Advertisement
Advertisement

দেবী পার্বতীর সংসারে অতিথি যখন আপনি!

এখানে জমিয়ে সংসার পেতেছেন পার্বতী৷ স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সুখের সংসার তাঁর৷ দেশ-বিদেশের শিব-ভক্তের ভিড় এই উপত্যকায়৷

Spend Some Days In Parvati Valley, Experience Divine Familyhood
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:September 10, 2016 1:59 pm
  • Updated:June 12, 2018 4:49 pm

তিতাস: পার্বতী উপত্যকা! এখানে জমিয়ে সংসার পেতেছেন পার্বতী৷ স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সুখের সংসার তাঁর৷ দেশ-বিদেশের শিব-ভক্তের ভিড় এই উপত্যকায়৷ কার্তিকেরও ফ্যান ফলোয়িং এখানে কম নয়! তবে, সবাইকে ছাপিয়ে, সবাইকে ব্যাকফুটে ফেলে এখানে বিরাজ করছেন স্বয়ং দেবী পার্বতী৷ উপত্যকা ভেদ করে পার্বতীর সে কী বয়ে যাওয়া! এখানে পার্বতীর মুখোমুখি হওয়া সে এক অভিজ্ঞতাই বটে!
বর্ষাদিনে পার্বতীর রূপ দেখব বলে আগস্টে আমাদের পার্বতী উপত্যকা অভিযান৷ ইচ্ছে, পরিস্থিতি অনুকূল হলে ক্ষীরগঙ্গা ট্রেক করব৷ ক্ষীরগঙ্গা ১০,০০০ হাজার ফুট ওপরে এক শৃঙ্গ৷ পুরাণ বলে, শিবের প্রিয় শৃঙ্গ ছিল এই ক্ষীরগঙ্গা৷ আর এখানেই কার্তিক ৩,০০০ বছর ধ্যান করেছিলেন৷ ক্ষীরগঙ্গায় প্রাচীন এক কার্তিকের মন্দির, আর একটি উষ্ণ প্রস্রবণ৷ পর্বতশৃঙ্গের বিস্তৃত উপত্যকা আর ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরোমিক ভিউ৷ দৃষ্টি কোথাও আটকে যায় না৷ আকাশও যেন ছুঁয়ে ফেলা যায়৷ পুরাণ আর প্রকৃতির নেশাতুর মিস্টিসিজম এই ক্ষীরগঙ্গা৷ এখানে স্থায়ী কোনও থাকার জায়গা নেই৷ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যটকের জন্য অস্থায়ী কিছু কাঠের ঘর ও টেন্টের ব্যবস্থা থাকে৷ সেপ্টেম্বরের পর প্রবল বরফপাতের জন্য সবাই নেমে আসে৷ ক্ষীরগঙ্গা ট্রেক পিন পার্বতী ট্রেকের প্রথম ক্যাম্প৷ আমাদের এই রুটের প্রথমদিনের ঠেক কসৌল৷
কলকাতা থেকে কালকা মেল-এ করে ভোর রাতে চণ্ডীগড়৷ সেখান থেকে বাস নিয়ে ভুন্তার৷ ভুন্তার পৌঁছতে সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা৷ ভুন্তার থেকেই শুরু পার্বতী উপত্যকা৷ এখানেই বিয়াস নদী আর পার্বতী নদীর সংগমস্থান৷ ভুন্তার থেকে আবার বাসে বা ট্যাক্সিতে কসৌল৷ কসৌল পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের বিকেল৷
কসৌল–মিনি ইজরায়েল৷ ছোট পাহাড়ি এক জনপদ৷ বহু সংস্কৃতির, বহু ভাষাভাষী মানুষের যৌথতা এই কসৌলে৷ মূলত ইজরায়েলিদের বাসস্থান৷

