খোঁজ দিচ্ছেন তিতাস রায় বর্মন।
গন্ধটা আজকাল বেশ সন্দেহজনক। হাওয়া যে সুযোগ পেলেই মেন লাইন থেকে কর্ড লাইন ধরে ফেলছে, তা তো বুঝতেই পারছেন। সন্ধে ঘেঁষে আসলেই আপনিও একটু কাছে সরে বসছেন। আজ এসব কেউ দেখে ফেললে সে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে চলে যাচ্ছে আপনাদের একটু নির্জনতা উপহার দিতে। এই সময় আপনি মোড়ের কাকার থেকে কুলের আচার কিনলেন, যে আপনি কস্মিনকালেও কুলের আচার পছন্দ করতেন না। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওই অলুক্ষুণে হাওয়া গায়ে এসে লাগলে আপনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন, যদিও আপনি নিশ্চিত নন যে এ হাওয়া চিকেন পক্সের না প্রেমের। তবে আপনি চিকেন পক্সের সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিতেই পছন্দ করছেন। প্লেলিস্টে শুধুই অরিজিৎ সিং বা আর ডি বর্মন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সমগ্র এখন বিছানায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে পাতা উল্টোচ্ছেন। ভাবছেন, একখান লাইন লিখেই ফেলবেন কি না। যে ফোনটা করতে ইচ্ছে করছে, আজ মনে হচ্ছে সব দ্বিধা কাটিয়ে করেই ফেলবেন। আজকাল আপনার বিশেষ খিদেও পায় না, জন্ডিস ভেবে বাড়িতে রোজ নিয়ম করে পেঁপে সিদ্ধ হচ্ছে, সোনামুখ করে সেসব খেয়ে নিলেও আপনি বেশ জানেন, আপনার ওসব কিস্সু হয়নি, আপনি স্রেফ প্রেমে পড়েছেন। আর আপনার এই নিদারুণ অবস্থাতেই এসে গেল প্রেমের দিন। অর্থাৎ পুরি কায়নাত উসে তুমসে মিলানে কি ইত্যাদি ইত্যাদি…
যেসব কথা সারা বছরেও বলা হয় না, যেসব কাছাকাছি আসাগুলো দ্বিধা থরথর চূড়ে থাকে, সেসব আজকে রক্ত পলাশের মতো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থাকে। কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলো যেন কৃতার্থ বালকের মতো সহাস্য আবেশে। এদিক-ওদিক বিছিয়ে আছে একান্ত পরিসরগুলি কপত-কপতীর অপেক্ষায়। সারা বছরের আয়োজন আজ যেন মহা সমারোহে। দশকের পর দশক পেরিয়ে যায়, কত সহস্র প্রেমের সাক্ষী থাকে কলেজের এইসব কর্নার। প্রেমিক-প্রেমিকারা সেসব দিন ভুলে গেলেও তাঁদের প্রেমকাহিনি লেখা এখনও আবছা অক্ষরে।
[ ইনবক্সে চুমু একদম নয়, জেনে নিন ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে কী কী করবেন না ]
কোথায় সেসব কলেজ কর্নার?
যাদবপুর
এখানে ভরতি হওয়ার আগে যে সমস্ত কথা আগে থেকেই জানা হয়ে গিয়েছে, তা হল ঝিলপাড় আর মিলনদার ক্যান্টিন। ক্লাস শেষে মিলনদার ক্যান্টিনে চা আর ঢপের চপ খেয়ে বন্ধুদের আড্ডা নিশ্চুপে এড়িয়ে চলে যাওয়া ঝিলপাড়ে। বিকেলের দিকে পাখিদের ঝিলের জল খেতে আসা, আর এই দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রেমের জলেও নিশ্চিত ডুব। ঝিলপারের এদিকটায় বিশেষ লোকজন নেই। প্রেম দেখতে কিছু মানুষ এদিকে ঘোরাঘুরি করে থাকে অবশ্য। যদিও তাতে প্রেমিক-প্রেমিকার কিস্সুটি এসে যায় না। তবে আজকাল আরও বেশ কয়েকটা প্রেম করার জায়গা তৈরি হওয়ায় ঝিলপাড়ের সেই আকর্ষণ কিছুটা কমেছে বটে, কিন্তু তাতে মাহাত্ম্য কমেনি কিছুই। ঝিলপাড় বরং এখন আরও কিছুটা নির্জন হওয়ায় কেউ কেউ এখনও এখানেই আসে নিরিবিলির খোঁজে। অারেকটু এগিয়ে গেলেই বিবিসির বিশাল প্রান্তর। এই মাঠে প্রেম করার সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। এখনও বিকেলের দিকে, ক্লাস শেষে মাঠের এককোণায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের নির্জন আসর। যাদবপুরে প্রেম করার নতুন জায়গাগুলোর তালিকায় এখন সবার ওপরে গ্রিন জোন। গার্ড আসা অবধি এখানে প্রেমের অবাধ বিচরণ। তবে ওয়ার্ল্ডভিউয়ের দিকটায় গার্ডের তাড়া থাকে না বলে অনেকক্ষণ নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায়।
