BREAKING NEWS

১০ চৈত্র  ১৪২৯  শনিবার ২৫ মার্চ ২০২৩ 

READ IN APP

Advertisement

কলকাতার এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলির দোল উৎসব সম্পর্কে জানেন?

Published by: Sandipta Bhanja |    Posted: March 7, 2020 9:38 pm|    Updated: March 7, 2020 9:38 pm

Kolkata's traditional holy celebration of renowned families

কলকাতা ও তার আশপাশের কয়েকটি পরিবারের দোল উৎসব। লিখছেন ইন্দ্রজিৎ দাস

বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দোল

১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুরের জমিদার লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় (অনেকের মতে মজুমদার) মান সিংহের কাছ থেকে ৮ খানা নিষ্কর পরগনা লাভ করে বড়িশায় বসবাস শুরু করেন। তিনিই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আদিপুরুষ।
১৬১০ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার বুকে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন আটচালার দুর্গামণ্ডপে। এই আটচালার পাশেই এক দালান রীতির মন্দিরে রয়েছেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের গৃহদেবতা রাধাকান্ত। এই রাধাকান্তকে নিয়েই প্রতি বছর দোল উৎসবে মেতে ওঠেন পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষেরা। দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় পরিবারের চণ্ডী মন্দিরের সামনের মাঠে অর্থাৎ চণ্ডীর মাঠে হয় চাঁচর বা নেড়া পোড়ানো। ওইদিন মন্দিরের নারায়ণ শীলাকে চাঁচর উৎসবে নিয়ে আসা হয়। দোলের দিন ভোরবেলায় নামগান করতে করতে দোলনায় করে রাধাকান্তকে মন্দির থেকে দ্বাদশ শিব মন্দিরের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। রাধাকান্তের সঙ্গে চলেন মন্দিরের শিব, গোপাল, নারায়ণ ও অন্যান্য দেবদেবীরা।

ওইখানেই সারাদিন ধরে চলে রাধাকান্তের পুজো। বাতাসা ও মঠের লুঠ দেওয়া হয়। সবাই বিগ্রহতে আবির দেন। আবিরে মাখা রাধাকান্তকে দেখে মনে হয় যেন তিনিও সবার সঙ্গে দোলখেলায় মেতে উঠেছিলেন। খেলা শেষ হলে রাধাকান্ত আসেন আটচালার দুর্গাদালানে। সেখানে হলুদ, ঘি, মধু, চন্দন মাখিয়ে রাধাকান্তকে স্নান করানো হয়। স্নানের পর রাধাকান্ত মন্দিরে ফিরে এলে লুচি, পাঁচরকম ভাজা ও মিষ্টি দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। দোলের দিন পূর্ণিমা থাকায় অন্নভোগ দেওয়া হয় না। পরদিন সকালে রাধাকান্তকে অন্নভোগ দেওয়া হয়। চারশো বছর ধরে রাধাকান্তর দোলখেলার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে দ্বাদশ মন্দিরে থাকা বারোটি শিবলিঙ্গ।

আমাদপুর চৌধুরি জমিদার বাড়ির দোল

পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি রেলস্টেশন থেকে দু’কিলোমিটার দূরে এক প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত গ্রাম আমাদপুর। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশ কিছু আগে থেকে এখানকার জমিদার চৌধুরী পরিবারের বসবাস। আজ সারা আমাদপুর গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে চৌধুরী পরিবারের জমিদারির নিদর্শন। বিশাল বড় চৌধুরী পরিবারের অট্টালিকা, মা আনন্দময়ীর মন্দির, চারটে আটচালা শিবমন্দির, গৃহদেবতা রাধামাধবের টেরাকোটা মন্দির আর দোলমঞ্চ। প্রতি বছর এই দোলমঞ্চেই গৃহদেবতা রাধামাধবকে নিয়ে হয় দোল উৎসব। দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় পালিত হয় চাঁচর।

