এক পাত্রে কেল্লা ফতে। পৃথিবী জোড়া খ্যাতি। ইতিহাস ও কনটেম্পোরারি সব পাতেই হিট। কীভাবে? লিখছেন বর্ণিনী মৈত্র চক্রবর্তী।
ওয়ান পট মিল। বাংলা করলে দাঁড়ায় – এক বাটি ভোজ। সময়ের অভাবে বা পকেটে টান পড়লে কিম্বা টানা কাজের ফলে ক্লান্তি – ওয়ান পট মিল এককথায় লাইফ সেভার। বাইরে কোথাও থেকে বেড়িয়ে ফিরলে বা খুব ক্লান্ত থাকলে বাড়ির মায়েরা চালে-ডালে অর্থাৎ খিচুড়ি নয়তো সিদ্ধভাত করে নেন। গরমাগরম ঘি ছড়িয়ে বা আটারলি বাটারলি ডেলিশাস মাখন মিশিয়ে হাপুস-হুপুসে পাত শেষ। সে এক অপূর্ব রসনাতৃপ্তি।
একটি বাসনে অল্প সময়ের মধ্যে নানাবিধ কিছু মিলেমিশে সুস্বাদু ব্যঞ্জন – এই হল ওয়ান পট মিল। অর্থাৎ এক বাসনে, এক আসনে, এক ব্যঞ্জনে কেল্লা ফতে। তা চাল-ডালের মিশ্রণের খিচুড়ি থেকে শুরু করে, মাছ-মাংস-সবজি দেওয়া স্টু-ও হতে পারে। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাওয়া। এর মধ্যে সময়,অর্থ দুয়েরই যেমন সঞ্চয় আছে, আবার মেলামেশারও আনন্দ রয়েছে। সে খাবারের উপকরণই বলুন বা একসঙ্গে সবাই বসে খাওয়ার কথাই বলুন। খিচুড়ির তো এমনই অস্তিত্ব যে, তা পাকাতে আগুনেরও মাঝেমাঝে প্রয়োজন হয় না।
[রকমারি শাকের আমিষ পদে স্বাদে আনুন চমক, নিশ্চিন্ত থাকুন স্বাস্থ্যেও]
ওয়ান পট রাইস
খিচুড়ি নিয়ে তো নতুন করে বাঙালিকে বোঝানোর কিছু নেই। চাল-ডাল থেকে শুরু করে জীবন এবং জীবনচর্চায় খিচুড়ি তো পেকেই আছে। আবার চালের সঙ্গে মাংস ও আলু সহযোগে যে অতি উপাদেয় পদটির রন্ধন হয়, তার উৎসের ইতিহাসও ওয়ান পট। নবাবের শ্রমিকরা কাজ করতে করতে যে চাল,মাংসের সংমিশ্রণে নিজেদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতেন, সেটাইএখন সুস্বাদু ‘বিরিয়ানি।’
পৃথিবীতে চাল এবং এটা, ওটা মিলিয়েমিশিয়ে বেশ একটি পাত্রেই অনায়াসে পেকে চলেছে হরেক পদ। যেমন ধরা যাক পায়য়া। স্প্যানিশদের জাতীয় খাদ্য এটি। নিরামিষ পায়য়া পাওয়া গেলেও প্রথমদিকে খরগোশের মাংস এবং চাল মিলেমিশে তৈরি হত এই রেসিপি। এরপর সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর গায়েও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। তবে সনাতনী পায়য়ার উপকরণে সাদা চাল, সবুজ বিন্স, হোয়াইট বিন্স, মাংস, স্নেল, স্যাফ্রন, রোজমেরি থাকা আবশ্যিক। সুদূর পূর্বে ‘কঞ্জি’ আর এক ধরনের চালের ওয়ান পট মিল। মাছ থেকে সস সবই মেলে এই প্রাতরাশে। ইতালির ‘রিসোতো’-ও এই তালিকাভুক্ত। ইতালীয় খিচুড়ি বললে ভুল হবে না। ভাত মাখনে নাড়াচাড়া করে এর মধ্যে সসেজ, পেঁয়াজ, সবজি মিশিয়ে ফুটিয়ে তৈরি হয় এই পদ।
ল্যাঙ্কাশায়ার হটপট
ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমে ল্যাঙ্কাশায়ার। শিল্পায়ন পূর্ববর্তী সময়ে সেখানে সুতো বুনতে বুনতে মাংসের টুকরো অল্প আঁচে চাপিয়ে দেওয়া হত। কাজ শেষ হতে হতে রান্না শেষ হয়ে গেলে খাওয়া। আলাদা করে রান্নার ঝক্কি ছিল না। শিল্পায়নের পরবর্তী সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে রান্না করার সময় থাকত না। বাড়ির মহিলারা কাজের জায়গায় গিয়ে পুডিং বা স্টু চাপিয়ে দিতেন। এখান থেকেই ল্যাঙ্কাশায়ার হটপটের উৎপত্তি। সাধারণত এই স্টু্-তে মাংসের সঙ্গে থাকে স্লাইস করে কাটা আলু আর পিঁয়াজ। এরপর স্থানীয় নানা সবজি মিশছে এতে। ক্রমে বেকন, কিডনি বিন্সের মতো উপকরণও ব্যবহার করা হয়। সাধারণত পুরু কোনও পাত্রে তৈরি হয় এই পদ। তাই হটপট।