প্রেসিডেন্সি
প্রেসিডেন্সির পোর্টিকোয় প্রেম করেনি এমন কোনও ছাত্র আছে বুঝি এই কলেজে? একেকটা থামের আড়ালে এক-এক যুগল। এই প্রাচীন থামে না জানি কত প্রেম জুড়ে গেল, ভেঙে গেল। কেউ জানুক আর ছাই না জানুক, থামের ইতিহাসে এখনও সেসব স্মৃতি জ্বলজ্বলে। পোর্টিকো থেকে এগিয়ে গেলে প্রমোদদার ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে উত্তাল রাজনৈতিক আলোচনাতেই কত চোখ এক হল, কত মতানৈক্যে বিপ্লব আর প্রেমের পথ আলাদা হল। সেখান থেকেই ট্যাঙ্কের চাতালের পথ শুরু হয়। অাড্ডা অার গানের একচ্ছত্র অধিকার সেখানে। আগে এই পথটাকে ‘লাভার্স লেন’ বলা হত, এখন বেশি পরিচিত ‘কোয়াড’।
রবীন্দ্র ভারতী
যে কলেজের হাওয়ায় গান লুটিয়ে পড়ে, যেখানে দূরের ক্লাসরুম থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসে, যেখানে নাটকের মহড়ায় দৃপ্ত কণ্ঠ মাথা তুলে দাঁড়ায়, সেখানে প্রেম তো বন্ধনহীন গ্রন্থি। কলেজের মাঠে মাঠে গাছতলায় হৃদয়ে হৃদয় বিদ্ধ হচ্ছে। গাছের ছায়ায় সেসব প্রেম যেন নিশ্চিত আশ্রয়ে।
সেন্ট জেভিয়ার্স
এই কলেজের যাবতীয় প্রেম কাহিনি কলেজের গেট থেকে বেরিয়ে। প্রেম এখানে মোটেই আমন্ত্রিত নয়। নিঃশব্দ চরণে সে গেটের বাইরে অপেক্ষা করে। কলেজে ছুটির পর তার সঙ্গে দেখা। তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত কলেজের ব্যাক গেটে প্রেম করার সুযোগ ছিল। ব্যাক গেট ভেঙে দেওয়ায় সমস্ত প্ল্যান গেল ভেস্তে। বহুকাল আগে শোনা যায়, মাঠে সবুজ বেঞ্চিতে প্রেমিক-প্রেমিকারা বসে আড্ডা জমাত, তবে সেসব ফেলে আসা দিন, ভুলে যাওয়া দিন।
[ কী করে বলবেন ‘আই লাভ ইউ’? রইল পাঁচ টিপস ]
আশুতোষ কলেজ
ক্লাসের শেষ বেঞ্চে, ক্যান্টিনের কোণের সিটে প্রেমের শুরুয়াত হয় বটে, তবে এই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রেম করার পছন্দের জায়গা গাঁজা পার্ক। সেখানে নির্জনে বেশ অনেকটা সময় কাটানো যায়। সিনিয়র দাদা-দিদিদের চোখরাঙানি হেথায় নেই, নেই পরের ক্লাসের তাড়া।
স্কটিশ চার্চ
গাছে ছাওয়া হেদুয়ার রাস্তায় প্রেমের পথ প্রশস্ত। ওই পথ গিয়ে শেষ হয়েছে কলেজের গেটে। মিলেনিয়াম বিল্ডিংয়ের পিছনে, বিএড বিল্ডিংয়ের বাগানে হাতের ওপর হাত রাখার প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে ডাফ স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যায়।
এমন সব দিন সত্যিই বড্ড ক্ষণস্থায়ী। এর পরেই অন্য এক দৌড় শুরু হয়। অফিস যাওয়ার পথে এমন একটা ঝকঝকে সকালে কখনও কখনও ভেসে আসে। জানলার সিটে বসে আপনি হেসে ফেলেন। ঝিলপারে, গাছতলায়, পোর্টিকোতে কি আর কখনও যাওয়া হবে? বাড়ি ফেরার তাড়ায় যে মনখারাপ ছিল, সেই মনখারাপে কি আর কখনও পৌঁছনো যাবে? তবুও বিকেলের এই হাওয়ায় আপনার ভুল হয়ে যায়। যে ফোনটা তখন করা হয়নি, সে ফোন নাম্বারটা খুঁজতে ইচ্ছে করে। প্রিয়জনকে বলতে ইচ্ছে করে সেই সময়ের গল্প।