Advertisement
Advertisement

Breaking News

মিলনদা নেই, থেকে গেল তাঁর ক্যান্টিন আর যাদবপুরের একান্নবর্তী পরিবার

যাদবপুর তাঁর কাছে ছিল এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি।

JU Mourns the demise of iconic Milanda of 'Milanda's Canteen'
Published by: Saroj Darbar
  • Posted:July 24, 2018 6:48 pm
  • Updated:July 24, 2018 6:48 pm

সরোজ দরবার: বাংলা অভিধানে কোথাও নেই ঢপের চপ। আছে বাঙালির অভিধানে। আর আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, মিলনদার ক্যান্টিনে।

সে চপ আজও আছে, আগামীতেও থাকবে। শুধু থাকলেন না আর মিলনদা নিজে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গিয়েছেন সদাহাস্যময় মানুষটি। অজস্র স্মৃতির ঘোরাফেরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেট থেকে গ্রিন জোনে। প্রাক্তনী আর বর্তমানের মনে মনে। ক্যাম্পাসের ঘাসে আর দেশে-বিদেশে।

Advertisement

মিলনদার ক্যান্টিন কি নিছকই একটি ক্যান্টিন? যাদবপুরের মাটি জানে এই ছোট্ট শব্দে মিলনদা আর তাঁর ক্যান্টিনের ব্যাপকতা ধরা যায় না। সদ্য পড়তে আসা যে যুবক তাঁর হাতের চায়ে গলা ভিজিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁচা রোদ গায়ে মেখেছে, কিংবা ঢপের চপের বিস্ময় কাটিয়ে যে যুবতী রাধাচূড়া গাছের তলাতেই কোনও এক চৈত্রমাসে যুবকের চোখে দেখেছে সর্বনাশ, তাঁর কাছে, তাঁদের কাছে মিলনদার ক্যান্টিন আসলে তীর্থ। যেখানে বেজে ওঠে আনন্দের গিটার তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে। যেখানে আঁকা হয় প্রতিবাদের পোস্টার। বিপ্লবের স্বপ্ন আর আন্দোলনের রূপরেখা খেলা করে পাশাপাশি। যেখানে স্রেফ লাল চায়েই অধ্যাপকের হাত ধরে নেমে আসেন ঋত্বিককুমার ঘটক আর নিবিষ্ট বিস্ময়ে তরুণতম ছাত্রটি শুষে নেয় জীবনের পাথেয়- তা কি স্রেফ ক্যান্টিন হয়ে থেকে যেতে পারে! মিলনদার ক্যান্টিনও তা হয়ে থাকেনি। গোটা যাদবপুরের যে প্রাণচঞ্চলতা, মিলনদার ক্যান্টিন তাই অলক্ষেই যেন হয়ে উঠেছে তার স্টোরহাউস।

Advertisement

আন্দোলনই সার, যাদবপুরে প্রবেশিকায় অনুপস্থিত ৭৫% পড়ুয়া ]

আসলে মিলনদা মানুষটাই যে অলৌকিক। ছিন্নমূলের ইতিহাস জড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের পরতে। আছে সংগ্রাম, জেদ, লড়াইয়ের গল্প। তবু তাঁর মুখে খেলে যায় উপনিষদের আলো। যেখানে চোখ পড়লে প্রশান্তি আসে। মনে হয়, পকেটে পয়সা না থাক, মিলনদার ক্যান্টিন তো আছে। মিলনদা তো আছেন, বউদি আছেন। অথচ একদিন এই ক্যাম্পাসেই তিনি নাকি থাকার ভরসা পেতেন না। তখন উত্তাল শহর। ক্যাম্পাসের ভিতর চা-বিস্কুট বিক্রি করতেন ঠিকই, কিন্তু উপার্জনটুকু সম্বল করে চলে যেতেন উলটো দিকের ফুটপাথে। সেখানেই রাত গুজরান। জীবনে সেদিন কোনও পিছুটান ছিল না। তবে স্বপ্ন ছিল। যে স্বপ্ন পরে রূপ পেয়েছে ক্যান্টিনে। তবে মিলনদা তা নিছক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান করে তোলেননি। বোধহয় সেটা তাঁর লক্ষ্যও ছিল না। হ্যাঁ, জীবনের প্রয়োজন মেটাতে হয়েছে তাঁকেও। কিন্তু যাদবপুরের মতো প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই মিলনদা আসলে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গিয়েছেন সাম্যবাদের প্ল্যাটফর্ম। যেখানে কোনও বিভাজন নেই। যেখানে এক হয়ে যায় বেলা-অবেলা-কালবেলা। আর হাত ধরাধরি করে ভবিষ্যতের স্বপ্নে বুঁদ হতে পারেন অনিমেষ-মাধবীলতারা।

