বয়সকালের বন্ধুত্ব। সাহচর্য, কম্পানিয়নশিপ। আলোচনায় মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুলিখন- শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী।
বন্ধুত্ব বয়সকালে হতে পারে, কিন্তু বন্ধুত্বের আলাদা করে কোনও বয়স হয় না। আমরা যখন কোনও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে বয়সের ক্যালেন্ডার দিয়ে বাঁধছি, সেটা নিয়েও আমাদের মধ্যে কিছু সামাজিক নির্মাণ কাজ করে। আমরা ধরেই নিই যে, বন্ধুত্ব মানে শুধু যেন স্কুল-জীবন, পড়াশোনার জীবন, যেন পাড়ায় খেলাধুলো করার জীবন- এটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসলে তা কিন্তু নয়। এবং সেটা কিন্তু কে কতটা দৌড়োদৌড়ি করতে পারল, মাঠে নেমে খেলতে পারল, কে কতটা পড়াশোনায় উত্তীর্ণ হওয়ার সময় প্রতিযোগিতা করতে পারল এবং বন্ধুত্ব করতে পারল- এই মাইলস্টোনগুলোর ওপর নির্ভর করে না। প্রত্যেকটা বয়সের বন্ধুত্বের প্রয়োজন বোধ, প্রত্যাশা বোধ এবং বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশের ভাষা বদল হতে হতে এগোয়, কিন্তু বন্ধুত্বটা বন্ধুত্বই থাকে। কাজেই বয়সকালেও যখন নতুন করে বন্ধুত্ব হচ্ছে, সেই বন্ধুত্বের মধ্যেও অনেক পরিণত একটা ভাষা তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ সেখানে সারাজীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় নিয়ে, অভিজ্ঞতার নানা ফসল নিয়ে আলোচনা থাকতে পারে।
[ প্রেমে পড়লে মোটা হয়? কী বলছে সমীক্ষা? ]
অনেক সময় আমরা দেখি সমমনস্ক কিছু মানুষ এই বয়সে এসে একটা কোনও ক্লাস জয়েন করলেন, সেটা তাঁরা একসঙ্গে করছেন। হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, যে কোনও একটা ডিপার্টমেন্টে পেশেন্টরা নিজেদের দেখাতে আসেন। তাঁরা জানেন যে, কোনও একটা শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁদের ফিজিওথেরাপি করতে সপ্তাহে হয়তো তিনদিন নিয়ম করে আসতে হবে। এবার এই ফিজিওথেরাপি করতে আসতে গিয়ে ইউনিটের বাইরে কোথাও একটা বন্ধুত্বের জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন এই বন্ধুত্ব? এর উত্তরে আমি বলব, কেনই বা হবে না এই বন্ধুত্ব? মানুষের তো বন্ধুত্ব, সামাজিকতা, পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোটাতেই বিশ্বাস করার কথা ছিল। এটাই তো হওয়ার কথা। সেটা হবে না কেন, সেটা আমার প্রশ্ন। যদি কারও এমনটা না হয়, সেটাই ভাববার বিষয় বলে আমি মনে করি। বন্ধুত্ব হওয়া স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তবে বয়সকালের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যে মানসিকতা কাজ করে, তা হল সেই বয়সের যে জীবনবোধ, এই মুহূর্তের যে প্রয়োজন বোধ, সেখান থেকে একটা সাহচর্য খুঁজে নেওয়া। কারণ বন্ধুত্বের মধ্যে তো কোথাও একটা কমপ্যানিয়নশিপ থাকে! এই সাহচর্যের বোধটাকে কোথাও তিনি পালন করতে চান। সেই জায়গা থেকে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
এর পাশাপাশি আরও একটা বিষয় হয়। তা হল, এই বয়সের অনেক মানুষই হয়তো দেখা যাবে চারপাশের অন্য অনেক মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। হয়তো দেখা যাবে ছেলেমেয়ে রয়েছে, কিন্তু তারা নিজেদের জগতে ব্যস্ত। হয়তো বাড়িতে তাঁর সঙ্গে কথা বলার মানুষ নেই বা কম। সেরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হতে পারে, তাঁরই মতো জীবনবৃত্তে যাঁরা রয়েছেন বা একইরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে তিনি নিজেকে অনেক বেশি কানেক্ট করতে পারবেন। তাঁদের যে পরিবার-পরিজন রয়েছে, যারা চাইলেও সময় দিতে পারছে না বৃদ্ধ বাবা কিংবা মাকে, তারাও কিন্তু আশ্বস্তবোধ করে যে, মা কিংবা বাবার একটা বন্ধুত্বের সময় কাটানোর সামাজিক জগৎ রয়েছে। তাই এই জায়গাটা কিন্তু খুব প্রয়োজনীয়, কারণ এটা হল আমাদের সম্পর্কের মধ্যে জুড়ে থাকার একটা জায়গা। বয়সকালে অনেক সময়ই নিজের থেকে বয়সে ছোট কারও সঙ্গে বা ছোট গ্রুপের সঙ্গেও খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
[ কেন একাধিক মহিলায় আসক্ত হন পুরুষরা, জানেন? ]
পার্কে বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কমবয়সিরাও নিয়মিত আড্ডা দেয়, এমন আকছার দেখা যায়। এক্ষেত্রেও কিন্তু বন্ধুত্বের জায়গাটাই বড় কথা, অসমবয়সের জায়গাটা বড় কথা নয়। এখানে দুটো মানুষের মননের কোথাও একটা মিল হয়ে যায়। মননের মিল হয় বলেই অসমবয়সি বন্ধুত্ব হয়। কোনও মানুষকে দেখি যে, সে তার জেনারেশনের সঙ্গে যতটা না কমপ্যাটেব্ল, তার চেয়ে কম বয়সি বা বেশি বয়সি মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি কমপ্যাটেব্ল। তার মানসিক বয়স, মানসিকতা, তার মননের কারণে এমনটা হয়। তবে বন্ধুত্ব যে বয়সেই হোক না কেন, তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভাল। আর বয়সকালে এই সামাজিক ভাবে জুড়ে থাকতে পারাটা খুব পজিটিভ। এর ফলে সেই মানুষটা নিজের মধে্য গুটিয়ে যেতে পারে না, নিজেকে অপাংক্তেয় মনে করে না, ব্রাত্য মনে করে না। ফলে নতুন জীবনবোধে তারা ফিরে আসে। জীবনের একটা নতুন অর্থ খুঁজে পায়। নিজেকে ভাল রাখার একটা পথ, উদ্দেশ্য খুঁজে পায়।