Advertisement
Advertisement
Look Back 2023

ফিরে দেখা ২০২৩: অভিশপ্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেস থেকে বিশ্বকাপ হাতছাড়া ভারতের, হৃদয়ভাঙা ঘটনাবলি

ফিরে দেখা সেসব বেদনার স্মৃতি।

Look Back 2023: Heartbreaking incidents of this year in a nutshell
Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:December 23, 2023 9:48 pm
  • Updated:December 23, 2023 9:48 pm

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: হাসি-কান্না, হর্ষ-বিষাদের তরঙ্গেই প্রবাহিত জীবন। এ জীবনের আনন্দ যেমন সাদরে গ্রহণীয়, বেদনাকেও করে তুলতে হয় সহনীয়। তবেই তো জীবনবৃত্তের নানা স্বাদ মেলে, মেলে শিক্ষাও। ঝড়বৃষ্টির পর যেমন ঝলমলে রোদ্দুর, তেমন অশ্রুপাত থামলে তবেই হাস্যমুখ। ধ্বংসের কঠিন স্তূপের উপর গড়ে ওঠে সৃষ্টির ভিত। তাই যা হৃদয়ভাঙা, মনখারাপের, তাকে সঙ্গে নিয়েই খোঁজ চলে আনন্দের। আর সময় সেই রাস্তা তৈরি করে দেয়। প্রতিটা বছর আমাদের উপহার দিয়ে যায় কিছু কালো, কিছু ভালো। ২০২৩ সালও তার ব্যতিক্রম নয়। আসুন, সেসব কালোর দিকে তাকিয়ে আমরা বরং এগিয়ে চলি ২০২৪-এর ভালোর দিকে।

এ বছর আমাদের সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়েছে ওড়িশায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা (Coromandal Express Accident)। ট্র্যাকের উপর ট্র্যাক উঠে ট্রেনের সঙ্গে ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে লাশের পাহাড় দেখেছিল বাহানাগা স্টেশন। দিনরাত স্টেশনে যাত্রীদের কোলাহল নিমেষে বদলে গিয়েছিল শ্মশানের নিস্তব্ধতায়। রক্ত আর মৃতদেহ পচনে পূঁতিগন্ধময় হয়ে উঠেছিল আকাশ-বাতাস। দুর্ঘটনার দায় কার, তা নিয়ে শুরু হয় কাটাছেঁড়া। সিগন্যাল সমস্যা নাকি চালকের ভুল? স্ক্যানারে আসে সমস্ত সম্ভাব্য কারণ। চার্জশিটে সিবিআই (CBI) উল্লেখ করে ৩ রেলকর্মীর। বলা হয়, যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, কর্মীদের ভুলেই ঘটেছে এত বড় দুর্ঘটনা। এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার ক্ষত ভোলাতে পারে না সময়ের প্রলেপও। তবু বাস্তবের দাবিতে ফের এই পথে শুরু হয় স্বাভাবিক রেল চলাচল। বাহানাগা স্টেশনের কাছাকাছি এলে আরও সাবধানী হন চালক। আর যাঁর তেমন কোন আছে, সে যাত্রী রাতের অন্ধকারে শুনতে পান অতৃপ্ত আত্মাদের কান্না। অসময়ে জীবন ছেড়ে চলে যাওয়ার হাহাকার।

Advertisement
Odisha Train Tragedy: 3 railway employees Arrested
ওড়িশার বাহানাগার কাছে দুটি ট্রেনকে ধাক্কা দিয়ে উলটে যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস।

এ তো গেল এক রেল দুর্ঘটনার মর্মান্তিক স্মৃতি। প্রতিবেশী রাজ্য থেকে এবার বাংলায় আসা যাক। এখানকার রেল স্টেশনও সাক্ষী অকল্পনীয় এক দুর্ঘটনার। রেল স্টেশনের জলের ট্যাঙ্কও যে প্রাণঘাতী হতে পারে, কেউ তো দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু বাস্তব তো কল্পনার চেয়ে অনেক কঠিন। তাই বছরের শেষ মাসে রাজ্যবাসীর সামনে এসে দাঁড়াল তেমনই এক রূঢ় বাস্তবিক ঘটনা। বর্ধমান (Burdwan) স্টেশনে জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়ে মৃত্যু হলো চারজনের। ব্রিটিশ আমলে তৈরি জলের ট্যাঙ্ক গুলোর ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়াকে এই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু তার দায়ই বা কার? তদন্ত চলছে, চলবে। দোষী সাব্যস্ত যে-ই হোক না কেন, স্বজন হারানোর কান্না মুছবে কে? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই।

