Advertisement
Advertisement

Breaking News

Mobile Phone

সন্তানের মোবাইলে নেশা? কীভাবে দূর করবেন? জেনে নিন চিকিৎসকের পরামর্শ

বাড়ির আবহে পড়াশোনা-খেলাধুলার পরিবেশ থাকা অত্যন্ত জরুরি।

Tips to save children from mobile addiction | Sangbad Pratidin
Published by: Akash Misra
  • Posted:October 11, 2022 4:05 pm
  • Updated:October 11, 2022 4:05 pm

খারাপ সান্নিধ্য থেকে কাউকে বের করে আনতে দরকার ভাল কিছু সংস্পর্শ। মুঠোফোনে শিশুমনে একাধিক খারাপের হাতছানি। সেই নেশা কাটাতে অন্য় ইন্টারেস্টিং কাজের সঙ্গে শিশুকে যুক্ত করা দরকার। সেই বিষয়েই সবিস্তারে কথা বললেন মাইন্ড মেন্টরস ফাউন্ডেশনের সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার অনির্বাণ রায়। শুনলেন মৌমিতা চক্রবর্তী

অয়নের বয়স মাত্র ৬ বছর। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় সারাদিন মোবাইল হাতে। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে ওর প্রায় সমবয়সি ভাইবোনরা এসেছে। কিন্তু অয়নের কোনও আনন্দ নেই। সারাদিন মুখভার। একটাই বায়না, মোবাইল (Mobile Phone) হাতে চাই। সারাদিন কার্টুন, গেম। এগুলি না হলেই বাড়ির লোককে এক মুহূর্ত তিষ্ঠোতে দেয় না। সবকিছুতে বিরক্ত হয়, পড়াশোনায় মনঃসংযোগের অভাব।

Advertisement

অন্যদিকে বছর তিনেকের অহনা। তার সামনে ফোন না দিলে কিছুতেই গলা দিয়ে খাবার নামবে না। গাল ভরে চুপচাপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। সঙ্গে বাবা-মায়েরও বিশাল হ্যাপা। মেয়েকে খাওয়ানো যেন রোজ পরীক্ষার সমান। তবে নিমেষে সমাধান যদি হাতে মোবাইলটি দিয়ে দেওয়া হয়। সমস্যা এতটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যে শিশুটিকে রীতিমতো নিয়মিত কাউন্সেলিং করে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অয়ন কিংবা অহনা, এদের মতো মোবাইল কেন্দ্রিক শৈশব এখন অধিকাংশ শিশুর। এ এক রোগের বাতাবরণ যেন। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু নয় মনে হলেও বিপজ্জনক এই নেশা। তাই খুব সজাগ থাকতে হবে শিশুর হাতে মোবাইল দেখলেই।

Advertisement

আসক্তির কারণ

স্মার্টফোনের নেশা শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বাচ্চাদের এই আসক্তি কমাতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রচুর। শুধুমাত্র মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব নয়, শরীরেও মোবাইলের খারাপ প্রভাব পড়ে। দীর্ঘ কোভিড পরিস্থিতিতে ও তার পরবর্তী সময়ে শিশু-কিশোরদের মোবাইলে আসক্তি মারাত্মক বেড়েছে। ঘরবন্দি শিশুদের কাছে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এখন খুবই সহজলভ্য। স্মার্টফোন বা মোবাইলের যন্ত্রে একসঙ্গে বিভিন্ন রকম বিনোদন হচ্ছে। গেম, নানা ধরনের বিনোদনমূলক অত্যাধুনিক অ্যাপের হাতছানি, ইন্টারনেট প্রভৃতি এক জায়গায় উপলব্ধ, যা আগে ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা, খেলাধুলা, বই পড়া প্রভৃতির মাধ্যমে ধীর গতিতে আমাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। কিন্তু মোবাইলে খেলা, ভিডিও দেখার সময় অতি সত্বর শিশুমনে আনন্দ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হলেও কল্পনাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। টিভি, মোবাইল গেম বা যে কোনও ধরনের ভার্চুয়াল এন্টারটেনমেন্ট দেখার সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ক্ষরণ হয় এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যার নাম ডোপামিন। এই ডোপামিনের ক্ষরণ আমাদের মনে এক ভাল লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। তার ফলে অতি সহজেই আমরা এই ধরনের এন্টারটেনমেন্ট মিডিয়ামগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ি।

কী ক্ষতি হচ্ছে?

