সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সব কিছুরই একটা ইতিহাস থাকে। ভূত এবং ভুতুড়ে জায়গারও!
আসলে, ভূত মানেই তো কিছুটা অতীত। আর বাকিটা নিখাদ রহস্য। মানুষের জীবন যার তল খুঁজে পায় না। খুঁজে পেলে দৈবাৎ সহ্যও করতে পারে কি?
পারে না বলেই তো ভূতকে মানুষের এত ভয়! সেই ভয়ই এখনও ডেরা বেঁধে রয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনের গা ঘেঁষে। রাইসিনা হিল-এর পাশের মালচা মহল-এ।
যদি আপনি ঘুরতে ঘুরতে চলেও যান মালচা মহল-এর কাছে, প্রথম দেখাতেই একটা অজানা আশঙ্কা মনে গেঁথে বসবে। সেটা ঘন জঙ্গল, জং ধরা লোহার গেট, ইট বেরিয়ে আসা পুরনো প্রাসাদের জন্যই শুধু নয়। আরও কিছু আছে ওই প্রাসাদে। যা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একবার ভিতরে ঢুকলে আর বেরোবার অনুমতি দেয় না।
সত্যি! মালচা মহল-এ লোকে যায় বটে নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু তার আর ফিরে আসা হয় না। দিল্লি এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে বহু বার।
আসলে, মালচা মহল শুরু থেকেই জড়িয়ে থেকেছে মৃত্যুর সঙ্গে। মালচা মহল সাক্ষী থেকেছে চূড়ান্ত দুর্দশার। সেই সব কিছু এক অভিশাপের মতো, অতৃপ্তির মতো আজও পাক খাচ্ছে বাতাসে।
শোনা যায়, চতুর্দশ শতকে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে গড়ে উঠেছিল এই মালচা মহল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মহল তৈরি হয়েছিল শিকারের সময়ে রাত কাটানোর জন্য। এমন মহলকে সেই সময়ে বলা হত শিকারগাহ। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে শুরু থেকেই অভিশাপের মুখে পড়ে মালচা মহল। অনেকে বলেন, এক পীর পশুবধের জন্য অভিশাপ দিয়েছিলেন সুলতানকে। সেই অভিশাপ অনুযায়ী, এখানে কেউ পা রাখলেই তার মৃত্যু অনিবার্য!
পীরের দেওয়া অভিশাপে জৌলুস হারায় শিকারগাহ। তার পরে অনেকগুলো বছর কেটে যায়। ভেঙে পড়তে থাকে মালচা মহল। চার পাশের জঙ্গল আগাছা সমেত আরও ঘন হতে থাকে। সেই সঙ্গে, ঘন হতে থাকে বেগম বিলায়েৎ মহল-এর ভাগ্যের আকাশে কালো মেঘ।
বিলায়েৎ মহল?
তিনি নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ-র নাতনি। অয়োধ্যার শেষ নবাব যিনি ইংরেজদের সঙ্গে যুঝতে না পেরে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। রাজপাট সমেত সব সম্পত্তিও চলে গিয়েছে ইংরেজদের হাতে।
অযোধ্যার নবাবের সম্পত্তির মধ্যেই ছিল এই মালচা মহল। তুঘলকি বংশের শাসনের পরে হস্তান্তরিত হয়ে মালচা মহল চলে গিয়েছিল অযোধ্যায়।
পিতৃপুরুষের সেই সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্যই সরব হয়েছিলেন বিলায়েৎ মহল। কোলের দুই শিশু- নবাবজাদা রিয়াজ আর নবাবনন্দিনী সাকিনাকে নিয়ে চালিয়ে গিয়েছিলেন লড়াই। সব বেচে পথে নেমেছিলেন হারানো সম্পত্তির জন্য। সে উঠেছিলেন দিল্লি রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সেটা ১৯৮৫ সাল।
তাঁর আবেদনে অবশেষে ভারত সরকারের টনক নড়ে। মালচা মহল তুলে দেওয়া হয় বিলায়েৎ মহলের হাতে।
মালচা মহলে এসেই কি বিলায়েৎ বুঝতে পেরেছিলেন বড় ভুল হয়ে গিয়েছে?
হয়তো তাই! কেন না, এর পরেই মালচা মহলে মৃত্যু আবার থাবা বসায়। ১৯৯৩-তে আত্মহত্যা করে মুক্তির পথ বেছে নেন বিলায়েৎ। তুঘলকি আমলের পীরের অভিশাপই কি এভাবে সত্যি হয়?
সেটা বিতর্কের বিষয়। মালচা মহলে থেকে যান শুধু সাকিনা আর রিয়াজ।
কিন্তু, দুর্ভাগ্যের তখনও বাকি ছিল। কী ভাবে যেন চাউর হয়ে যায়, প্রচুর ধনরত্ন রেখে চোখ বুজেছেন বিলায়েৎ। তাই ডাকাতের হামলা হয় মালচা মহলে। কোনও কিছু না পেয়ে বিলায়েতের খবরও খুঁড়েও দেখতে গিয়েছিল তারা।
আশ্চর্যের ব্যাপার কিন্তু এখানেই! হামলাকারীরা যে কোনও কারণেই হোক পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। প্রচণ্ড ভয় নিয়ে।
তার পর, সরকারের কাছে আবেদন জানান সাকিন আর রিয়াজ- আত্মরক্ষার জন্য তাদের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া হোক!
সেই আবেদন মঞ্জুর হয়। সরকার জানিয়ে দেয়, সাকিনা আর রিয়াজের অসম্মতিতে কেউ মালচা মহলে পা দিলে তাকে গুলি করার সম্পূর্ণ অনুমতি নবাব খানদানের রয়েছে।
গুলি চলত কি না, তা জানা যায় না। কিন্তু, বিলায়েতের মৃত্যুর পর মালচা মহলে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে থাকে। সাকিনা মহল বরাবরের জন্য পরে নেন এক কালো পোশাক। কেন, কেউ জানেন না! আর কোথা থেকে একটা কালো কুকুর এসে জোটে মালচা মহলে। সেটাই ছিল সাকিনার রাত-দিনের সঙ্গী।
রহস্য এভাবে বাড়তেই থাকে। লোকে বলে, মালচা মহলে ঢুকলে না কি এসে ছেঁকে ধরে অজস্র কুকুর! এক পাল কুকুরের আওয়াজও মাঝে মাঝেই ভেসে আসে মালচা মহলের ভিতর থেকে। অত কুকুর কিন্তু ওখানে থাকার কথাই নয়।
সত্যিটা যাচাই করতে অনেকেই গিয়েছেন ওখানে। কিন্তু, কেউ ফিরে আসেননি। এমনকী, তাঁদের মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মালচা মহল কিন্তু থেকে গিয়েছে রহস্য নিয়েই। দীর্ঘনিশ্বাসের রহস্য, অভিশাপের রহস্য তার সর্বাঙ্গে।