সংবাদ প্রতিদিন-এর জন্য রাশিয়া থেকে কলম ধরলেন সম্পাদক সৃঞ্জয় বোস
পরলোকে বসে ক্লোভিজ ফার্নান্ডেজ খবরটা পেলে নিশ্চিত দুঃখ পেতেন। কলকাতার পান্নালাল চট্টোপাধ্যায়েরও শুনলে এতটুকু ভাল লাগবে না। ফুটবল-সমর্থন যদি এক স্বতন্ত্র পৃথিবী হয়, তাহলে ব্রাজিলের ক্লোভিজ ফার্নান্ডেজ, কলম্বিয়ার ‘এল কোল’, কিংবা কলকাতার পান্নালালবাবু তার উচ্চবিত্ত বাসিন্দা নিঃসন্দেহে। ব্রাজিলের ক্লোভিজ ফার্নান্ডেজ আজ বেঁচে নেই। কিন্তু বিশ্ব
ফুটবলের জনমানসে আজও তিনি বড় জীবিত। বড় জীবিত, চার বছর আগে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ব্রাজিল সাত গোল খাওয়ার পর কাপ রেপ্লিকা বুকে চেপে তাঁর ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলার ছবি, শেষে এক জার্মান সমর্থককে বলা ক্লোভিজের কয়েকটা শব্দ। যেখানে নিজের কাপ রেপ্লিকা সেই সমর্থককে ধরিয়ে ক্লোভিজ বলেছিলেন, “শক্ত করে চেপে ধরো এটাকে ফ্রেন্ড। ফাইনালে নিয়ে যাও। এটা তোমাদেরই প্রাপ্য!”
কলম্বিয়ার এল কোল- দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতীক শকুনের ‘বেশভূষায়’ সজ্জিত হয়ে নব্বই বিশ্বকাপ থেকে যিনি কলম্বিয়া টিমটারই সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন, তিনিই বা কম কীসে? দড়ির সঙ্গে নিজেকে বেঁধে স্টেডিয়ামে এল কোলের ভয়ানক সব স্টান্ট, উড়তে উড়তে মাঠে ঢোকা। বাংলার ফুটবল-দম্পতি পান্নালাল এবং চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের আবেগকেও বা মাপা যায় কোন মানদণ্ডে? বয়সকে হারিয়ে, ‘ভাল খাওয়া, ভাল থাকা’র জাগতিক মোহকে হঠিয়ে ফুটবলের নেশায় যাঁরা বিশ্বকাপ দেখতে ছুটে বেড়ান চার বছর পরপর?
কাজান। সোচি। সেন্ট পিটার্সবার্গ। রাশিয়ার তিন শহরে ঘুরে গত চারদিনে দু’টো কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ দেখলাম। প্রথমে দেখলাম, ব্রাজিলের হার। তারপর রাশিয়ার। আর মাঠে বসে ম্যাচ দেখে, জাতীয় টিমের প্রতি সমর্থকদের আনুগত্যের রং দেখে, প্রিয় দেশের হারের পর তাদের আচার-আচরণ দেখে যে উপলব্ধিটা হল, তা ‘এল কোল’ কিংবা প্রয়াত ক্লোভিজের কাছে সুখের নয়। এত দিন জানতাম, ক্লাব ফুটবলের কাছে হেরে যাচ্ছে দেশ। রাশিয়ায় এসে বুঝলাম, শুধু তাই নয়। দেশজ সমর্থনও এখন হেরে যাচ্ছে। ক্লাবের সমর্থনের কাছে!
[পাক কুস্তিগিরদের ভারতে আসার ভিসা দিল না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, টুর্নামেন্ট ঘিরে অনিশ্চয়তা]
কাজানে ব্রাজিল বা সোচিতে রাশিয়া, কোনও দেশের সমর্থককেই টানা নব্বই মিনিট ধরে গ্যালারিতে গান গেয়ে যেতে শুনিনি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল খেললে যা হয়। ব্রাজিল বা রুশ সমর্থকদের দেখিনি, মাঠে টানা নব্বই মিনিট স্রেফ চেঁচিয়ে প্রিয় টিমকে সাহস জুগিয়ে যেতে। মাঝে মাঝে ‘ব্রা-জি-ল, ব্রা-জি-ল,’ সমর্থনের ঢেউ উঠেছে গ্যালারিতে। কিন্তু তা বড় সাময়িক। অথচ লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বার্সেলোনা হলে কিন্তু চলতেই থাকে। ব্রাজিল-রাশিয়া, দু’টো টিমই কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেছে। সমর্থকরা দুঃখ-কষ্টে কেঁদে ফেলেছেন। কিন্তু সেই যন্ত্রণা দীর্ঘায়িত হয়েছে কতটুকু?