parvati1_web
কসৌলের গল্প অন্য একদিন হবে৷ দু’কথায় কসৌলের গল্প শেষ হওয়ার নয়৷ কসৌল, ছালাল ঘুরে আমরা পৌঁছলাম তোশে৷ তোশ থেকেও অনেকে ক্ষীরগঙ্গা ট্রেক করে৷ তবে আমরা বারসেনি থেকে হাঁটা আরম্ভ করব৷ কারণ বারসেনি পর্যন্ত গাড়ি যায়৷ তোশে পৌঁছতে না পৌঁছতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি৷ পার্বতী ফুলে-ফেঁপে তেজস্বিনী৷ বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই৷ আমরা তোশে অপেক্ষা করতে থাকলাম৷ দু’দিন পেরিয়ে গেল৷ তৃতীয়দিন আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্য উঠল৷ চারদিকে তখন ঝিকিমিকি আলো৷ আমরা ট্রেকিং-এর জন্য রেডি হয়ে পৌঁছে গেলাম বারসেনি৷ বারসেনিতে অতিরিক্ত লাগেজ নামিয়ে, শুধু ক্ষীরগঙ্গার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হলাম৷ আমাদের সফরসঙ্গী হলেন রাজু ভাইয়া, আমাদের গাইড৷
বারসেনির হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট থেকেই শুরু এই অভিযান৷ প্রথমেই নেমে যেতে হবে নদীবক্ষে৷ এখানে ছোট ছোট দু’তিনটে খুপরি দোকান আছে৷ যেখানে কফি পাওয়া যায় ও ব্যাগ জমা রাখা যায়৷ আমরা কফি খাওয়ার জন্য বসেছি সেরকমই এক দোকানে৷ দোকানের মালিক বৃদ্ধ এক হিমাচলি ভদ্রলোক ও তাঁর ছেলে৷ বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাদের জিগ্যেস করলেন– ‘আপলোগ ক্ষীরগঙ্গা যা রহে হ্যায়?’ ভদ্রলোক একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, ‘আজ আপকা যাত্রা শুভ হোগা, আজ রাখিপূর্ণিমা হ্যায়৷ আজ আপ যো দেখেঙ্গে, ও হামেশা ইয়াদ রাখেঙ্গে৷’
আহা! আনন্দমনে আমরা হাঁটা শুরু করলাম৷ প্রবেশ করলাম ‘গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল ফরেস্ট’-এ৷ ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটা, দূরে সফেদ চূড়া, পার্বতীর জল কলকল৷ রাস্তা সরু, তবে সেটা সমস্যার নয়৷ সমস্যায় ফেলল কাদা৷ দু’দিন টানা বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় কাদা জমেছে৷ এরকম কাদায় বেশিক্ষণ পা রাখা যায় না৷ পিছলে যায়৷ দ্রুত পেরিয়ে যেতে হবে৷ দু’ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নাকথান৷ নাকথান থেকে রাস্তার প্রকৃতি বদলাতে শুরু করে৷ রাস্তা জুড়ে বড় বড় পাথর৷ পাথর টপকে টপকে যাওয়া৷ দু’ধারে আপেল বাগান৷ আহা, দুধে-আলতা রঙের আপেল৷ রাজু ভাইয়া গাছ থেকে আপেল পেড়ে আমাদের দিতে লাগল৷ রাস্তায় প্রচুর প্রচুর ঝরনা, সেই ঝরনা পেরোতে আমরা বারবার ভিজে গেলাম৷ আরও দু’ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছলাম রুদ্রনাগ৷ তখন বিকেল সাড়ে চারটে৷

Advertisement

parvati3_web
রুদ্রনাগ একটি পৌরাণিক জায়গা, বিখ্যাত ঝরনার জন্য৷ বলা হয়, এই ঝরনায় হিমাচলের দেবদেবীরা স্নান করতে আসেন৷ ঝরনা নাগের ফণার মতো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে পার্বতীর জলে৷ ছোট্ট ব্রিজ দিয়ে আমরা এই ঝরনা পেরলাম৷ তারপর বাঁক নিতেই আবার পার্বতী৷ এখানে পার্বতীর রূপ দেখলে সত্যিই গায়ে কাঁটা দেয়৷ দু’টো পাহাড়ের মাঝখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷ সেখানে ছোট কাঠের ব্রিজ পেরতে হবে৷ ব্রিজে দাঁড়িয়ে পার্বতীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা এক অভিজ্ঞতা বটে৷ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে শরীর অবশ হয়ে আসে৷ এই ব্রিজটা পেরতেই রাস্তা খাড়াই উঠে গিয়েছে৷ প্রায় ৯০ ডিগ্রি৷ রাস্তা বলতে গাছের গুঁড়ি৷ এক গাছের গুঁড়ি থেকে আরেক গাছের গুঁড়ি৷ রুদ্রনাগ থেকেই পাহাড়, জঙ্গল এবং রাস্তার আমূল পরিবর্তন৷ জঙ্গল আরও গভীর হয়৷ রাস্তা আরও সরু৷ দু’টো পা পাশাপাশি রাখারও জায়গা নেই৷ ধীরে ধীরে বুনো গন্ধ আমাদের ছেয়ে ফেলল৷ সূর্যও যেন আমাদের ছেড়ে পালাল৷ চারিদিকে কোনও আওয়াজ নেই৷ পাখির আওয়াজ, ঝিঁঝির আওয়াজও আর শোনা যাচ্ছে না৷ প্রাচীন প্রাচীন গাছ, গাছে দীর্ঘকালের শ্যাওলা৷ উই হ্যাভ এন্টার্ড ইনটু দ্য ওয়াইল্ড৷
এই রোমাঞ্চ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়৷ ধীরে ধীরে ভয় গ্রাস করবে, গায়ে কাঁটা দেবে, তবু সামনে এগিয়ে চলা নেশার মতো৷ আরও গভীরে যাওয়ার নেশা৷ পার্বতীর অনন্ত বয়ে চলার শব্দ, আরও আদিম জঙ্গল৷ হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হলেই বিপদ৷ এভাবে দু’ঘণ্টা হেঁটেছি আমরা৷ সন্ধে সাতটা, বুঝতে পারছি আর একঘণ্টার মধ্যেই ক্ষীরগঙ্গা পৌঁছতে পারব৷ ততক্ষণে ১০ হাজার ফুট ওপরে উঠে গিয়েছি আমরা৷ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে৷ পাহাড়ের একটা বাঁক নিতেই দেখি রাস্তা শেষ৷ ধস! রাস্তা, গাছগাছালি নিয়ে সেই ধস নীচে পার্বতীতে নেমে গিয়েছে৷ আমরা যখন পৌঁছেছি, তখনও ছোট-বড় বোল্ডার পড়ছে, ছোট ছোট গাছও গড়িয়ে পড়ছে ওপর থেকে৷ সেই ধস পেরনো কোনওভাবেই সম্ভব নয়৷ রাজু ভাইয়া চারিদিক ভাল করে দেখে এল৷ না, আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ করতে হবে৷ রাত্রিবেলা আমরা চার বন্ধু ও রাজু ভাইয়া দ্য গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল ফরেস্টে দাঁড়িয়ে৷ সামনে এগোতে পারব না৷ পিছনে ফিরতে পারব না৷ রুদ্রনাগ ফিরতে অন্তত চারঘণ্টা লাগবে৷ সারাদিন হেঁটে আমরা প্রবল ক্লান্ত৷ আর এক পা’ও এগোতে পারব বলে মনে হচেছ না৷ ভয়ে আমাদের হাত-পা অবশ হয়ে আসছে৷ বিশেষ করে সাদা লেপার্ডের ভয়৷ বহু ট্রেকার আমাদের সাবধান করেছিল বন্য জন্তুর থেকে৷ বলেছিল আলো থাকতে থাকতে পৌঁছে যেতে৷ ঠিক করলাম ফেরার পথ ধরতে হবে৷ একজায়গায় বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়৷ আমরা অন্ধকারে চাঁদের আলোয় ফেরা শুরু করলাম৷ কতক্ষণ হেঁটেছি ঠিক মনে নেই৷ হঠাত্‍ চোখে পড়ে একটা গুহা৷ সেখানে এক ভদ্রলোক থাকেন৷ যাওয়ার সময় এই জায়গাটা চোখে পড়েনি আমাদের৷ সেই রাতে গুহাতে আমাদের জায়গা হল৷ ভাত আর রাজমা চাওলও জুটে গেল৷