মোবাইল আসক্তি কাটবে ঝোঁকে

১. শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম কম করে জগতের সমস্ত রকম বিনোদন, অভিজ্ঞতাকে সহজেই পেয়ে যাওয়ার আনন্দে শিশুদের মধ্যে শরীরের চালনাশক্তির ও মনঃসংযোগ ক্ষমতা লোপ পায়। বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করা, গল্পের বই পড়া আজকাল শিশুরা প্রায় ভুলতেই বসেছে, ফলে তাদের শরীরের সঙ্গে মনের বিকাশের অসামঞ্জস্যতা তৈরি হচ্ছে।
২. ‘ভার্চুয়াল বৈঠকখানা’-য় শিশু ও কিশোর মনের অবাধ বিচরণের সময় কোনও নজরদারির উপায় নেই। তাই খারাপ জিনিসের প্রতি তাদের আসক্তি বাড়ে। ফলে গুছিয়ে কথা বলা, ধৈর্য ধরে পড়ার বই বা গল্পের লেখকের সৃষ্টির তাৎপর্য বুঝতে পারার মতো দক্ষতা হারিয়ে ফেলছে।
৩. দীর্ঘক্ষণ স্মার্টফোনে চোখ আটকে থাকার কারণে শিশুদের ঘুমের ব্যাঘাত অন্যতম সমস্যা। ফোনের উজ্জ্বল আলো মনকে উদ্দীপ্ত করে ক্লান্তিভাব কাটিয়ে দেয়। ফলে ঘুমের সমস্যা হয়। বেশি সময় মোবাইলের আলোর সামনে থাকলে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, ব্রেন সেল সঠিকভাবে গঠিত হতে পারে না, ফলে ঘুম সঠিকভাবে হয় না ও শারীরিক ক্লান্তিতে ভুগতে থাকে।
৪. যেসব বাচ্চা মুখচোরা, সবার সঙ্গে মিশতে পারে না, বন্ধু ও সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করে আমরা বলি তাদের ‘ডিস্ফোরিয়া’ আছে। এই অবস্থা থাকলে, সে নিজেকে ভাল রাখতে ও জীবনের আনন্দ খুঁজে পেতে স্মার্টফোনকে সঙ্গী করে।
৫. আজকের দিনে সাইবার বুলিং একটি বড় সমস্যা। যা টিনএজারদের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে অনলাইনে কোনও শিশুকে প্রলুব্ধ বা হেয় প্রতিপন্ন করা হয়, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন করা হয়। প্রাপ্তবয়স্করা এমনকী কিছু টিনএজারাও এই ধরনের হীন কাজে যুক্ত থাকে। যতক্ষণ হাতে স্মার্টফোনটি থাকছে অর্থাৎ সকাল থেকে রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত সেই বাচ্চাটিকে বুলিং-এর শিকার হতে হয়। সবক্ষেত্রে না হলেও কিছু শিশু-কিশোরের উপর মানসিক নির্যাতনের পরিমাণ খুব বেশি হওয়ায় তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অভিভাবকদের অজান্তেই শিশুর মনে এই খারাপ প্রভাব পড়তে পারে স্মার্টফোনের হাত ধরে।
৬. ওয়ার্কিং মেমোরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একসঙ্গে কতগুলো ঘটনাকে আমরা মনে রাখতে পারি সেটাই, ওয়ার্কিং মেমোরি। কোনও গল্পের বই পড়ে সেটিকে পুনরায় স্তরে স্তরে সাজিয়ে মনে করার চেষ্টা একটি ওয়ার্কিং মেমোরির ব্যায়াম। কিন্তু অতিরিক্ত ফোনের ব্যবহারের জন্য ঘুম কম হওয়ায় মনে রাখার ক্ষমতা, ভাবনার সৃষ্টি, চিন্তা করার সামর্থ্য লোপ পায়। এতে এদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও ক্ষতি হয়।

[আরও পড়ুন: জিভে চুল গজিয়েছে? কীভাবে সারবে রোগ, জানালেন বিশিষ্ট চিকিৎসক]

