দুলাল দে, মস্কো: তিনি ঠিক আছেন তো? শুরুতেই ভ্রাসালকো বসে পড়লেন তাঁর পিঠের উপর। ক্রোয়েশিয়ান কোচ দালিচ ততক্ষণে ধরাশায়ী। তারপর একে একে সবাই। কেউ একজন ঝাঁকানোর চেষ্টা করলেন। প্রেসবক্স থেকে স্পষ্ট দেখা গেল, দালিচের নট নড়নচড়ন অবস্থা। যখন সবাই তাঁর উপর চেপে বসেছেন, তিনি কি উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন? না, তিনি উঠলেন। এক এক সবাইকে জড়িয়ে ধরলেন। ফুটবলারদের সঙ্গে দালিচের এমনই সম্পর্ক। সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতে ক্রোয়েশিয়ার কোচ জানালেন, “আজকের ইতিহাস রচনায় আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। সবকিছু ওদের। মানে ফুটবলারদের। একটাই দুঃখের ইতিহাসে ফলাফল লেখা থাকবে। ফুটবলারদের এই লড়াই লেখা থাকবে না।”
অথচ বিশ্বকাপের আগে দল তৈরি করতে কোচদের মধ্যে সবচেয়ে কম সময় পেয়েছেন তিনিই। গত বছরের অক্টোবরে দাভর সুকের দালিচের হাতে দলের দায়িত্ব দিলেন। তার আগে জাতীয় দলের টানা ব্যর্থতা। দালিচ দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই দলের মধ্যে বন্ডিং বাড়ালেন। এমন একটা দল তৈরি করতে চাইলেন, যাঁরা দেশের জন্য নিজের একশো ভাগেরও বেশি দেবে। প্রি-কোয়ার্টার থেকে টানা তিনটি ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গেল। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সময় শুরুর আগে দালিচ ফুটবলারদের ডেকে বললেন, “বুঝতে পারছি, তোমরা ক্লান্ত। আমি দলে কয়েকটা বদল আনব। বলো, কে কে বসতে চাইছ?’’
একটা হাতও উঠল না। উলটে গর্জে উঠলেন মদ্রিচরা। “অপেক্ষা করুন। আমরাই এই ম্যাচ বার করে আনব।” সাংবাদিক সম্মেলনে দালিচ যখন মিডিয়াকে তাঁর প্রিয় ছাত্রদের নিয়ে গল্প বলছেন, তখন তাঁর চোখ ভিজে গিয়েছে। আর্জেন্টিনা বধের দিনও কেউ ক্রোয়েশিয়াকে পাত্তা দেয়নি। এমনকী, ইংল্যান্ড ম্যাচের আগেও। অথচ এদিনের পর একবারও কেউ বলতে পারবেন না, ফ্লুকে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে ক্রোয়েশিয়া। ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তাঁর দলকে পিছিয়ে রেখেছিলেন। তিনি এ সব ভালভাবে নেননি। “আমাদের তো অনেকে গুরুত্বই দিতে চাননি। আজ সেই সব মানুষ কোথায়? ওঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, ক্রোয়েশিয়া ভাল খেলেই ফাইনালে।”
ক্রোয়েশিয়া দলের চতুর্ভুজই পুরো খেলা নিয়ন্ত্রণ করছেন। রিয়ালের মদ্রিচ। বার্সেলোনার রাকিতিচ। পেরিসিচ ইন্টারন্যাশিওনাল এবং মান্দজুকিচ জুভেন্তাসের। তবুও ওঁরা দালিচের কোচিংয়ে মাঠে বাজছেন এক সুরে। আর সেখানেই তাল কেটে যাচ্ছে বিপক্ষের। এটাই দালিচের বাজি জেতার প্রধান অস্ত্র। দালিচ মনে করছেন, এই বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার আসল সুর বাঁধাটা শুরু হয়েছিল আর্জেন্টিনা ম্যাচ থেকে। “মেসিদের হারানোর পর আমরা সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করি, ঠিকঠাক পথেই আমরা যাচ্ছি। আর এভাবে ছুটতে পারলে প্রতিপক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।” সেমিফাইনাল নিয়ে দালিচ বলছিলেন, “বিশেষজ্ঞরা আমাদের বিরুদ্ধে। আমরা কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে পরিকল্পনামতো খেলছি। ইংল্যান্ড ম্যাচকেই বিশ্বকাপে আমাদের সেরা পারফরম্যান্স বলে মনে করি।” কথায় কথায় চলে গেলেন ২০ বছর আগে। সেবার সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরেই ক্রোয়েশিয়া ফুটবলের স্বপ্ন থমকে গিয়েছিল। “দিনটা এখনও ভুলতে পারি না। সুকেরের গোলে আমরা তখন দেশে উৎসব পালন করছি। সবাই ধরে নিয়েছি, ফাইনাল খেলা কেউ আটকাতে পারবে না। হঠাৎ করে দু’দুটো গোল করে থুঁরাম আমাদের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিল। এখনও ক্রোয়েশিয়ার মানুষ সেই দিনটার কথা ভুলতে পারেননি।’’
তা হলে ২০ বছর পর বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলের বদলার ম্যাচ হতে যাচ্ছে? প্রসঙ্গটিকে সুন্দর করে ‘ডাক’ করলেন দালিচ। “এটা ফুটবল। খেলাধুলোয় ও সব ‘প্রতিশোধ’ বলে কিছু থাকে না। বিশ্বকে দেখাতে চাই, ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল কারও থেকে কম নয়। আমরা নিজেদের সেরাটা দেব। সেটা ফাইনালে ফ্রান্স না হয়ে বেলজিয়াম হলেও অন্য কিছু হত না। দল দেখে খেলতে গেলে নিজেদের উপর চাপ বেড়ে যায়। আমি একজন কোচ হয়ে সেটা নিশ্চয় চাইব না।” ফাইনাল নিয়ে তা হলে কি পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে ক্রোয়েশিয়া? “ না, না, এখন কেন। আমরা শুধু ফাইনালে ওঠার মুহূর্তটাই উপভোগ করছি। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ফ্রান্স নিয়ে পরে ভাবব। এটাও ঘটনা, ফ্রান্সও যোগ্য দল হিসাবেই ফাইনালে উঠেছে। আজ একটা কথা বলে যেতে চাই, যে দলকে এতদিন দেখে এলেন ফাইনালে তাদের পাবেন না। আপনারা বিশ্বাস করতে না পারলেও বলব, এবার অন্য ক্রোয়েশিয়াকে দেখবে ফ্রান্স।
আপাত নিরীহ, গোবেচারা টাইপ। সাম্পাওলির মতো ডাগ আউটে অযথা লম্ফঝম্ফ নেই। কিন্তু কর্তব্যে অবিচল দালিচ। তাই ফুটবলাররা নাম দিয়েছেন ‘কমান্ডার।’ এই মস্কোর বুকেই আর এক কমান্ডার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল নাৎসি বাহিনীর আক্রমণ। তো ক্রোয়েশিয়ার কমান্ডার নেপোলিয়ন বাহিনীকে আটকাতে পারবেন না?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.