Advertisement
Advertisement
Mohun Bagan

শিবদাস থেকে ব্যারেটো হয়ে দিমি, কর্পোরেট তকমাতেও অমলিন মোহনবাগান আবেগ

পালতোলা নৌকা আসলে সব পেয়েছির প্রতীক। বেঁচে থাকার মন্ত্র মোহনবাগান।

People huddled to Salt lake stadium for Mohun Bagan
Published by: Krishanu Mazumder
  • Posted:May 5, 2024 1:41 pm
  • Updated:May 6, 2024 3:44 pm

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: কতবার শালিক, চিল উড়ে গেল…, নদী তবু আগের মতোই বহমান। কখনও কলকল-খরস্রোতা, কখনও শান্ত লয়ে নিস্তরঙ্গ, কখনও উদ্দাম যৌবনের বাঁধভাঙা আবেগ, কখনও আবার মাঝবয়সি ঢিমেতালের। এই নদীর রং যদি সবুজ-মেরুন হয়, তাহলে কেমন হয়!

এই নদীর রং সবুজ-মেরুনই। বছরের পর বছর। ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড, প্রহরের পর প্রহর, পল-অনুপল, মোহনবাগান আগের মতোই খরস্রোতা। সময়ের পলি জমেনি তার শরীরে।

Advertisement

শতাব্দী প্রাচীন হয়েও যৌবনের উদ্দামতা তার শরীরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক। কর্পোরেট সংস্কৃতির চাকচিক্য এসেছে। তবু এখনও সেই পুরনো লাবডুব, লাবডুব শোনা যায়। বুকের বাঁ দিক বলে ওঠে, মোহনবাগান।

Advertisement

মোহনবাগান মানে একবুক আবেগ। সেই আবেগের সম্মোহনীতে আজ গোটা বাংলার রাজপথ এসে মিশেছিল বাঙালির বড় প্রিয়, বড় আপন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। সবুজ-মেরুন হয়ে উঠেছিল জীবনের রং। যুবভারতী হয়ে উঠেছিল মোহনভারতী। আট থেকে আশি–শামিল সেই জীবনের উৎসবে। দিনান্তে সেখানে বিষাদ সিন্ধুর হাহাকার। এই মন ছুঁয়ে যাওয়া ভালোবাসা, প্রিয় দলের জন্য এমন তীব্র আকর্ষণ পুরোটাই কার্ডিয়াক। 

শনি সন্ধ্যার মোহনবাগান-মুম্বই লড়াই দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই যুবভারতী। ভেসে উঠছিলেন সবুজ-মেরুনের ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়ছেন হোসে রামিরেজ ব্যারেটো। মোহনবাগান সমর্থকরা গাইছেন, “ইন ব্যারেটো, উই ট্রাস্ট।” প্রেস বক্সে চিৎকার, ”পাঁচ-পাঁচ।” সেই সঙ্গে হাতের পাঞ্জা দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। মোহনবাগান পাঁচ গোল দিয়েছে ইস্টবেঙ্গলকে। ৫-০-র বদলা ৫-৩। 

[আরও পড়ুন: জাতীয় শিবিরের জন্য ২৬ ফুটবলারকে ডাকলেন স্টিমাচ, নেই মুম্বই-মোহনবাগানের কেউ!]

সবুজ-মেরুনের সাজঘরে তখন অন্য দৃশ্য। ক্লান্ত, অবসন্ন সবুজ তোতা শরীর টেনে টেনে এসে ধপ করে বসে পড়লেন ওই সাদা চেয়ারটায়। পাশের চেয়ারে অনেক আগে থেকেই বসে রয়েছেন আরেক ব্রাজিলীয় মার্কোস পেরেরা। চোখের নীচটা ফেটে গিয়েছে তাঁর। রক্ত বেরোচ্ছে তখনও। কে যেন ভিড়ের মধ্যে বলে গেলেন, ”ব্যারেটো হল মিস্টার মোহনবাগান।”

ISL 2023-24: Mohun Bagan urge state government and Metro railway to arrange buses and metro for their supporters
ফাইল ছবি

এই মাঠেই কেরিয়ারের শেষ ম্যাচে গোল রয়েছে মিস্টার মোহনবাগানের। বাঁ পায়ের ওই গড়ানে শটটা ঘাসের বুক চিরে জালে জড়িয়ে গেল। প্রভু যিশুকে আকাশে খুঁজছিলেন ব্যারেটো। এদিন অবশ্য সর্বাঙ্গসুন্দর হল না বিষয়টা। মুম্বইয়ের কাছে থামতে হল। আইএসএল খেতাব জেতা হল না। তাতেও অবশ্য আবেগ কমছে না। কমছে না ভালোবাসা। 

কলকাতা ময়দান বদলে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেট সংস্কৃতি এসেছে ক্লাবে। বিদেশি ফুটবলের ছোঁয়া লেগেছে বহিরঙ্গে। অনুশীলনে এসেছে নিষেধাজ্ঞা। এখন আর আগের মতো খুল্লমখুল্লা সব নয়। এক যুগ বা এক দশক আগে যে ছবি দেখা যেত ময়দানে, এখন আর তা নেই। মাত্র পনেরো মিনিট মিডিয়ার জন্য বরাদ্দ। ভক্ত-অনুরাগীরা আগের মতো অনুশীলন দেখতে পান না সবুজ-মেরুন তারকাদের। ম্যাচে কী স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হচ্ছে, প্রথম একাদশ কী হবে, তা জানার অবকাশ কম।

