Advertisement
Advertisement
Harem

যৌনতা আর গোপনীয়তায় ভরা মুঘল হারেম, কেমন ছিল সেই বন্দিনীদের জীবন?

কেবল বাহশাহ ছাড়া আর কারও সঙ্গেই যৌনতা করার অনুমতি ছিল না তাঁদের।

Lives of women inside a Mughal emperor’s harem। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:April 22, 2023 8:16 pm
  • Updated:April 22, 2023 8:50 pm

বিশ্বদীপ দে: মুঘল হারেম নিয়ে কৌতূহল চিরকালের। যা কিছু নিষিদ্ধ, গোপন সেখানেই কুয়াশা সবথেকে বেশি ঘন হয়ে ওঠে। এই নিয়ে প্রশ্ন কম নেই। মুঘলরা কি মদ্যপান করত? আকবরের কি হারেম (Mughal harem) ছিল? কেমন ছিল সেই অন্তঃপুরবাসিনীদের জীবন? সেখানে সকলেই কি ছিলেন বাদশাহর ভোগ্যা? রাজপুরুষদের হাতে বন্দিনী নারীদের জীবনে যৌনতার ছবিটাই বা কীরকম ছিল? কয়েকশো বছর পেরিয়ে গেলেও ইতিহাসের বুকে কান পাতলে আজও এই প্রশ্নগুলিকে ভেসে বেড়াতে শোনা যায়।

সম্রাট আকবরের (Akbar) আমলেই মুঘল হারেম সঠিক চেহারা পেলেও বাবরের আমল থেকেই হারেমের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। ‘হারেম’ শব্দটা এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার সম্মিলিত অঞ্চল যাকে ‘নিয়ার ইস্ট’ বলা হয় সেখান থেকে। অর্থ ‘গোপন পবিত্র স্থান’। এর সঙ্গে মিল রয়েছে আরবি শব্দ ‘হারিমে’রও। যার অর্থও প্রায় কাছাকাছি। তুরস্কের ‘সেরাজিলো’ ও ফার্সি শব্দ ‘জেনানা’র সঙ্গেও এর মিল রয়েছে। মিল রয়েছে সংস্কৃত ‘অন্তঃপুর’ শব্দটিরও সঙ্গে। সব মিলিয়ে ‘হারেম’ শব্দটির উৎস ধরে এগোলেই পরিষ্কার হয়ে যায় কতটা গোপনীয়তার কুয়াশা ঘিরে রাখত হারেমকে। আর তাই তো তাকে ঘিরে এমন সব গুঞ্জন ও জল্পনা।

Advertisement
Harem
মোঘল হোক বা তুর্কি, হারেম মানেই যৌনতা ও বৈভব

মুঘল হারেম সম্পর্কে তাজমহল সম্পর্কিত একটি ওয়েবসাইটে পরিষ্কার বলা হয়েছে, মুঘল হারেম নিয়ে বহু কথা উঠে আসে নানা জীবনী, আত্মজীবনী ও ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে। কিন্তু এর অধিকাংশই ভুয়ো ও ভিত্তিহীন। বক্তব্যের সম্পর্কে নেই কোনও নিশ্চিত প্রমাণ। তবে এই তথ্যে কোনও ভুল নেই যে, এই মহিলামহলে কেবল বাদশাহ ছাড়া আরও কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। সেই সঙ্গে এও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে কেবল রাজমহিষীরাই থাকতেন তা নয়। উপপত্নী ও দাসীরাও থাকতেন। অবশ্যই ‘পজিশন’ অনুযায়ী, থাকার ব্যবস্থা ছিল আলাদা রকমের। অর্থাৎ হারেম মানেই কেবল অবাধ যৌনতার ছড়াছড়ি তা নয়। মনে করা হয়, বহু ইউরোপীয় বা অন্য দেশ থেকে আসা লোকেরা হারেমের আশপাশে ঘেঁষতে পারতেন না। আর তাই নানা জনের মুখ থেকে শোনা গল্পগাছাই মিশে যেত তাঁদের লেখায়। সেখান থেকেই এই মিথ ও মিথ্যের ছড়াছড়ি।

Advertisement

[আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টে ফের ধাক্কা DA আন্দোলনকারীদের, আবারও পিছিয়ে গেল মামলার শুনানি]

