অর্ণব আইচ: একটা সময় হাসি-আনন্দ-খেলায় মুখর থাকত ট্যাংরার দে বাড়ি। আজ তা শুনশান। চারিদিকে ফিসফাস, হা-হুতাশ। বাড়ির তিন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে একরাতে। এক ছেলে হাসপাতালে তো আরেক ছেলে জেলে। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যর ঠাঁই হোমে। আজ, শনিবার ফের একবার সেই বাড়ির দরজা খুলল। ফেব্রুয়ারির সেই অভিশপ্ত রাতের প্রায় তিন মাস পর ট্যাংরার বাড়িতে ঢুকলেন বাড়ির বড় ছেলে প্রণয় দে। সঙ্গে উর্দিধারীরা। বাড়িতে ঢুকতেই চোখের কোণা চিকচিক করে উঠল তাঁর। স্ত্রীর ছবির সামনে অঝোরে কেঁদে নিজের কৃতকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও দিলেন তিনি। বেরনোর সময়ও চোখ ছলছল করছিল। কিন্তু তাতে কি পাপ ধোওয়া যায়? বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া প্রতিবেশীদের টিটকিরি-এখন কুমিরের কান্না কেঁদে কী হবে? বউ-মেয়েকে খুনের সময় মনে ছিল না? একরাশ ক্ষোভ-ঘৃণার মেখে পুলিশের গাড়িতে উঠলেন প্রণয়। গন্তব্য় আদালত হয়ে জেল। তিনমাস পর আজই হয়তো ভাই প্রসূন দে-র সঙ্গেও দেখা হবে তাঁর! জেলেই পুনর্মিলন!
আপাতদৃষ্টিতে ধনী পরিবার। বিলাসবহুল বাড়ি, দামী গাড়ি, কী নেই! অন্তত আশপাশের লোকেরা এককথায় দে পরিবারকে বিত্তশালী বলেই জানতেন ট্যাংরা কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। অর্থের অভাব যে কখন দে পরিবারের ভীত নড়বড়ে করে দিয়েছিল, বাইরে থেকে তা বুঝতে পারেননি কেউ। তিনজনের দেহ উদ্ধার ও সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সবটা প্রকাশ্যে আসতেই দে পরিবারের পরিচিতরা রীতিমতো আকাশ থেকে পড়েছিলেন। ধীরে ধীরে জানা যায়, আর্থিক অবস্থার অবনতির জেরে দুই ভাই প্রণয়-প্রসূন কীভাবে দুই স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করেছিলেন। কীভাবে ছেলেকে নিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনজনই বেঁচে যান। আর তাতেই দুই ভাইয়ের কৃতকর্ম প্রকাশ্যে আসে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ট্যাংরায় অভিজাত দে পরিবারের দুই স্ত্রীর হাতের শিরা ও গলা কেটে ও কিশোরী মেয়েকে শ্বাসরোধ করে খুনের পর নাবালক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন দুই ভাই প্রণয় ও প্রসূন। বাড়ির ছোট ছেলে প্রসূন দে গ্রেপ্তারির পর জেলে রয়েছেন। তিনিই পরিবারের তিন সদস্যকে খুন করেছিলেন বলে অভিযোগ। দাদা প্রণয় দে সঙ্গী ছিলেন ভাইয়ের। উল্লেখ্য, দুর্ঘটনার পর থেকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে এনআরএসে ভর্তি ছিলেন। এদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁকেও গ্রেপ্তার করল পুলিশ।
গ্রেপ্তারির পর ছোট ভাই প্রসূনকে নিয়ে আগেই ট্যাংরার বাড়িতে খুনের পুনর্নির্মান করেছিল পুলিশ। এবার তাঁর কথা মিলিয়ে দেখার পালা। সেই সূত্র ধরেই এদিন প্রণয়কে বাড়িতে আনা হয়েছিল। সেই রাতে যখন দোতলা, তিনতলায় হত্যাকাণ্ড চলছে, তিনি কীভাবে-কোথায় বসেছিলেন, এদিন পুলিশ আধিকারিকদের তা দেখিয়ে দেন। ঘরে ঢুকে স্ত্রীর ছবির সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে জানান, ছেলেকেও মারতে গিয়েছিল ভাই প্রসূন। কোনওমতে তাঁকে বাঁচান। সব ‘কুকীর্তি’ জানিয়ে চোখে জল নিয়ে হয়তো শেষবারের মতো ট্যাংরা বাড়ি ছাড়লেন পরিবারে বড় ছেলে। এদিন চোখ মুছতে-মুছতে যখন বাড়ি থেকে বেরচ্ছেন প্রণয়, তখন তাঁকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিল পাড়ার লোক। উড়ে আসছিল টিটকিরি, শ্লেষ।
প্রণয়ের চোখের জলকে কুমিরের কান্নার সঙ্গে তুলনা করে প্রতিবেশীর স্বগতোক্তি-‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.