দেখলাম, ব্রাজিল-রাশিয়া দু’দেশের সমর্থকুলই টিমের হারের পর একই পথে হাঁটতে শুরু করলেন। মানে, পাবের পথে! এঁদের যন্ত্রণা উপশমের ধরন হল, বিয়ার খাও। প্লেয়ারদের অভিসম্পাত করো। তারপর আবার বিয়ার খেয়ে যে যার মতো উঠে যাও। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশজ আবেগের প্রতি সেটাই কি যথেষ্ট আনুগত্য প্রদর্শন? কে জানে! বেলজিয়াম ম্যাচে আত্মঘাতী গোল করা ফার্নান্দিনহোর বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ল না। ব্রাজিলের কাগজ-টাগজে দেখলাম, কুটিনহো-তিতেদের দেশে ফেরার পর কোনও গণরোষের সামনে পড়তে হয়নি। বরং তিতের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন কোনও কোনও ব্রাজিল সমর্থক! পরপর দু’বার বিশ্বকাপ থেকে বিশ্রীভাবে ব্রাজিল ছিটকে যাওয়ার পর এ জিনিস ভাবা যায়?
রাশিয়ারটা তবু মানা যায়। বিশ্বকাপ শুরুর সময় কেউ ভাবতেই পারেনি যে, টিমটা কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যাবে। কিন্তু ব্রাজিল? পড়লাম, রিওর ময়া স্কোয়্যারের ফ্যান জোনে নেইমাররা হেরে যাওয়ার পর বেশ কিছু সমর্থক পার্টি করেছেন, নেচেছেন, উৎসব চালিয়েছেন! দুঃখ ভুলতে। বলাবলি চলেছে, প্লেয়ারদের গালাগাল করো না। এরাই একদিন কাপ দেবে!
[লর্ডসের ব্যালকনিতে দাদার সেলফি, নস্টালজিয়া উসকে রসিকতা নাসের হুসেনের]
অথচ ক্লাব ফুটবলে এতটা সংযমী আবেগ, এতটা চিন্তাশীল সমর্থন ভাবা যায় না। কলকাতায় ডার্বি ম্যাচে মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে তার সমর্থকরা পারবেন, বিয়ার গ্লাসে চুমুক দিয়ে দুঃখ-পর্ব মিটিয়ে ফেলতে? পঁচাত্তরের বড় ম্যাচের পর আদ্যোপান্ত মোহনবাগান সমর্থক উমাকান্ত পালধি কী করেছিলেন, নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজও তাঁর মৃত্যু কলকাতার ফুটবল সমর্থনের বুক থেকে যন্ত্রণার পুঁজরক্ত বার করে। কিন্তু ভারত যখন খেলে, তখন এ রকম সমর্থন তো দেখা যায় না। স্টেডিয়াম ফাঁকা পড়ে থাকে। ভারত অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীকে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণের কাছে আকুল প্রার্থনা করতে হয় মাঠে আসার। কলকাতা ছেড়ে এবার বিশ্বে ঢুকুন। সাম্প্রতিক অতীতেই বার্সার কাছে তিন গোলে হেরে যাওয়ার পর এক রিয়াল সমর্থক রাগে নিজের বাড়ি স্রেফ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন! বছর পাঁচেক আগে ম্যাঞ্চেস্টার ডার্বিতে ইউনাইটেড হেরে যাওয়ার পর অপমান সহ্য করতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন এক ইউনাইটেড সমর্থক। জীবন, বাসগৃহ, এ সবের চেয়ে বড় ফুটবল নয়। এগুলো অবশ্যই অভিশাপের মতো, যা যুগের পর যুগ ফুটবল চেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। কিন্তু এঁরা দেখিয়ে গিয়েছিলেন, ফুটবল এঁদের কাছে জীবনের চেয়েও বড়।
ব্রাজিল বা রাশিয়ার বিশ্বকাপ বিদায়ের পর এ সব কখনওই কাম্য ছিল না। কিন্তু যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশটা কি আরও জীবন্ত হতে পারত না? ভারতীয় জার্সিতে সুনীল ছেত্রীর খেলা দেখতে মাঠে আরও আসতে পারেন না সমর্থকেরা? ক্লাব বনাম দেশের যুদ্ধে দেশ হেরে গিয়েছে বহু দিন। দেশজ ফুটবলের আর থাকবেটা কী? রাশিয়ায় যা দেখেছি, লিখলাম। পাঠকরা ইচ্ছে করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে নিজেরাই চেক করে নিতে পারেন। দু’টো টিমের ফেসবুক পেজে গিয়ে। লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ৪ মিলিয়ন ফলোয়ার। লিওনেল মেসির বার্সেলোনা ৭৩ মিলিয়ন ফলোয়ার!