আবুল ফজলের লেখায় পাওয়া যায়, আকবর নাকি পাঁচ হাজারেরও বেশি মহিলাকে তাঁর হারেমে রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকশো মহিলার সঙ্গে তাঁর শরীরী সম্পর্ক ছিল। বাকিরা ছিলেন হারেমের ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু তাঁদেরও হারেমের কড়া নিয়ম মেনে চলতে হত। সেখানে কারও কোনও ছাড় ছিল না। কিন্তু এই দাবিকে অতিকথন বলেই মনে করা হয়। কেননা হারেমের জন্য নির্ধারিত যে স্থান, সেখানে অতজন মহিলার পক্ষে থাকা অসম্ভব। তবে নিশ্চিত ভাবেই সংখ্যাটা অনেক বেশি, কিন্তু তা বলে পাঁচ হাজার নয়। তবে অনুমান করা হয়, হয়তো এই সংখ্যাটা রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত সব নারীকে ধরেই করা হয়েছিল। যেমন, আকবর নির্মিত ‘কাচ কা মহলে’ও বহু রাজনারী থাকতেন। হয়তো সবাইকে ধরেই ওই সংখ্যাকে হারেমের সদস্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

সম্রাট আকবর

কেমন ছিল হারেমের জীবন? এখানে ঢোকা মানেই বাইরের জগতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। এমনকী সম্রাটের মৃত্যুর পরেও সেখান থেকে মুক্তি ছিল না। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হত হারেমের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন অঞ্চলে, যার নাম ছিল সুহাগপুরা। আকবরের আমলে তৈরি হওয়া হারেমে ঐতিহ্য পরবর্তী সময়ে রক্ষা করেছিলেন জাহাঙ্গির, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবও। তবে জাহাঙ্গিরকে ঘিরেই মুঘল হারেমের সবথেকে বেশি গুঞ্জন শোনা যায়। ওলন্দাজ ব্যবসায়ী ফ্রান্সিসকো পেলসের্ট জাহাঙ্গিরের আমলে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায়, মাত্র ২৫ বছর বয়সেই ২০ জন স্ত্রী ছিলেন জাহাঙ্গিরের। দাসী ছিলেন তিনশোরও বেশি।

পরে যত বয়স বেড়েছে ততই সংখ্যায় গুণিতক হারে বাড়তে থেকেছেন তাঁরা। শিল্পরসিক জাহাঙ্গিরের আমলে হারেমের ভিতরে মহলগুলি যেমন ঐশ্বর্যে ঝলমল করত, তেমনই হারেমের বন্দিনীদের পরনেও থাকত ভারী পোশাক, ঝলমলে গয়নাগাটি। তাঁদের শরীরে ভুরভুর করত সুগন্ধীর সুঘ্রাণ। বলা হয়, সেই বন্দিনীদের জীবনের মোক্ষই ছিল যেনতেনপ্রকারণে সম্রাটকে খুশি করা। জাঁহাপনার পছন্দের খাবার কিংবা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে তাঁরা তা পেশ করতেন। প্রত্যেকেই নিজেদের এমনভাবে নিবেদন করতেন যাতে বাদশাহের মন জিতে নেওয়া যায়। তাঁর সঙ্গেই যেন শরীরী খেলায় মেতে ওঠেন বাদশাহ।

Jahangir
জাহাঙ্গির

[আরও পড়ুন: ‘সত্যের জন্য যে কোনও মূল্য দিতে রাজি’, সময়সীমার মধ্যেই দিল্লির বাংলো ছাড়লেন রাহুল]

