সুমিত বিশ্বাস: বাইরের নানা সামগ্রী দিয়ে অন্দর তো সাজান। বাড়ির বাইরে দামি রঙের প্রলেপও লাগান। কিন্তু এবার একটু অন্যভাবে বাড়ি সাজানোর কথা ভাবতেই পারেন। দেওয়াল চিত্র দিয়ে। না, বাইরে থেকে কেনা কোনও স্টিকার বা বিখ্যাত কারও ছবি দিয়ে সাজানোর কথা বলছি না। নিজের হাতে বাইরের দেওয়ালে এঁকে ফেলুন না, যা মন চায়। যেমনটা করছেন পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, বাঘমুন্ডির আদিবাসী মহিলারা। মাটির দেওয়ালে তাঁরা নিজের হাতে ফুটিয়ে তুলছেন নানা চিত্র। তাতেই একচিলতে মাটির ঘর হয়ে উঠছে রঙিন, আকর্ষণীয়।
উঠোন, দেওয়াল বা হেঁশেল। পলাশ,অপরাজিতার পাঁপড়ির রঙ কিংবা সিম, কাঠকয়লা কিংবা খড় পুড়িয়ে তাঁদের উৎসব সহরায়ের আগে ঘরকে রাঙিয়ে তুলছেন আদিবাসীরা। লতাপাতা, পশুপাখি, পটের নানা ছবি-সহ দু’আঙুলের শিল্পশৈলীতে ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে ধূসর দেওয়ালগুলি।কালীপুজোর পর সহরায় পরবের আগে এই যে দেওয়ালে আঁকার কাজ, এও উৎসবের প্রস্তুতিরই একটা অংশ। যা সানন্দে করে থাকেন আদিবাসী রমণীরা। তাই আদিবাসী মহল্লায় এখন চরম ব্যস্ততা। রং আর আঙুলের শিল্পকর্মে যেন ঘরকে রঙবাহারি করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে।
[ আরও পড়ুন: জানেন, ভূত চতুর্দশীতে কেন চোদ্দ শাক খেতে ও বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালাতে হয়?]
এই দেওয়াল চিত্র আজ নতুন নয়। চিত্রশিল্পের ইতিহাস বলছে, সেই প্রস্তর যুগ থেকেই আদিম মানুষজন গুহায় ছবি আঁকতেন। শিকারে যাওয়ার আগে তারা কল্পিত বন্যপ্রাণের ছবি ফুটিয়ে তুলতেন গুহার দেওয়ালে। তা এতই নিখুঁত এবং প্রাণবন্ত যে প্রশিক্ষিত অঙ্কনশিল্পীদেরও লজ্জায় ফেলে। ৩৬ হাজার বছরের পুরনো আলতামিরার গুহাচিত্র আজও শিল্পপ্রেমীদের চুম্বক আকর্ষণে টেনে রাখে। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “দেওয়ালে ছবি ফুটিয়ে তোলা সেই প্রস্তর যুগ থেকেই চলছে। যা এখন আদিবাসীদের অন্যতম সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের সহরায় পরবের আগে এই দেওয়াল চিত্র সত্যিই চোখ টানে।”
তাই বান্দোয়ান থেকে বাঘমুন্ডি, সাঁতুড়ি থেকে হুড়া। কুঁড়ে ঘরের দেওয়ালে আঙুলের আঁকিবুকিতে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া শিল্পকর্ম। দেওয়াল জুড়ে যেন তাঁদের জীবন কথা। সুখদুঃখ থেকে হাসি কান্না। সেই রঙবাহারি দেওয়াল চিত্রের কথাই একান্ত আলাপচারিতায় বলছিলেন আদিবাসী বধূ তথা পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি প্রতিমা সরেন। “আমাদের ঘর–দুয়ার সত্যিই খুব ছিমছাম থাকে। নিকানো উঠোন থেকে দেওয়াল। আর সহরায় উৎসবের আগে তাতে নতুন ছোঁয়া লাগে। উৎসবের প্রায় একমাস আগে থেকে এই ঘর রাঙিয়ে তোলার প্রস্তুতি চলে।
এখনও আমি শ্বশুরবাড়িতে এই কাজ করে থাকি। তবে আগের মতো আর সময় দিতে পারি না। আমাদের এই শিল্পকর্ম সবই পরিবেশ বান্ধব। পরিবেশ–প্রকৃতির সাহায্যেই আমরা এই কাজ করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু মহিলারা হাতের দুই আঙুল দিয়েই এই শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলেন।” প্রথমে লাল মাটি দিয়ে নিকানো হয় ঘরদোর। তারপর তা শুকিয়ে গেলে, নানান রঙে রাঙিয়ে শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়। ওই দু’আঙুলের জাদুতেই বাজিমাত।
[ আরও পড়ুন:ধনতেরসে ১০টি জিনিস ভুলেও কিনবেন না, ভাগ্য ফেরাতে কিনুন এই বস্তুগুলি]
আপনিও দেখুন না, এভাবে নিজের শিল্পকর্মকে এমন মৌলিকত্বের মোড়কে তুলে ধরতে। কে বলতে পারে, যে কোনও নামী ইন্টিরিয়র ডিজাইনারের চেয়ে আপনার কাজ হয়ত অনেক গুণে সুন্দর, আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
ছবি: অমিত সিং দেও।