Advertisement

[আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ২০২৩: ‘জওয়ান’, ‘অ্যানিম্যাল’দের ভিড়ে এই সিনেমা-সিরিজ মিস করবেন না]

বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ (Blast), মৃত্যু নতুন কোনও ঘটনা নয়। কিন্তু এ বঙ্গে সেই পরিচিত বিষয়ই হয়ে ওঠে মারাত্মক। বাজির আড়ালে এসব কারখানায় তৈরি হয় বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র। চলতি বছর উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর ও পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার দুই বাজি কারখানায় সেই বিস্ফোরণেই মৃত্যু হয়েছে মোট ২১ জনের। আবার বসিরহাটের ইটভাটায় ফার্নেস বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। কর্মক্ষেত্রই যেখানে এমন প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে, সেখানে বেকারত্বের জ্বালা তুলনামূলক কম নয় কি?

[আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ২০২৩: চন্দ্রযান থেকে জি২০ আয়োজন, ২০২৩-এ যেসব কারণে গর্বিত হল দেশ]

এবছর বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলেছে আমাদের পৃথিবী। কোনওটা এদেশে, কোনওটা বিদেশে। তার মধ্যে সাম্প্রতিকতম দুর্যোগের নাম মিগজাউম (Michaung)। মায়ানমারের নামাঙ্কিত এই ঝড়ে দেশের দক্ষিণ প্রান্ত অর্থাৎ অন্ধ্র, তামিলনাড়ুতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৭ জন। শুধু কি তাই? এই ভরা শীতে ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে তামিলনাড়ুতে রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ৪৭ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল (Viral) ধ্বংসলীলার ছবি। পাশাপাশি আরও একটি ছবিও বেশ ভাইরাল হয়েছে। চেন্নাইয়ের পেরুনগালাতুর এলাকায় রাস্তার উপরই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় একটি কুমিরকে। অর্থাৎ প্রকৃতির রোষ থেকে জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে কি মানুষ, কি মানবেতর প্রাণী – সকলেই যেন এক হয়ে যায়। কোনও ফারাক থাকে না।

Chennai
ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের চেন্নাইয়ের রাস্তায় কুমির। সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল সেই ছবি।

নানা বিপর্যয়ে প্রাণহানির ঘটনাকেই যদি একমাত্র হৃদয়ভাঙার যন্ত্রণার তকমা দেওয়া যায়, তাহলে বোধহয় পৃথিবীতে অন্য কোনও বেদনার জায়গা থাকে না। কিন্তু বাস্তব তো তেমন নয়। চারপাশে রোজ এমন কিছু তো ঘটেই, যা দেখে নিমেষে আমাদের মন খারাপ হয়। ডুবে যায় বিষাদ সাগরে। এই যেমনটা হয়েছিল গত ১৯ ডিসেম্বর। এক যুগ পর ২২ গজের যুদ্ধে বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্ন যেভাবে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল, সেই বেদনা ভারতবাসী মাত্রই উপলব্ধি করেছেন। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে বিরাট-রোহিতদের ৬ উইকেটে হারিয়ে দিয়েছিল অজি বাহিনী। সেদিন আশা জাগিয়েও শেষপর্যন্ত যেভাবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন তাঁরা, তা অবধারিতভাবে চোখে জলে এনেছিল ১৪০ কোটি ভারতবাসীর। বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে ওঠার আগে সেই জল কি শুকোবে? 

Mental fatigue prompted Ishan Kishan to skip South Africa Test series as Team India wicketkeeper takes break from cricket
বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে রোহিত-বিরাটদের হারের বেদনা। ছবি: টুইটার