ওইদিন নারায়ণ শিলাকে নামগান করতে করতে নিয়ে আসা হয় দিঘির পাড়ের রাসমঞ্চে। চাঁচরের শেষে নারায়ণ শিলা দোলমঞ্চ তিনবার প্রদক্ষিণ করে আবার ফিরে যান মন্দিরে। দোলের দিন ভোরে মঙ্গলারতির পর রাধামাধবকে মন্দির থেকে দোলমঞ্চে নিয়ে আসা হয়। রাধামাধব দোলমঞ্চে একটি দোলনার ওপর বসেন। প্রথমে এখানে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয়, যা ‘দেবদোল’ নামে প্রচলিত। দেবদোলে দেবতারা নিজেদের মধ্যে রঙিন আবির খ্যালেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা এবং গ্রামের স্থানীয় মানুষ একত্রে রাধামাধবকে আবির দেন। তারপর প্রবীণদের পায়ে আবির দিয়ে শুরু হয় দোলখেলা। নির্মল প্রকৃতির মাঝে দোলমঞ্চে রাধামাধবের সামনে সব বয়সের মানুষের একসঙ্গে দোলখেলা-এ এক মনোরম দৃশ্য। দোলখেলার শেষে রাধামাধব মন্দিরে ফিরে যান। মন্দিরে রাধামাধবকে ফল, লুচি ও সন্দেশ ভোগ নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যারতির পর রাধামাধবকে শয়ন দেওয়া হয়।

শোভাবাজার রাজবাড়ির দোল

১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজারে তাঁর রাজপ্রাসাদের ঠাকুরদালানে শ্রীশ্রী গোবিন্দ জিউর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে আজও শোভাবাজার রাজবাড়িতে শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দজিকে নিয়ে মহা সাড়ম্বরে দোল উৎসব পালিত হয়ে আসছে। দোলের আগের দিন হয় চাঁচর অর্থাৎ নেড়া পোড়া। যার আর এক নাম বহ্ন্যুৎসব। এটি শ্রীবিষ্ণুর অসুর দলনের বিজয়োৎসবের প্রতীক। একটি বাঁশকে খড়ের আঁটি দিয়ে মুড়ে মিনারের মতো বানিয়ে মাটিতে পোঁতা হয়। সন্ধ্যায় শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দজির সামনে পুজো, আরতি ও হোমের পর হোমের জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে চাঁচরে আগুন ধরানো হয়।

দোলের দিন সকালে হয় দেবদোল বা নারায়ণের দোল। সকালে পুজোর পর নারায়ণকে ফাগ বা আবির দেওয়া হয়। তারপর হয় নারায়ণের অভিষেক। বিভিন্ন তীর্থের জল, যব, দূর্বা দিয়ে স্নান করানো হয়। এরপর রাধাগোবিন্দজিকে দোলনায় দোলানো হয়। মতিচুর, দরবেশ, পান্তুয়া, মিষ্টি গজা, নোনতা গজা ও খাস্তা কচুরির ভোগ গোবিন্দজিকে নিবেদন করা হয়। ভোগের পর রাধাগোবিন্দকে আবির দেওয়া হয়। দোলখেলার শেষে রাধাগোবিন্দর অভিষেক বা স্নান হয়। বিগ্রহের গায়ের আবির সেবায়েতদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। পরিবারের সবাই সেই আবির মাথায় নিয়ে শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দকে প্রণাম করেন।

দশঘরা বিশ্বাস পরিবারের দোল

হুগলি জেলার শৈবতীর্থ তারকেশ্বরের কাছে এক প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম দশঘরা। এই দশঘরার বিশ্বাস পাড়ায় ছড়িয়ে রয়েছে এখানকার একসময়ের জমিদার বিশ্বাস পরিবারের অসাধারণ কীর্তি। গোপীসাগর নামে এক দিঘির পাড়ে রয়েছে বিশ্বাস পরিবারের কাছারি বাড়ি, নহবত খানা, শিবমন্দির, রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ ও অসাধারণ টেরাকোটার কাজ সমৃদ্ধ পঞ্চরত্ন গোপীনাথ জিউর মন্দির। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে সদানন্দ বিশ্বাস গোপীনাথ মন্দির করে গোপীনাথ জিউয়ের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।

সেই থেকে দোলপূর্ণিমায় গোপীনাথ জিউয়ের দোল উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এখানেও দোলের আগের দিন হয় চাঁচর। দোলের দিন সকালে গোপীনাথ জিউ আসেন দোলমঞ্চে। দোলমঞ্চে গোপীনাথ জিউয়ের পুজোর পর পরিবারের সকলে এবং গ্রামের মানুষ আবির দিয়ে প্রণাম করেন গোপীনাথ জিউকে। তারপর গোপীনাথ জিউয়ের সামনে শুরু হয় দোলখেলা। ফাগের রঙে রাঙা হয়ে ওঠে দোলমঞ্চ সংলগ্ন মাঠ ও গোপীসাগর দিঘি। খেলার শেষে মন্দিরে ফিরে যান গোপীনাথ, সেখানে নতুন পোশাকে সাজিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়।

Sangbad Pratidin News App: খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে লাইক করুন ফেসবুকে ও ফলো করুন টুইটারে