সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ঠান্ডা নিয়ে আর আফশোস নেই। ক্রিসমাস, নিউ ইয়ারে অনেক লম্ফঝম্ফ হয়েছে। এবার কাজে ফিরলেও মন যে উড়ু উড়ু। জমিয়ে শীত বেড়ানোর ইচ্ছেগুলো আবার জাগিয়ে দিয়েছে। তবে ছুটি যে হাতে কম। দিন দুয়েক ম্যানেজ করতে পারলে আপনার ঠিকানা হতে পারে পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট। আজ টোটোয় রূপসী বাংলার এই অহঙ্কার নিয়ে রইল দু-চার কথা।
[এ রাজ্যে আছে আরও এক গঙ্গাসাগর, পুণ্যস্নানে তৈরি তো?]
প্রকৃতি এবং ইতিহাস। গড়পঞ্চকোট নিয়ে কিছু বললে ঘুরেফিরে আসে এসব কথা। বর্তমান পুরুলিয়ার নিতুড়িয়া থানা এলাকার গড়পঞ্চকোট ছিল পঞ্চকোট রাজাদের রাজধানী। মাথা উঁচু দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চকোট মন্দির এবং অজস্র স্থাপত্য সেকথা নীরবে প্রমাণ দিয়ে যায়। মন্দিরে কোনও দেবদেবীর মূর্তি নেই। যা পঞ্চতন্ত্র বা পঞ্চরত্ন মন্দির নামে পরিচিত। পর্যটনের প্রসারে মন্দির সাজিয়ে তুলিয়েছে রাজ্য তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের পূরাতত্ত্ব বিভাগ। টেরাকোটার অপরূপ কাজ পর্যটকদের মন ভরিয়ে দেয়।
[প্রকৃতির স্বাদ এবং পরিযায়ী পাখি চাক্ষুস করতে ঘুরে আসুন সিঙ্গি গ্রামে]
সবুজে সবুজ
পঞ্চকোট পাহাড়ের উচ্চতা ২১০০ ফুট। গোটা এলাকা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। ১৮ বর্গ কিমি বিস্তৃত এই এলাকায় কী নেই। শাল, পিয়াল, মহুল, হরিতকি থেকে নানারকম বনৌষধি গাছগাছড়ায় সমৃদ্ধ এই পাহাড়। প্রায় দুশোর বেশি গুল্ম রয়েছে পঞ্চকোটে। যার মধ্যে রয়েছে সর্পগন্ধা, অর্জুন, অনন্তমূলের মতো ভেষজ ওষুধ তৈরির গাছ। শোনা যায় সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে এখান আসতেন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা। ভার্জিন ফরেস্ট। স্থানীয় নাম পাঞ্চেত।
[ভোরের মতো পড়ন্ত বিকেলেও মোহময়ী, গজলডোবা যেন স্বপ্নের ঠিকানা]
অকৃপণ প্রকৃতি
গড়পঞ্চকোট জুড়ে রয়েছে অজস্র প্রজাপতি। পাহাড় পথে এগোলেই মনে হবে রংয়ের বর্ণমালা। বাহারি সব প্রজাপতি। আর জঙ্গলে রয়েছে হরেক রকম পাখি। কটেজের কাচের জানালায় ঠোক্কর মেরে আপনার ঠিক ওরা ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। সুপ্রভাতের এমন অভিজ্ঞতা আর কোথায় পাবেন। আর এই এলাকার ভৌগলিক অবস্থান এমনই যে মনে হবে মেঘ আপনাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। গড়পঞ্চকোটের জঙ্গলে প্রচুর ময়াল ও পাইথন রয়েছে। জঙ্গলপথ দিয়ে যেতে হলে তাই একটু সাবধান। রাস্তায় বেরিয়ে আসতে পারে সাপ। কিংবা নাকে আসতে পারে বুনো বন্ধ। কপাল ভাল থাকলে ঝকঝকে