শুধু কি বিশ্বকাপ হাতছাড়া হওয়ায় আমাদের মন ভেঙেছে? ক্রীড়া দুনিয়ার আনাচে কানাচে তাকালে আরও কত হৃদয় বিদারক ঘটনাই তো ঘটে গিয়েছে বছরভর। তা উপেক্ষা করার উপায় নেই। উচ্চ পদাধিকারীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার মতো গুরুতর অভিযোগের সুবিচার না পেয়ে রাগে, দুঃখে, হতাশায় নিজেদের কেরিয়ার বিসর্জন দিতে হয়েছে তারকা খেলোয়াড়দের। ২০২৩ সাল এমন ঘটনারও সাক্ষী। ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের (WFI) প্রাক্তন প্রধান তথা বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে এই অভিযোগে সরব মহিলা কুস্তিগিররা যখন দিনের পর দিন রাজধানীর রাজপথে দিন রাত এক করে বসে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন শুধুমাত্র দোষীর প্রকৃত শাস্তির দাবিতে, এবং বিচারে নিরপেক্ষতার ওভাবে যখন সেই ‘অভিযুক্ত’ই ক্লিনচিট পেয়ে হাসতে হাসতে বেরোন, তখন ক্রীড়া দুনিয়ার তারকাদেরই সম্মান ভুলুন্ঠিত হয়। যার ফলস্বরূপ সাক্ষী মালিকের মতো বিশ্বের দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কুস্তিগির বাধ্য হয়ে এই জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নেন, বজরং পুনিয়া তাঁর গোটা জীবনের কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ পাওয়া ‘পদ্মশ্রী’ পদক ফেরত দিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রীর দুয়ারে গিয়ে। এই কান্না, এই হতাশা তো শুধু সাক্ষীর নয়, এ তো প্রত্যেক ভারতবাসীর অন্তরের বেদনা।

Wrestling Federation of India elections to be held on December 21, results on same day
যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একাধিক কুস্তিগিরের। ফাইল ছবি

হেনস্তা, দুর্ভোগের শেষ নেই অন্য পেশাতেও। সারাজীবন পড়াশোনা করে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে শিক্ষক (Teacher) হতে চেয়েছিলেন যাঁরা, নিয়োগের শেষ ধাপে গিয়েও ফিরতে হয়েছে স্রেফ দুর্নীতি নামের অভিশাপের কারণে। ন্যায্য চাকরির দাবিতে হাজার হাজার দিন ধরে পথে বসে থেকেও যখন সুরাহা হচ্ছে না, তখন রাগে, ক্ষোভে নিজেদের সৌন্দর্য বিসর্জন দিয়েছেন SLST চাকরিপ্রার্থী। প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের কেশ বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ কেশরাশি কেটে সম্পূর্ণ নেড়া হয়েছেন তিনি। তাঁর সেই ছবি দেখে ভিজে উঠেছে আমাদের চোখ।  

SLST Scam Protest: Female protestor shaves hair in Kolkata
ন্যায্য চাকরি না পেয়ে হতাশায় আন্দোলনের ৫০০ দিনে কলকাতার রাস্তায় নিজের চুল বিসর্জন দিলেন রাসমনি পাত্র।

উপজাতি সংঘর্ষে এ বছরের দীর্ঘ সময় উত্তপ্ত ছিল উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্য মণিপুর (Manipur)। এক শ্রেণিকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সরকারি ঘোষণা থেকে যার সূত্রপাত। আর আশ্চর্যের বিষয়, এমন একটি ইস্যুতে প্রতিবাদ আবর্তিত হলো নারী নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর, লজ্জাজনক ঘটনা ঘিরে। বিবদমান কুকি-মেইতেই জনজাতির মধ্যে অশান্তি এমনই চরমে উঠল যে গোটা দেশ সাক্ষী রইল এমন এক দৃশ্যের যা দেখে  স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া কিচ্ছু করার ছিল না। দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে ঘোরানো হলো সারা গ্রামে। আর সেই ভিডিও দাবানলের মতো হুহু করে ছড়িয়ে পড়ল সোশাল মিডিয়ায়। এর পর মণিপুরবাসীর দুর্ভোগ আরও বাড়ল। অশান্ত পাহাড়ি এলাকা থেকে শয়ে শয়ে মানুষ অন্যত্র পালাতে শুরু করলেন, যাকে সরকারি ভাষায় বলে ‘মাইগ্রেশন’। ছবির মতো সুন্দর রাজ্য ফের সেনাবাহিনীর ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে গেল। আর এক অন্যায়ের প্রতিবাদ স্বরূপ মানুষ খুনের মতো আরও বড় অন্যায় সংঘটিত হলো সেখানে। মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকল অগ্নিগর্ভ মণিপুরের বিভিন্ন এলাকায়। এ নিয়ে রাজনীতিও কম হলো না। প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ নীরবতা আগুনে ঘি ঢালল যেন। সারাবছর খানিকটা অবজ্ঞায় ফেলে রাখা এক পড়শি রাজ্যের এহেন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে কাঁদিয়েছে গোটা দেশকে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