মিলনদার ক্যান্টিন তো বটেই, মিলনদা নিজেও আসলে ইতিহাসের আয়না। তিনি নিজে দেখেছেন এ রাজ্যের পট পরিবর্তনের নানা অধ্যায়। যাদবপুরের ইতিহাসও বিভিন্ন সময় নানা অভিমুখের সামনে দাঁড়িয়েছে। বর্ষে বর্ষে বদলে গিয়েছে পড়ুয়ার দল। অভিভাবক ও অধ্যাপকরাও বদলেছে। যাদবপুরের ছায়াঘেরা পথে হেঁটে গিয়েছে কত দাবি-দাওয়া আদায়ের মিছিল। তবু মিলনদার ক্যান্টিন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছে সর্ববমতের মিলনস্থল। আসলে মানুষটার ব্যবহারে যে উষ্ণতা ছিল সেই ওম যে একবার পেয়েছে সে আর ভুলতে পারেনি। আজ হয়তো তাদের অনেকেই বিদেশে। কিন্তু সেই বহুদূরের ভূমিতে ঠান্ডা ঘরে বসেও যাদবপুরের নামে আজও প্রায় প্রত্যেকেই অনুভব করেন সেই ওম, সেই ভালবাসা। আবার এই শহরে বসেও কারও কারও মনে পড়ছে পুরনো সেই দিনের কথা। যেমন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় টুইট করে লিখেছেন, ‘মিলনদা চলে গেলো। ধার-বাকির হাতেখড়ি তার কাছেই। অনেক স্মৃতির ক্যান্টিন! ভাল থেকো তুমি।’

আজও তাই যাদবপুরের প্রাক্তনীদের কাছে একজোট হওয়ার মানেই ‘মিলনে চলে আয়’। এ আসলে ভালবাসার ভূমি যা আজও ধরে রাখে আমাদের তারুণ্যের দিনগুলোকে। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ গবেষণা করবেন কী করে মিলনদা ঢপের চপকে এমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন কিংবা কীভাবে ক্যান্টিনের চিরায়ত সংজ্ঞায় বদল এনেছেন মিলনদা, তা নিয়ে। আসলে তো একদা ছিন্নমূল মানুষটি থাকতে চেয়েছিলেন একটা বড় একান্নবর্তী পরিবার তৈরি করেই। আর সেই মানুষটিকে একমাত্র চেনা যায় ভালবাসার প্রথম আলোতেই। মিলনদা আর ফিরবেন না ক্যান্টিনে। পরিচিত উষ্ণতায় আর ঢেকে দেবেন না তাঁর প্রিয় পড়ুয়াদের। যা তাঁর কাছে ছিল এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি। বউদি আর দুই সন্তানের বাইরেও মিলনদার এক বড় পরিবার ছড়িয়ে আছে যাদবপুরের প্রাক্তনীদের মধ্যে। আজও তাঁরা একযোগে বলে উঠতেই পারেন, মিলনে চলে আয়।

কিন্তু কেউ যদি বলে মিলনদা নেই? ধুর তাই আবার হয় নাকি! যত্তসব ‘ঢপের চপ’!       

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