Advertisement
Advertisement
এনআরসি

বঞ্চিত ভাষা শহিদদের পরিবার, অসংগতিপূ্র্ণ এনআরসি ঘিরে ফের অশান্তির আশঙ্কা অসমে

নাগরিকত্ব প্রমাণে ফেল অধিকাংশ হিন্দু বাঙালি, ভূমিপুত্ররা।

Unhappy with the ambiguious NRC list,say most of the citizens in Assam
Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:September 1, 2019 8:08 pm
  • Updated:September 2, 2019 12:04 pm

মনিশংকর চৌধুরি, গুয়াহাটি: লম্বা পদ্ধতির শেষে চূড়ান্ত ফলাফল জানা হয়ে গিয়েছে। অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই হয়েছে ৩ কোটি ১১ লক্ষ ২১ হাজার ৪ জনের। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের ঘিরেই যত ভাবনাচিন্তা, অশান্তির আশঙ্কা। কিন্তু বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নেই। যে তিন কোটিরও বেশি মানুষ নাগরিকত্ব প্রমাণের পরীক্ষায় পাশ করেছেন, তাঁদের এখনই আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই।
কারণ, গোটা পদ্ধতিটাই অস্বচ্ছ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষত অসমে ভাষা আন্দোলনের শহিদ পরিবার, ভূমিপুত্র এবং হিন্দু বাঙালিদের একটা বড় অংশ বাদ পড়ায় ভিতরে ভিতরে ক্ষোভে ফুটছেন তাঁরা। আপাতত সেই ক্ষোভের বহিপ্রকাশ না হলেও, অদূর ভবিষ্যতে এনিয়ে ফের অসম উত্তপ্ত হতে পারে, তা স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রই বুঝতে পারছেন।

[ আরও পড়ুন: হতাশা নয়, এনআরসি’তে নাম না দেখে নাগরিকত্ব প্রমাণে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিকিৎসক ]

অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু), যারা সেই রাজীব গান্ধীর আমল থেকেই নাগরিকপঞ্জির দাবিতে কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, এতদিন পর তাদের সেই দাবি পূরণ হওয়া সত্ত্বেও একেবারেই সন্তুষ্ট নন তাঁরাই। নাগরিকপঞ্জি মানে তাঁদের কাছে ‘জাতির দলিল, জাতির রক্ষাকবচ’। কিন্তু শনিবারের তালিকা দেখে আসু নেতৃত্বের বক্তব্য, তালিকায় নাম থাকা আর বাদ পড়া সংখ্যায় বিস্তর গলদ আছে। ১৯৯১
সালে অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর সইকিয়ার একেবারে হিসেব দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে জানিয়েছিলেন, গোটা রাজ্যে অন্তত ৪০ লক্ষ বাংলাদেশির বসবাস। পরবর্তী সময়ে তাঁর পেশ করা সেই তথ্য মিলিয়ে তাকে মান্যতা দেয় মন্ত্রক। এমনকী ২০১৮-য় অমিত শাহ, কিরেণ রিজিজুও মেনে নেন, অসমে ৪০ লক্ষ বাংলাদেশি থাকেন। আর এখানেই আসুর সংশয়, কীভাবে তবে বাদ যাওয়ার সংখ্যা ১৯ লক্ষ হয়?
তাঁদের আশা ছিল, সংখ্যাটা অন্তত ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ হওয়া উচিত হবে। কাজেই তাঁদের হিসেব মিলছে না।
এ তো গেল আসুর হতাশার বিষয়। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, বিদেশি বিতাড়নের জন্য আন্দোলনে ৮৫৫জন ভাষা শহিদদের অনেকের পরিবারের নাম না থাকা। প্রথম শহিদ খড়গেশ্বর তালুকদার থেকে শুরু করে মদন মল্লিক বা মৃণাল ভৌমিক, অসমবাসী বাঙালি শহিদদের পরিবারের সকলেই বলছেন, ‘এ কেমন এনআরসি? যাঁরা বিদেশি তাড়ানোর জন্য প্রাণ দিয়ে গেল, তাঁরাই আজ বিদেশি প্রতিপন্ন হচ্ছে! আর
যাদের থাকার কথা নয়, তারা দেশের নাগরিকের স্বীকৃতি পাচ্ছে! এমন এনআরসি আর আমরা চাই না।’ কার্বি আংলঙের শহিদ মদন মল্লিকের পরিবারের কারও নাম নেই নাগরিকপঞ্জিতে। নাম নেই কামরূপের মৃণাল ভৌমিকের পরিবারের ৬ জনেরও। ফলে তাঁদের এই হতাশা স্বাভাবিক।
সাধারণ মানুষজন কী বলছেন? তাঁদের সঙ্গে কথা বলেও এই একই ছবি উঠে আসছে। বিশেষত বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া অসমের ধুবুড়ি জেলা, যেখানে ভূমিপুত্র কোচ রাজবংশিদের আধিক্য, সেখানকার মানুষজনের চরম আশাভঙ্গ হয়েছে।তালিকা প্রকাশের একদিন পর খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল, ধুবুড়ির দুটি প্রতিবেশী গ্রাম জাপু চাপুরি এবং জাপু চাপুরি ১-এ একেবারে পরস্পর বিরোধী ছবি। জাপু চাপুরি কোচ
রাজবংশি অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও ৯০ শতাংশের নাম বাদ এনআরসি থেকে। আর সংখ্যালঘুদের গ্রাম জাপু চাপুরি ১-এর ৯৫ শতাংশ মানুষ নাগরিকত্ব প্রমাণে সফল। অথচ হওয়ার কথা ছিল উলটো। হিন্দু বাঙালি এবং ভূমিপুত্রদেরই এই ঝাড়াইবাছাই পর্বে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত থাকার কথা। এছাড়া বাদ পড়েছেন কার্বি, কছারি, ডিমাসা উপজাতির অধিকাংশ সদস্যই। একইভাবে সেনায় কর্মরত শোনিতপুরের বাসিন্দা
সুমন সরকার এবং তাঁর পরিবারের কারও নাম এনআরসি তালিকায় না দেখে চূড়ান্ত বিরক্ত তাঁরা। এনআরসি পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন সুমনবাবু। এ থেকেই বোধহয় স্পষ্ট হয়েছে এনআরসি পদ্ধতির অসংগতি।
রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে দীর্ঘ ৬ বছরের পদ্ধতি শেষে প্রকাশিত নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ক্ষোভ জমছে সব শিবিরেই। রাজ্যের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার স্পষ্ট অভিযোগ, তালিকায় নাম তোলার জন্য জাল বংশলতিকা বানিয়ে জমা দিয়েছেন সংখ্যালঘুদের অনেকেই। আর তাতেই তাঁরা নাগরিকের অধিকার পেয়ে গিয়েছেন। তিনি আরও বলছেন, ‘এনআরসি ফাইনাল নয়। এমনকী কোয়ার্টার বা সেমিফাইনালও নয়। আমরা এই
এনআরসি মানছি না। ভবিষ্যতে বিদেশি শনাক্ত করে তাদের বাদ দেওয়ার জন্য যা প্রয়োজন, সব করব।’ তিনি এবিষয়ে বিরোধিতার জন্য আসু এবং এপিডব্লিউয়ের কাছে আবেদন জানিয়ে সরকারের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করছেন বলে খবর। হোজাইয়ের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের অভিযোগ, ‘আমি হিন্দু বাঙালিদের সমর্থনে এত কথা বলায়, আমার কাছে খুনের হুমকি প্রায়ই এসেছে। সেভাবেই এনআরসি কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলাকে বাংলাদেশি সংখ্যালঘুরা ভয় দেখিয়ে নিজেদের নাম জোর করে নাম নথিভুক্ত করিয়েছে।’ ব্যতিক্রম শুধু অল অসম মুসলিম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং এআইইউডিএফ। তাঁরা খুশি এনআরসি’র তালিকা দেখে। মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে উৎসবের রেশ।

Advertisement

[ আরও পড়ুন: পা ভাঙা ব্যক্তিকে কাঁধে নিয়ে জলমগ্ন রাস্তা পার করলেন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর, ভাইরাল ভিডিও]

অসমের এনআরসি কার্যালয় থেকে বিবৃতি জারি করে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, গোটা পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত। গন্ডগোলের কোনও সুযোগ নেই। যাদের নাম নেই, তাদের কাছে যেহেতু ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সুযোগ থাকছে, তাই কারও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না।
এদিকে আবার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার আলোচনাপন্থী নেতা জিতেন দত্ত সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যেসব শ্রমিকের নাম এনআরসিতে নেই, তাদের কাজে নেবে না উলফা। আর এখানেই তৈরি হচ্ছে দ্বিতীয় সংশয়টি। উত্তরপূর্বের যে রাজ্যে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় একদা বিচ্ছিন্নতাবাদ আর সন্ত্রাস দাপিয়ে বেরিয়েছিল, অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এনে থিতু করা অসমে কি
ফের মাথাচাড়া দেবে আগেকার সমস্যা? যার নেপথ্যে একমাত্র দায়ী থাকবে এনআরসি পদ্ধতির মাধ্যমে নাগরিকের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। তালিকা প্রকাশের ৩৬ঘণ্টা না কাটতেই যেভাবে এতগুলো অসংগতি ধরা পড়ছে, তাতে সেইদিন আর বেশি দূরে নেই হয়ত।

Advertisement

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