Advertisement
Advertisement
Ramkrishna

‘কথামৃত’ লিখে জুটেছিল খুনের হুমকি! আজও কেন অতুলনীয় শ্রীম’র সৃষ্টি

পাঁচ খণ্ডের এই মহাগ্রন্থের জন্য চিরস্মরণীয় শ্রীম।

Mahendranath Gupta was once criticized for writing the book Ramakrishna Kathamrita। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 18, 2023 7:04 pm
  • Updated:November 18, 2023 7:10 pm

বিশ্বদীপ দে: ”যখন একবার হরি বা একবার রাম নাম করলে রোমাঞ্চ হয়, অশ্রুপাত হয়, তখন নিশ্চয় জেনো যে সন্ধ্যাদি কর্ম আর করতে হবে না।” ১৮৮২ সালের এক রবিবার ভাগ্নের সঙ্গে গঙ্গার ধারের এক বাগানে বেড়াতে এসেছেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত অর্থাৎ শ্রীম। ভাগ্নেই তাঁকে বলেন, গঙ্গার ধারের বাগানে এক পরমহংসের কথা। সেই প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। আর শুরুতেই এমন কথা শুনে সেই যে বিভোর হলেন, আজীবন রয়ে গেল সেই মগ্নতা। যা তাঁকে লিখিয়ে নিয়েছিল ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’। যে মহাগ্রন্থ কালকে অগ্রাহ্য করে চিরকালীন হয়ে গিয়েছে। অথচ এমন গ্রন্থের জন্য রীতিমতো খুনের হুমকি পেয়েছেন তিনি! আদৌ বইটিতে বর্ণিত রামকৃষ্ণের বলা কথাগুলি তাঁরই বলা কিনা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে তা নিয়েও।

‘মাস্টারমশায়’ নামে পরিচিত ছিলেন। পড়াতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্কুলে। ডায়রি লিখতেন খুব অল্প বয়স থেকেই। আর সেই দিনলিপি লেখার অভ্যাসই তাঁর দারুণ কাজে এসেছিল কথামৃত লেখার সময়। তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ছাত্রজীবনে তাঁর দারুণ প্রিয় ছিল। কে জানত সেই মানুষটিই এযুগের এক মহাগ্রন্থ লিখবেন সমসময়ের এক মহাপুরুষকে নিয়ে। অথচ খুব কম বয়সে মাকে হারানো শ্রীম সাংসারিক সমস্যায় এমন জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন, আত্মহত্যার চিন্তাও উঁকি দিয়ে যেত মনে।

Advertisement

Sri Ramakrishna adopted a Bhairavi as his 'Guru' in Tantra Sadhana

Advertisement

[আরও পড়ুন: ‘শামির ভয়ে কাঁপছে অস্ট্রেলিয়া!’ মেগা ফাইনালের আগে স্বীকার করে নিলেন প্যাট কামিন্স]

কিন্তু সব বদলে যায় রবিবাসরীয় সেই সন্ধ্যায়। রামকৃষ্ণকে (Ramakrishna Paramahansa) প্রথমবার দেখার পরই তিনি বুঝতে পারেন, এই বার তাঁর জীবন এক দিশা খুঁজে পেয়েছে। যদিও ‘শ্রীম দর্শনে’র প্রথম খণ্ডে রয়েছে তাঁর সঙ্গে ঠাকুরের কথোপকথনের এক বর্ণনা। আত্মহত্যার প্রসঙ্গ উঠেছিল সেখানেও। অর্থাৎ অস্থিরতা তখনও রয়ে গিয়েছিল তাঁর মনে। যা শুনে রামকৃষ্ণ বলেন, ”ওকথা কেন? তোমার যে গুরুলাভ হয়েছে। তোমার আবার ভাবনা কী? গুরু যে তোমার পিছু পিছু রয়েছেন।… ভাবনা কী, গুরু সব কিছুর মোড় ফিরিয়ে দিবেন।” এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁকে আলোর দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুর। আর শ্রীম পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন, ”হিউম্যান লাইফ ইজ অ্যান এক্সেলেন্ট অ্যাপলজি ফর সুইসাইড এক্সেপ্ট গুরু।”

