করে রেখেছিলেন।

Harshad Mehta
পুলিশের হাতে বন্দি হর্ষদ মেহতা

চমকের তখনও বাকি ছিল। কেলেঙ্কারির পর কেলেঙ্কারিতে জড়ানো হর্ষদ মেহতা গ্রেপ্তার হন ১৯৯৩ সালে। আর সেই সময়ই তিনি দাবি করেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওকে একটি সুটকেস দিয়েছিলেন। সেই সুটকেসে ছিল ১ কোটি টাকা! স্বাভাবিক ভাবেই এমন অভিযোগ পত্রপাঠ খারিজ করে দেন নরসিমহা। জানিয়ে দেন, এযাবৎ কোনওদিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎই হয়নি হর্ষদের! বলাই বাহুল্য, এমন দাবিতে বিতর্ক চরমে উঠেছিল। দেশে সেই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠল। বিষয় গড়ায় সিবিআই পর্যন্ত। তদন্তে কিছুই প্রমাণ না হলেও হর্ষদ নিজের দাবিতে ছিলেন অটল। এমনকী, যে সুটকেসে তিনি ওই টাকা দিয়েছিলেন, সেটিকেও প্রকাশ্যে দেখিয়েই তাঁকে দাবি করতে দেখা গিয়েছিল।

বাকি জীবনটা গরাদের পিছনেই কাটিয়েছিলেন হর্ষদ। শেষ পরিণতির কথা আগেই বলেছি। ভাগ্যের এ এক আশ্চর্য পরিহাস! একেবারে ছাপোষা এক মানুষের হঠাৎ বিপুল ধনী হয়ে ওঠা। ওরলির মতো জায়গায় সমুদ্রমুখী ১৫ হাজার বর্গ ফুটের পেন্টহাউস। সঙ্গে মিনি গলফ কোর্স ও সুইমিং পুল। বাড়ির সামনে গাড়ির লাইন। টয়োটা করোলা, লেক্সাস এলএস৪০০, টয়োটা সেরার মতো সেরা সেরা গাড়ির সম্ভার দেখলে তাক লেগে যেত সকলের। সেখান থেকে অন্ধকার কারাগারের জীবন। বুকে ব্যথা নিয়ে ধীরে ধীরে ঢলে পড়া মৃত্যুর কোলে। যেন সাত-আটের দশকের কোনও বাণিজ্যিক ছবির প্লট। গ্ল্যামার ও অন্ধকারের সহাবস্থানের আড়ালে থাকা নীতিবাক্যটিও নজর এড়ায় না। নির্নিমেষ লোভ শেষ পর্যন্ত যে মানুষকে এক চরম ফাঁকের মধ্যে নিয়ে ফেলে নতুন করে সেই কথা মনে পড়ে যায়। বারবার আলোচনায় উঠে আসতে থাকেন ‘দ্য বিগ বুল’। মৃত্যুর দুই দশক পরেও।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