Advertisement

parvati2_web

খাবার খেয়ে যখন আমরা গুহা থেকে বেরলাম, তখন বাইরেটা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে৷ প্রবল জঙ্গলে আমরা কয়েকজন তখন জ্যোৎস্নায় স্নান করছি৷ সামনে ঝরনার কুলকুল আওয়াজ৷ দশ হাজার ফুট ওপরে, আদিম জঙ্গলে, ঝরনার পাশে দাঁড়িয়ে, ভাবছি, যা দেখছি এখন, এই মুহূর্তে, তা কি সত্যি, না কি আমারই কোনও স্বপ্নদৃশ্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি৷ সামনের ধপধপে সাদা পাহাড়গুলো যেন আমাকেই দেখছে৷ আমার স্বপ্নের সাক্ষী৷ বুঝতে পারলাম, সেই বৃদ্ধ হিমাচলি ভদ্রলোকের আশীর্বাদ পূরণ হয়েছে৷ যা দেখলাম, তা ভুলব না কোনওদিন৷
পরের দিন আমরা ফিরে এলাম বারসেনি৷ শুনলাম, যাঁরা ক্ষীরগঙ্গায় ছিলেন, তাঁরা নামতে পারছেন না৷ রাস্তা নতুন করে তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ওখানেই থাকতে হবে৷ এইবার পৌঁছতে পারলাম না ক্ষীরগঙ্গা৷ উষ্ণ প্রস্রবণে আমাদের স্নান হল না, ৩৬০ ডিগ্রিতে প্যানোরোমিক ভিউ পেলাম না৷ তবে, যা দেখলাম ‘আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না৷’

কীভাবে যাবেন:
কলকাতা থেকে কালকা মেল-এ করে চণ্ডীগড়৷ চণ্ডীগড় থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে৷ এছাড়া বাসের ব্যবস্থা রয়েছে৷ হিমাচলপ্রদেশে বাস সার্ভিস খুব ভাল৷ মানালিগামী বাসে চড়ে ভুন্তারে নামতে হবে৷ ভুন্তার থেকে বাসে করে কসৌল৷ এছাড়া দিল্লি হয়েও যাওয়া যায়৷ কলকাতা থেকে দিল্লি গিয়ে, সেখান থেকে মানালির বাসে চড়তে হবে৷ এই বাসগুলো রাতে ছাড়ে দিল্লি থেকে৷ ভোরবেলা পৌঁছে যাবেন ভুন্তার৷

কোথায় থাকবেন:
ক্ষীরগঙ্গায় স্থায়ী থাকার জায়গা নেই৷ অক্টোবরের শুরুতেই বরফপাতের জন্য সবাই নেমে আসে৷ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর ওখানে তাঁবু ও কাঠের ঘরের ব্যবস্থা রয়েছে৷ থাকা-খাওয়া সস্তা৷ ক্ষীরগঙ্গায় সাধারণত ট্রেকাররা তাঁবু নিয়ে যায়৷

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