দুলাল দে, মস্কো: চার বছর আগে বিশ্বকাপ কভার করতে সাওপাওলো বিমানবন্দের নেমে উপলব্ধি হয়েছিল, আসার আগে অন্তত এক মাস কলকাতায় যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমিতে ক্লাস করে নেওয়াটা আবশ্যিক ছিল। চার বছর পর মস্কো বিমানবন্দরে নেমেও তো সেই একই উপলব্ধি হল। তবে বিমানেই ইংরেজি জানা এক রুশ সহযাত্রী একান্ত পরামর্শ দিলেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক ভাষা হচ্ছে ‘নির্বাক ভাষা’। অতঃপর, আপাতত ‘যোগেশ মাইম’ ভরসা। কিন্তু ধাক্কাটা শুধুই ভাষাগত কারণে কেন বলি। মস্কোতে এরকম ট্রাফিক জ্যাম হতে পারে এতো কল্পনার অতীত ছিল।
[সুনীলের গোলেও শেষরক্ষা হল না, নিউজিল্যান্ডের কাছে অপ্রত্যাশিত হার ভারতের]
মস্কোর ইমিগ্রশন সেন্টারেই বিশ্বকাপ কভার করতে আসা সাংবাদিকদের জন্য আলাদা লাইন। ইমিগ্রেশনে অন্তত মানুষের জ্যামে আটকে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এয়ারপোর্টের বাইরে যে এরকম তীব্র বিস্ময় অপেক্ষা করছে কে জানত! অসহ্য গরমের কলকাতা–দিল্লির পর মস্কো নেমে সকালেই এরকম হাড় কাঁপানো ঠান্ডার ছোঁয়া পাওয়া সত্যিই এক স্বর্গীয় অনুভূতির সমান। রাশিয়ায় বিশ্বকাপ আছে, উন্মাদনা নেই। কনকনে ঠান্ডার তীব্র স্রোত যেন কর্ণগহ্বর ভেদ করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বকাপের সেই তীব্র ছোঁয়া কোথায়, যা ব্রাজিলে পা দিয়েই অনুভূত হয়েছিল?
[প্রথমবার বিশ্বকাপে ‘ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’, কতটা উপকৃত হবেন ফুটবলাররা?]
এয়ারপোর্টের ঠিক উলটো দিকেই একটি বহুজাতির গাড়ি কোম্পানী বিশ্বকাপের বিজ্ঞাপন করেছে। ইউরোপে যেরকম হয় আর কী। ছয় লেনের রাস্তায় পরপর দুটো মেসি আর নেইমারের নামে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং চোখে পড়ল। কিন্তু মস্কো শহরে গাড়ির জ্যামের গোলক ধাঁধায় এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন যে, সেদিকে তাকাতেও আর ইচ্ছে করবে না। কলকাতার জ্যাম জানেন। কিন্তু মস্কোর জ্যাম মুম্বইকেও হারিয়ে দেবে। এমনিতে ভক্সওয়াগান আর স্কোডা গাড়ির ছড়াছড়ি। কিন্তু জ্যাম! কিলোমিটারের পর কিলোমিটার শুধুই লম্বা জ্যাম। কিন্তু মাত্র সাতদিন পর এখানেই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ। তাতে শহরটা ফুটবলকে কেন্দ্র করে জেগে উঠবে না? মস্কোয় পা দিয়ে মনে হচ্ছিল, এর থেকে কলকাতায় বোধহয় বিশ্বকাপ নিয়ে বেশি মাতামাতি! মেসি-রোনাল্ডো নিয়ে বেশি দেওয়াল লিখন!
[বিশ্বকাপের আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে কী করছেন মহম্মদ সালাহ?]
ঐতিহাসিক রেড স্কোয়ারের ঠিক উলটোদিকে বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে কিছু রেপ্লিকা রয়েছে। এই বিশ্বকাপ ছেড়ে বরং ফ্রান্সে পরের মহিলা বিশ্বকাপ নিয়ে সেখানে উত্তেজনা বেশি। ক্রেমলিনকে বাঁ পাশে রেখে রেড স্কোয়ার দিয়ে মহিলা বিশ্বকাপের ম্যাসকট নিয়ে শোভাযাত্রার কিছু আয়োজন অবশ্য করা হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপের এরকম ম্যাড়ম্যাড়ে হাল কেন? ও দিকে যে বৃটিশদের সঙ্গে কুটনৈতিক স্তরে সম্পর্কের চাপা টেনশন শুরু হয়েছে, সে দেশেরই দুই ফ্যান জ্যামি ম্যারিয়ট আর মিচ জোনস ইংল্যান্ড থেকে ২৪০০ মাইল সাইকেল চালিয়ে এই বিশ্বকাপের আসরে ইতিমধ্যেই হাজির। বিমানে নয়। ট্রেনে নয়। কেন এই দীর্ঘ রাস্তা সাইকেল চালিয়ে? মিচ জোনস রেড স্কোয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এবার বিশ্বকাপটা আমাদের। তাই আমাদের আসাটাও কিছুটা অভিনব ভাবেই হল।’
[জানেন, বিশ্বকাপে রোনাল্ডোর প্রেরণা কারা? শুনলে আপনিও খুশি হবেন]
কুটনৈতিক স্তরে যাই হোক। পুতিন সরকারের সবচেয়ে মাথা ব্যাথার কারণ বোধহয় দাঁড়িয়েছে আর্জেন্টিনার ফুটবল গুন্ডা। নাহলে আর আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারশনের কাছে সেদেশের ফুটবল গুন্ডাদের নাম কেন চেয়ে পাঠাবে রাশিয়া সরকার? বিশ্বকাপ চলাকালীন এই ফুটবল গুন্ডাদের আটকাতে দু’দেশের মধ্যে এদিনই একটা চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেল। যে চুক্তির ফলে দেশের তিন হাজার ফুটবল গুন্ডাদের নাম পুতিন সরকারের হাতে তুলে দিল আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন। ফলে ‘বারা ব্রাভাসদের’ রাশিয়ার কোনও স্টেডিয়ামে ঢোকার সুযোগ পাওয়ার আর বিন্দুমাত্র সুযোগও রইল না। বিশ্বকাপ চলাকালীন এতটাই নিরাপত্তায় মুড়ে দিতে চাইছে রাশিয়া। সঙ্গে সমর্থকদের বিনোদনের দিকেও সমান নজর।