সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: আমেরিকা ও আফগান তালিবানের মধ্যে শান্তি চুক্তি নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে সাউথ ব্লকে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা ফায়ার গেলে সে দেশে প্রকল্পগুলির নিরাপত্তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত ভারত।
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর অবশেষে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে আমেরিকা ও তালিবান। পূর্ব ঘোষণা মতোই শনিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) দোহায় সম্পন্ন হয় মার্কিন-তালিবান ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি। মনে করা হচ্ছে, এই চুক্তির ফলেই আফগানিস্তানে ১৮ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান হতে চলেছে। কাতারের রাজধানী দোহায় এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন চুক্তিতে সই করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদে ও তালিবান ডেপুটি লিডার মোল্লা আবদুল ঘানি বরাদর। উপস্থিত ছিলেন মার্কিন সচিব মাইক পম্পেও এবং ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির প্রতিনিধিরা। পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, ইরান, চিনের দূতরা। উপস্থিত ছিলেন কাতারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত পি কুমারন।
[আরও পড়ুন: অধরাই ইতিহাস! আজিজাহর বদলে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে বসলেন মুহিউদ্দিন]
আমেরিকা ও তালিবানের মধ্যে এই বহুপ্রতীক্ষিত শান্তিচুক্তির আগে শুক্রবার বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সরকারি সফরে কাবুল গিয়েছিলেন। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানি ও সে দেশের পার্লামেন্টের স্পিকার, আফগানিস্তানের চিফ একজিকিউটিভ আবদুল্লা আবদুল্লা-সহ শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তিনি দফায় দফায় বৈঠক করেন। শান্তিচুক্তি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শুভেচ্ছা বার্তা ঘানির হাতে তুলে দেন তিনি। শ্রিংলা কাবুলে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের গণতন্ত্র ও সুরক্ষার প্রশ্নে ভারত পাশে থাকবে। বাইরের কোনও দেশের মদতে (পাকিস্তানের) আফগানিস্তানে হিংসা বরদাস্ত করবে না ভারত। আফগানিস্তানের গণতন্ত্র ও সুরক্ষার প্রশ্নে ভারত সবসময় পাশে থাকবে।’ ওয়াকিবহাল মহলের মতে, শান্তিচুক্তির আড়ালে তালিবানকে সামনে রেখে পাকিস্তান যাতে আফগানিস্তানে ফের থাবা বসাতে না পারে সেজন্যই ভারত এই ভাষায় আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখল।
তবে, মার্কিন সেনা অপসারণের পর আফগানিস্তানে ক্ষমতার শূন্যস্থান তৈরি হলে সেখানে ফের ঘাঁটি গাড়বে পাক সেনা ও পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। তাতে বিঘ্নিত হবে ভারতের বিপুল বিনিয়োগ। এমনটাই আশঙ্কা দিল্লির। কারণ আফগানিস্তানে রয়েছে ভারতের কয়েক লক্ষ কোটি টাকার বিভিন্ন চালু প্রকল্প। তালিবানি বা পাকিস্তানি নাশকতায় সেগুলি যাতে বিপন্ন না হয় তা আগেই আমেরিকাকে জানিয়ে দিয়েছিল নয়াদিল্লি। নয়া শান্তি চুক্তির ফলে যাতে নিজের কৌশলগত স্বার্থ বিপন্ন না হয় তা নিয়ে আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত সরকার। তবে এই শান্তি চুক্তি আদৌ কতদিন স্থায়ী হবে বা আফগানিস্তানের মতো হিংসাদীর্ণ দেশে এর আয়ু কতদিন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।
আমেরিকা-তালিবান শান্তি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে চিন, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স-সহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলি। এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে ইউরেপীয় ইউনিয়ন এবং সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ। চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রবীশ কুমার বলেছেন, তালিবান সহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল, নাগরিক সমাজ, প্রবাসী আফগানরা এবং সে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানে শান্তি এবং সুস্থিতি ফেরার সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছে। বাস্তবতা মেনে ভারতও আশা করছে এই চুক্তি আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি আনতে পারবে। ’ দোহায় চুক্তির সময় ভারতের পি কুমারনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পাক বিদেশমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি।
মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পেও তালিবানকে বলেছেন, ‘আপনারা কথা দিয়েছে, আল কায়দার সঙ্গে সবরকমের সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। আপনারা সেই কথা রাখুন।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘তালিবান এবং আফগান সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করে তাহলে আফগানিস্তানে শান্তি ফেরাতে পারব আমরা।’ এই শান্তি চুক্তি অনুসারে, তালিবান তাদের কথা রাখলে, ১৪ মাসের মধ্যে আমেরিকা ও ন্যাটো সহযোগীরা সব সেনা সরিয়ে নেবে আফগানিস্তান থেকে। ১৩৫ দিনের মধ্যে সরানো হবে ৮,৬০০ সেনা। দু’পক্ষই নিজেদের মধ্যে বন্দি বিনিময় করবে। ১০ মার্চের মধ্যে পাঁচ হাজার তালিবান জঙ্গিকে ছাড়বে কাবুল। তালিবান মুক্তি দেবে এক হাজার আফগান সেনাকে।
এদিকে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তথা কৌশলগত বিশেষজ্ঞ স্টিফেন বিডলের ব্যাখ্যা, মার্কিন সামরিক সদর দফতর পেন্টাগন অনেক ভেবেচিন্তেই এই চুক্তিকে অনুমোদন করেছে। কারণ, তালিবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার অর্থ আফগানিস্তানকে বন্ধু দেশে পরিণত করা। তাহলে ভবিষ্যতে যদি চিন বা ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সরাসরি স্বার্থের সংঘাত বাধে বা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে ইরান ও চিনের প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মাটিকে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ভালভাবে ব্যবহার করতে পারবে মার্কিন সেনাবাহিনী। সেক্ষেত্রে তালিবান-আমেরিকার দোস্তি এখন থেকেই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে চলেছে চিন ও ইরানের কাছে। কারণ আফগানিস্তান থেকে ইরানের পূর্ব সীমান্ত এবং চিনের পশ্চিম সীমান্ত দু’টি এলাকাই আমেরিকার আক্রমণের নাগালে চলে আসবে।