জাহাঙ্গিরই (Jahangir) একমাত্র মুঘল সম্রাট, যিনি মদ ও আফিমে ডুবে থাকতেন। অন্য নেশাও ছিল তাঁর। কোনও কোনও বর্ণনায় মেলে, তিনি নাকি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মেয়েদের মাঝে গিয়ে বসতেন। যদি স্ত্রীর কোনও দাসীর দিকে তাঁর নজর পড়ে যেত, তাহলে তাঁকেই হতে হত সম্রাটের সেরাতের শয্যাসঙ্গিনী। সেই দাসীও চেষ্টা করতেন বাদশাহের মন জিতে নিতে। একবার জাহাঙ্গিরের নজরে পড়ে যাওয়া মানে হারেমে তাঁর প্রতিপত্তিও যেত বেড়ে। আবার জাহাঙ্গিরের মনে না ধরলে অচিরেই তিনি নির্বাসিত হতেন বিস্মৃতির অন্ধকারে। বাদশাহ আর ফিরেও দেখতেন না সেদিকে। সেজীবনের মতো যৌনতা তাঁর অধরাই থেকে যেত। কেননা খোদ সম্রাট ছাড়া আর কারও সঙ্গে যৌনতায় জারি ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। মৃত্যু ও অসুস্থতার কোনও স্থান ছিল না হারেমে। সেখানে কেবলই ফুর্তি আর জৌলুস। তাই কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই তাঁকে ঠেলে দেওয়া হত বিমারখানায়।

সেখানে কারও সঙ্গে দেখা করার অনুমতিটুকুও ছিল না। যৌন অতৃপ্তিতে ভোগা হারেমের অনেক বাসিন্দার চিকিৎসকদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করার কথাও জানা যায়। তবে সেখানেও সহজে প্রবেশাধিকার মিলত না পুরুষদের। মেয়ে ‘জারাহ’ বা শল্য চিকিৎসকের ডাক পড়ত সর্বাগ্রে। তবে তাঁরা ব্যর্থ হলে তবেই সেখানে পা পড়ত পুরুষ চিকিৎসকদের। তাঁদের রীতিমতো কালো চাদরে ঢেকে ভিতরে ঢোকানো হত। সেই অদেখা অচেনা পুরুষদের দিকেই যৌনপিপাসা নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইতেন হারেমের রোগিনীরা। কতটা অসহায়তা! সব মিলিয়ে হারেম আসলে বৈভবের ঝলকানির আড়ালে চিরদুঃখিনী অন্তঃপুরবাসিনীদের গোপন কান্নার জন্মস্থানও। আগ্রা ফোর্ট থেকে ফতেপুর সিক্রি, ইতিহাসও আজও বয়ে চলেছে সেযুগের কত অনাম্নী মহিলার যন্ত্রণার নীরব জলছবি। কত ষড়যন্ত্র আর যৌন অতৃপ্তির কাহিনিই যে লুকিয়ে রয়েছে সেই প্রত্ননিদর্শনগুলির গভীরে।

Harem
মুঘল হারেম

এবং খোজা। হারেমের ‘নপুংসক’ পুরুষ পাহারাদাররা। সশস্ত্র এই পাহারাদের প্রধানকে বলা হত হারেম সারা। হারেমের ভিতরের ব্যবস্থাপনা ও সব কিছুই তাঁর নজরে থাকত। পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি বার্তাবাহক থেকে অন্তঃপুরবাসিনীদের মন ভোলানো, তাঁদের সেবা সবই করতেন এই খোজারা। কেন তাঁদের ‘পুরুষত্ব’ নষ্ট করে দেওয়া হত? এর উত্তর সকলেরই জানা। যাতে তাঁরা হারেমের কোনও মহিলাকে ভোগ না করতে পারেন।
হারেম নিয়ে একটি অসামান্য বই ‘ডটার্স অফ দ্য সান: এমপ্রেসেস, কুইনস অ্যান্ড বেগমস অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার’। লেখিকা ইরা মুখোটি। তিনি লিখেছেন, বাবর ও হুমায়ুনের আমলে হারেমের চেহারা এতটাও গোপনীয় ছিল না। কারণ সেসময় হারেমের মহিলাদের অধিকাংশই চাগতাই তুর্কিষ এই মহিলারা কেবল ঘর সামলাতেন না। যুদ্ধনীতি থেকে রাজনীতিতেও ছিলেন চৌকস। আকবরের আমল থেকেই হারেমকে ঘিরে গোপনীয়তার কুয়াশা গড়ে উঠতে থাকে। আর সেই কুয়াশাকে ঘিরে পাক খেতে থাকে অদম্য কৌতূহল। আগেই বলেছি, যে কৌতূহল আজও একই ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। কয়েকশো বছরেও তার নিবৃত্তি হয়নি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