পিচের রাস্তায় দেখা হতে পারে হায়নার। লং ড্রাইভ বা হাঁটা পথ ধরলে পঞ্চকোটের কুয়াশাঘেরা সকাল অন্যরকম আমেজ আসতে পারে। মনে হতে পারে এ যেন জঙ্গলমহলের ডুয়ার্স। ইচ্ছে হলে বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে লোকনৃত্য দেখার সুযোগ মিলবে। এর জন্য কটেজের কর্তৃপক্ষর সঙ্গে কথা বললেই দেখে নেবেন বিনোদনের ব্যবস্থা মজুত। যারা একটু অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসেন তাদের জন্য রয়েছে পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা।
থাকার পরিবেশও মনোরম
পাহাড়ের গা ঘেঁষে রয়েছে সরকারি কটেজ। বেসরকারি সংস্থাকে লিজ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও একাধিক বেসরকারি কটেজ রয়েছে। অপরূপের পরিবেশের মতো মানানসই কটেজগুলির অন্দর ও বাইরের সাজ। কটেজে ঢুকলেই মিলবে মাটির গন্ধ। অন্দরসজ্জায় পুরুলিয়ার সংস্কৃতি ছাপ। বন উন্নয়ন নিগমের ওয়েবসাইট থেকে বুকিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
[পাহাড়ে বেড়াতে যাবেন? নিখরচায় সাফারির সুযোগ ব্রিটিশ আমলের ল্যান্ডরোভারে]
এক্কেবারে পরিবেশবান্ধব
মন ভাল করার ঠিকানা। নোংরা করার ইচ্ছে না হওয়াটা স্বাভাবিক। তবু যারা প্লাস্টিক যেখানে সেখানে ফেলেন তারা একটু সচেতন থাকবেন। গোটা এলাকায় প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে উটকো ঝামেলায় থাকবেন।
পঞ্চকোটের সঙ্গে বোনাস
পঞ্চকোটে যাওয়ার পথ ভারী সুন্দর। সাইট সিয়িং হিসাবে নাগালেই রয়েছে পাঞ্চেত জলাধার। সূর্যাস্তর সময় সেখানকার মায়াবী পরিবেশ আনমোনা করার পক্ষে যথেষ্ট। এই জলাধারের পাশেই রয়েছে ডিভিসির পার্ক। হুট করে কীভাবে বিকেলটে পেরিয়ে যাবে বুঝতেই পারবেন না। গড়পঞ্চকোট থেকে ১০-১২ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে পশ্চিম বর্ধমানের সীমানা লাগোয়া বিখ্যাত কল্যাণেশ্বরী মন্দির। মন্দিরে পুজো দেবেন আর পাশের মাইথনে না গেলে হয়। পঞ্চকোট ট্যুরে এসে মাইথনে নৌকাবিহার করতেই পারেন। আর গড়পঞ্চকোট থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদে স্নেক পার্কেও ঢুঁ মারা যায়।
কোন পথ ধরবেন?
কলকাতা থেকে রাস্তা ধরলে আসানসোল থেকে ৩০ কিলোমিটার। রেল শহর আদ্রা থেকে ২৫ কিলোমিটার। পশ্চিম বর্ধমানের বরাকরের আরও কাছে। মাত্র ১৪ কিলোমিটার। পুরুলিয়া থেকে ৫০ কিলোমিটার পথ। এই সমস্ত জায়গা থেকে গাড়ি ভাড়া করলে সহজে পৌঁছে যাবেন গড়পঞ্চকোটে। ভাড়াও নাগালের মধ্যে।
দক্ষিণা কত?
দেড় হাজার টাকা থেকে শুরু। খাবার ও অন্যান্য খরচ আলাদা। গাড়ি নিয়ে যাওয়া ভাল। ভাড়া গাড়িও করতে পারবেন। তবে ততটা পোষাবে না।
ছবি: অমিত সিং দেও