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের বছর দুয়েক পরে শুরু হয় কথামৃত লেখার কাজ। যদিও তাঁর সঙ্গে ঠাকুরের ৭১টি সাক্ষাতের সবটাই ডায়রিতে লেখা ছিল। কিন্তু বই লেখা শুরু সেই সময়ই। বেশ কিছুটা লেখা হওয়ার পর নীলাম্বরবাবুর ভাড়াবাড়িতে সেই পাণ্ডুলিপি শুনিয়েছিলেন শ্রীমা সারদাকে। দিনটা ছিল রথযাত্রা। সারদা মুগ্ধ হয়েছিলেন শুনে। পরে ১৮৯০ সালেও আরও কিছু অংশ শ্রীমা সারদার সামনে পড়ে শোনান। এর পর প্রকাশিত হয় ‘পরমহংসদেবের উক্তি’। এসবই কথামৃত প্রকাশিত হওয়ার আগের পর্ব। বইয়ের নাম প্রথমে ছিল ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃতম’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাম রাখা হয় ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ (Sri Sri Ramakrishna Kathamrita)। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। এর পর ১৯০৪, ১৯০৮ ও ১৯১০ সালে পরবর্তী তিনটি খণ্ডও প্রকাশ পায়। পঞ্চম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল অবশ্য অনেক পরে ১৯৩২ সালে। সেই বছরই তাঁর প্রয়াণের বছর।

[আরও পড়ুন: ভুয়ো ‘হালাল’ পণ্যের রমরমা উত্তরপ্রদেশে, কড়া পদক্ষেপ যোগী প্রশাসনের]

অথচ যখন রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণ তিনি লিখে রাখছিলেন ডায়রিতে, ভাবেনওনি এই নিয়ে একদিন বই লিখবেন। কেবলই তিথি-নক্ষত্র-তারিখ সহযোগে নিত্য অভ্যাসে রোজকার অভিজ্ঞতা লিখে রাখতেন। তবে এই লেখাটি অত্যন্ত গভীর মনোযোগ সহকারে লিখেছিলেন তিনি। প্রয়োজনে রাত জেগেও। লেখার আগে ধ্যান করতেন। তার পর সমস্ত কথা খুঁটিনাটি স্মৃতি থেকে সংগ্রহ করে সাদা পাতায় ফুটিয়ে তুলতেন। এমন নিখুঁত লিখিত বিবরণ ছিল বলেই পরবর্তী সময়ে এমন মহাগ্রন্থের পরিকল্পনা ও স্বার্থক রূপায়ণ সম্ভব হয়েছিল।
বই ছাপতে গিয়ে কিন্তু বেগ পেতে হয়েছিল। বসুমতীর উপেন চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় বইটি ছাপতে রাজি ছিলেন না। অগত্যা প্রকাশক হতে রাজি হন তাঁরই ছাত্র স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ।

বইটি লেখার উদ্দেশ্য প্রথম থেকেই ছিল ঠাকুরের বাণী সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আদপে সংসারী মানুষটি ছিলেন ঘোরতর সন্ন্যাসী। রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের পর পঞ্চাশ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। এই পুরো সময়টাই আধ্যাত্মিকতার ভিতরই ছিলেন তিনি। তাঁরই কথায়, ”এ কি আর আমি করেছি, ঠাকুরের কাজ ঠাকুরই করেছেন। তিনি মেধারূপে, ইচ্ছাশক্তিরূপে আমার ভিতরে আবির্ভূত হয়ে লিখিয়েছেন।”

সব সময়ই চেয়েছেন বইয়ের দাম যতটা সম্ভব কম রাখা। যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ পড়তে পারে। পরিকল্পনা ছিল আরও দুটি খণ্ড লেখার। তাঁর লেখাতেই রয়েছে, ‘শ্রীশ্রীকথামৃত-র ছয়-সাত খণ্ডে সমাপ্ত হইলে শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত অবলম্বন করিয়া একটি জীবনী লিখিবার একটি জীবনী লিখিবার উপকরণ পাওয়া যাইবে।’ দুর্ভাগ্যের, তা হয়ে ওঠেনি। পঞ্চম খণ্ড প্রকাশে বিলম্বের পিছনে ছিল তাঁর শারীরিক অসুস্থতা। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে নিজের কাজ করে গিয়েছেন শ্রীম। ১৯৩২ সালের ৩ জুন রাত ৯টা পর্যন্ত প্রুফ দেখেছিলেন। পরদিনই প্রয়াত হন। অর্থাৎ একেবারে শেষদিন পর্যন্ত নিজের লেখায় মগ্ন থেকেছেন শ্রীম।

Ramkrishna-Mission

অথচ এমন নিমগ্নতা সত্ত্বেও সমালোচনা পিছু ছাড়েনি। এমনও সংশয় ছিল অনেকের, তিনি যা লিখেছেন সবই বানানো। এমনকী, রীতিমতো খুনের হুমকি দেওয়া চিঠিও পেয়েছেন। তবে সেসব পিছনে রয়ে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে তাঁর কাজ। যা চিরকালীন। যা অক্ষয়। শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে যে গ্রন্থের প্রয়োজন ছিল অনস্বীকার্য। নশ্বর জীবনে পাওয়া প্রাণ খোওয়ানোর হুমকি মিলিয়ে গিয়েছে অন্তরীক্ষে। গ্রন্থটির সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমও পেয়ে গিয়েছেন অমরত্ব।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