কামিন্স-পেত্রাতোস-কাউকোদের জনপ্রিয়তা এখন আকাশছোঁয়া। তাঁদের ছুঁয়ে দেখার, তাঁদের সঙ্গে ভালো ভাবে মিশে যাওয়ার অবকাশও কম। বাধাবিঘ্ন, প্রোটোকল, নিষেধের কবলে পড়ে উদযাপনের সুযোগও কম। দূর থেকেই তাঁদের নিয়ে চলে বীরপুজো।

মনে পড়ছে প্রায় এক যুগ আগের এক ডার্বির আগেরদিনের সকালের কথা। মোহনবাগান মাঠে এক নাইজেরীয় তখন চিৎকার করছেন। বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। তাঁর স্ত্রীর দেওয়া হিরের দুল কান থেকে খসে পড়েছে কোথায়। ওডাফা-ওডাফা চিৎকারে আকাশবাতাস বিদীর্ণ। ক্ষুব্ধ ওডাফা কাকে যেন নালিশ করছেন, ”আমার স্ত্রীর দেওয়া দুলটা হারিয়েই গেল!”

ছায়াসঙ্গী এক ভক্তকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওডাফা বললেন, ”সবাই ওডাফা-ওডাফা করছে।” তার পরেই দৌড়ে গেলেন মাঠের ভিতরে। খুঁজে দেখলেন হিরের দুলটা কোথাও পড়ে রয়েছে কিনা। ওডাফা সত্যিকারের হিরে ছিলেন। দুলটা তিনি আর পাননি। ওডাফা থেকে সোনি নর্ডি হয়ে এখন দিমিত্রি পেত্রাতোসের যুগ সবুজ-মেরুনে। এখন কি আগের সেই বীরপুজো দেখা যায়? অনুশীলনের শেষে কি ঢল নামে কোনও তারকার জন্য?

তবুও…তবুও কীসের টানে এই পাগলপারা ভালোবাসা! হৃদয়ের একুল-ওকুল দুকুল ছাপিয়ে যাওয়া এই আবেগের রহস্য কী! সবুজ-তোতা ব্যারেটো নস্ট্যালজিক। ব্রাজিলীয় বলছেন, ”আমি যদি পাখি হই, মোহনবাগান তাহলে আমার আশ্রয়স্থল। আমাকে ছায়া দিয়েছে, বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ২২ বছর বয়সে খেলতে এসেছিলাম মোহনবাগানে। আমার ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত খেলেছি মোহনবাগানে। মোহনবাগানের জন্য আজ আমার পরিচিতি। মোহনবাগান ইজ লাইক ইটস পার্ট অফ মাই স্টোরি।”

ফাইল ছবি

এগারোর শিল্ড জয়ী অমর একাদশ দলের অধিনায়ক ছিলেন শিবদাস ভাদুড়ি। তাঁর প্রপৌত্রী দেবিকা রায় বলছিলেন, ”মোহনবাগান নামটাই একটা আবেগ।” এই আবেগের জন্যই ছুটে যাওয়া।

একটা সবুজ মাঠ, সবুজ-মেরুন জার্সি, গোলপোস্ট, আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ি- সবমিলিয়ে আগেও যেমন অনুভূতি বয়ে আনত, এখনও সেই একই ঢেউ হৃদয়কে দোলা দিয়ে যায়। ফ্যান ক্লাব স্বপ্নের উড়ান মোহনবাগানের সদস্য উজ্জ্বল মণ্ডল বলছেন, ”একটা কথাই বলব। ভালোবাসা থেকে যাবে চিরকাল। সেই ভালোবাসা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে।” মোহনবাগানও বয়ে চলবে নদীর মতো।

গত বৃহস্পতিবার ছিল সত্যজিৎ রায়ের ১০৩ বছরের জন্মদিন। তাঁর ছবি ‘জনঅরণ্য’ এখনও সিনেপাগলদের স্মৃতিতে টাটকা। সেই ছবিরই চেনা দৃশ্য, কলকাতা ময়দানে, আকাশবাণী ভবনের কাছে একটা স্ট্যাচুর পাশে বসে নায়ক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর বন্ধু গৌতম চক্রবর্তী চিনে বাদাম খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠেছেন।

তাঁরা বেকার। চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠান। কিন্তু কিছুতেই কপাল খোলে না তাঁদের।  
দূরের মোহনবাগান মাঠে তখন হঠাৎ প্রবল গর্জন। মোহনবাগান মাঠের গ্যালারিতে শুরু হয়েছে উৎসব। এর মধ্যেই মাঠ ফেরত এক ব্যক্তিকে দেখে গৌতম প্রশ্ন করে ওঠেন, ”ও দাদা, এই যে, ও দাদা, কী হল দাদা?”
উত্তর এল, ”থ্রি টু ওয়ান।”
-কে জিতল?
উত্তর আসে, ”মোহনবাগান।”
এদিকে খেলা ভাঙার পরে মাঠ ফেরত জনতা বেকার না চাকরিজীবী তা নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠেন দুই বন্ধু। এক ব্যক্তিকে দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দেন গৌতম, ” দাদা, আপনি পাস না অনার্স?” প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যান সেই ব্যক্তি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠেন, ”মোহনবাগান।” সত্যজিতের ছবিতে একাত্ম হয়ে যায় মোহনবাগান, কলকাতার ফুটবল।  
পালতোলা নৌকা আসলে সব পেয়েছির প্রতীক। বেঁচে থাকার মন্ত্র মোহনবাগান। আমাদের বুকে যা ছুঁয়ে রয়েছে আজীবন। মোহনবাগান সেই মহাসঙ্গীত, যা মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসে। হার বা জিত সেই আবেগে চিড় ধরাতে পারে না, পারবেও না কোনওদিন। 

[আরও পড়ুন: ‘ভরা গ্যালারি নিয়ে চিন্তা নেই’, লিগ-শিল্ডে হারের জবাব দেওয়াই লক্ষ্য রাহুলদের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