অভ্যাস বদলের পাঠ, অভিভাবকদের ভূমিকা

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের স্মার্টফোনে হাতেখড়ি হয় তার অভিভাবকদের হাতেই। কিন্তু চাইলে অভিভাবকরাই পারেন সন্তানকে মোবাইলের আসক্তি থেকে বের করে অন্য জগতে তাদের ভুলিয়ে রাখতে। সাধারণত বাবা-মা যা করবেন সেটা দেখেই শিশু শিখবে। এই আসক্তির পিছনে তঁাদের ভূমিকাও কম নয়। নেশাই পারে নেশা ছাড়াতে। স্মার্টফোন ছাড়াও দুনিয়াতে আনন্দের আরও অনেক কিছু রয়েছে। যে জগতে স্মার্টফোনের থেকে অনেক ভাল অভিজ্ঞতার হাতছানি থাকবে, সেদিকে শিশুর ঝোঁক বাড়াতে হবে। বাচ্চার চোখে চোখ রেখে কথা বলা, তার ভিতরের সুপ্ত প্রতিভা ও ইচ্ছাগুলোকে চিনতে বা জানতে পারলে তবেই সেদিকে শিশুর ঝোঁক বাড়ানো সম্ভব। শিশুর কোমল মন থেকে মোবাইল আসক্তি কাটানো খুব সহজ নয়। তার প্রবল ঝোঁকের বা আগ্রহের জায়গাটা খুঁজে মোবাইলের সম বিকল্প ও আকর্ষণীয় জিনিসের প্রতি তার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলতে পারলে তবেই শিশুর মুঠোফোনের প্রতি আসক্তি কমবে। যেমন, ছবি আঁকা, গান গাওয়া বা কোনও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি খুদের কৌতূহল থাকলে সেই আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই ফোনের স্ক্রিনের থেকে বেশি সময় এইসব কাজে তারা ব্যয় করবে।

এছাড়া শিশুকে পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটার কোডিং ল‌্যাঙ্গুয়েজ শেখানো, বিভিন্ন রহস্য-রোমাঞ্চকর গল্পের প্রতি ঝোঁক তৈরি করা খুব দরকার। তবেই সে ধীরে ধীরে মোবাইল ভুলে ভাল নেশায় আসক্ত হবে। এর লাগাম থাকবে অবশ্যই অভিভাবকদের হাতে। শিশুর এগিয়ে চলার স্বচ্ছন্দ গতির উপর তাদের সুষ্ঠু বিকাশ নির্ভর করে, যার পরিকল্পিত রূপ দেওয়ার কারিগর হলেন বাবা-মা।

Baby

সন্তানকে সময় না দিয়ে তার বদলে হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেওয়া বা টিভিতে কার্টুন চালিয়ে দেওয়াটা অনুচিত। অনেক শিশু একাকিত্বের কারণে মোবাইল ফোনের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের প্রথমত খেয়াল রাখা উচিত শিশু স্মার্টফোন ব্যবহার করেও প্রতিদিনের কার্যকারিতা সঠিকভাবে পালনে সক্ষম কি না। যদি তা নির্দ্বিধায় করে সেক্ষেত্রে ১-২ ঘণ্টা ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যায়।

বাড়ির আবহে পড়াশোনা-খেলাধুলার পরিবেশ থাকা অত্যন্ত জরুরি। ঘরের ছোট্ট খুদেটির সঙ্গে বাবা-মায়ের কোয়ালিটি টাইম কাটানো দরকার।

রাতে ঘুমানোর আগের একঘণ্টা ও সকালে ঘুম ভাঙার পর প্রথম এক থেকে দুই ঘণ্টা খুদেটির ফোন ব্যবহার নিষেধ রাখতে হবে। এই নিয়ম বাবা-মায়ের জন্যও প্রযোজ্য হলে ভাল। উল্লেখযোগ্য, সপ্তাহে একটি দিন বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের জন্য একটি স্মার্টফোনবিহীন দিন রাখতে হবে, সেদিন প্রত্যেক সদস্যের ছুটির পর শিশুটির সঙ্গে সময় কাটানো দরকার।

স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়লে শিশুর আনন্দসূচক ক্রমে কমতে থাকে ও তারা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। ওদের মুঠোফোনের বাইরের পৃথিবীর সংস্পর্শে রাখা বর্তমান প্রজন্মের অভিভাবকদের মূল দায়িত্ব। স্ক্রিনজনিত বিনোদনের বদলে খেলাধুলা ও নিয়মানুবর্তিতার সঞ্চার করা ভীষণ প্রয়োজন।

[আরও পড়ুন: হার্ট অ্যাটাকের আগের সাতদিন, কী করে বুঝবেন হৃদরোগের সংকেত]

 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