[উইক-এন্ড জমে উঠুক উষ্ণ চাইনিজ রোল, স্যুপে]
ওয়ান পট ও নাৎসি
অক্টোবর ১, ১৯৩৩। প্রেক্ষাপট জার্মানি। রবিবারের দ্বিপ্রাহরিক ভোজ। বহু যুগ ধরে চলে আসা রোস্ট ও আলুসেদ্ধর মেনুতে যেন ইতি পড়ল। ঠিক তার ন’মাস আগে নাৎসিরা দেশ শাসন করতে শুরু করেছে। রোস্টের পরিবর্তে ঘরে ঘরে শুরু হল ওয়ান পট মিল খাওয়ার প্রচলন। কেউ চেখেছিলেন আইরিশ স্টু্, কারওর মেনুতে ছিল স্যুপ অথবা ম্যাকারনি মিলানিজ। কিন্তু তিনটে ব্যাপার সবার ক্ষেত্রে এক ছিল – খাবার হতে হবে সুলভ, রান্না হবে একটি পাত্রে অর্থাৎ ওয়ান পট এবং তৃতীয়ত, নাৎসিদের অনুমোদিত খাবার হতে হবে। এরই নাম আইনটোফজনট্যাগ (Eintopfsonntag) ক্যাম্পেন। নাৎসিদের দ্বারা প্রচলিত এক রীতি, যাতে মাসের প্রথম রোববারে প্রত্যেক জার্মান পরিবারে এক খাবার খাওয়া হয়। এর থেকে সঞ্চিত অর্থে গরিব এবং প্রবীণ মানুষকে শীতবস্ত্র ও খাবারের জোগান দেওয়া হত। এই বাৎসরিক দান বা চ্যারিটি ‘উইন্টারহিল্সসোয়্যার্ক’ নামে পরিচিত। এই প্রথা পালন করার নির্দেশ ছিল। ওইদিন বাড়ি বাড়ি টাকাও সংগ্রহ করা হত। এমনকী রেস্তোরাগুলোতেও ওইদিন এই খাবারই পাওয়া যেত। বলা বাহুল্য, হাজার হাজার রেইক্সস্মার্কস (জার্মান মুদ্রা) সংগ্রহ করা গিয়েছিল। মতান্তর, বিরোধ থাকলেও এই প্রথা জনপ্রিয় হয়েছিল।
জোল্অফ
একটি খাবারকে সেলিব্রেট করতে একটি দিন উদ্যাপন! এমন ঘটনা বিরল। নাইজেরিয়াতে ‘ওয়ার্ল্ড জোল্অফ ডে’ বলে একটি দিন নির্ধারিত রয়েছে। সেনেগাল, ঘানা, ক্যামেরুন এবং পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলিতেও এইদিন উদ্যাপিত হয়। এটি একটি জনপ্রিয় আফ্রিকান ডিশ। এতে চালের সঙ্গে মাছ বা মাংসের সঙ্গে মেশে নানা মশলা। একে ‘বেনাচিন’ নামেও ডাকা হয়। এমনই জনপ্রিয় এই ওয়ান পট যে, পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে এর বিস্তার ঘটেছে। সেনেগাম্বিয়াল অঞ্চল, যেখানে একসময় জোল্ফ বা ওল্ফ সাম্রাজ্য ছিল, সেখান থেকেই এই পদ এসেছে। ওল্ফ-এ একে ওয়ান পট হিসাবে অ্যাখ্যা দিতে ‘জোল্অফ’ নামকরণ। আর এই খাবারের দিনটি উদ্যাপন করতে নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
স্বাদের ত্রিকোণ, রুটি-সুজি-মিষ্টিতে রান্নাঘরে পদ্মাপাড়ের পদ
কেন করবেন?
১. সাধারণত যে কোনও ওয়ান পট কুকিং-এর প্রিপারেশনে সময় বাঁচে। খাবার আঁচে বসিয়ে দিয়ে হাতের অন্যান্য কাজ সেরে নেওয়া যায় অনায়াসে।
২. যে কোনও ওয়ান পট ডিশে উপকরণ কম লাগে। সাধারণত কোনও তরকারি বা মাংস করতে যতটা সবজি বা মাংস খরচা হয়, তার থেকে অনেক কম পরিমাণে রান্না করা যায়। সঞ্চয়ও হয় বেশি।
৩. কস্ট কাটিং করতে বা এককথায় পকেট ফ্রেন্ডলি।
৪. ওয়ান পট মানে ওয়ান পট। অর্থাৎ একটি পাত্রেই রান্না হবে। অর্থাৎ বেশি বাসনকোসন ধোয়ার ঝক্কিও নেই।
৫. ওয়ান পট মিল-এ প্রচুর রকমভেদ। রাইস, পাস্তা, সবজি, মাছ, মাংস, ডাল, বিন্স সব মিলিয়েমিশিয়ে অসাধারণ সমস্ত পদ তৈরি হয় এক লহমায়।