Advertisement
Advertisement
Hockey

কালু স্যরের জাদুকরীতে পানপোশের হকি কারখানা যেন মায়ানগরী

নতুন ভারত গড়ার ক্ষেত্রে দিশা দেখাচ্ছে কলিঙ্গ রাজ্য, আজকের ওড়িশা।

Odisha is showing direction in building new India । Sangbad Pratidin

বিরসা মুন্ডা স্টেডিয়ামের অত্যাধুনিক হকি টার্ফ। ভিনিল কৃষ্ণ ও ভিকে পান্ডিয়ানের সঙ্গে বই নিয়ে বোরিয়া মজুমদার।

Published by: Krishanu Mazumder
  • Posted:January 31, 2024 12:59 pm
  • Updated:January 31, 2024 12:59 pm

বোরিয়া মজুমদার ও ভিনিল কৃষ্ণ: রাউরকেলা এয়ারপোর্টে নামার পর সর্বপ্রথম যে বিষয়টা খেয়াল হবে, তা হল নিস্তব্ধতা। দেশের আর পাঁচটা বিমানবন্দরের মতো নয় রাউরকেল্লা এয়ারপোর্ট। এই বিমানবন্দর চলে নিজের তালে, নিজের ছন্দে। ভুবনেশ্বর থেকে মাত্র একটা ফ্লাইট আসে গোটা দিনে। এক ঘণ্টা পর সেটাই আবার ভুবনেশ্বর ফিরে যায়। ফ্লাইট নয়, ফেরি সার্ভিস বলা ভালো! পরিবেশও বড় মনোরম। একদিকে তাকালে পাহাড় দেখা যায়। আর একদিকে অপরূপ বিরসা মুন্ডা স্টেডিয়াম। ২০২৩ হকি বিশ্বকাপের আসর বসেছিল যেখানে।
বিরসা মুন্ডা স্টেডিয়াম যাওয়ার আগে ঠিক করেছিলাম, পানপোশের স্পোর্টস হোস্টেল যাব। সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে কথাবার্তা বলব। আমরা দেখতে চাইছিলাম, সুন্দরগড় এলাকার জনসাধারণের কাছে হকির মাহাত্ম‌্যটা কী? ভাবতে-ভাবতে যাচ্ছি যখন, রাস্তার ধারের দেওয়ালে কিছু গ্রাফিটি চোখে পড়ল। প্রায় সবই খেলাকেন্দ্রিক, যার মধ‌্যে প্রাধান‌্য পাচ্ছে আবার হকি। আর পানপোশের পথ ধরার পর সেই দৃশ‌্য দেখলাম, যা এত দিন ধরে লোকমুখে শুনে এসেছি। দেখলাম, ছোট্ট এক পতিত জমি। পাশে একটা পুকুর। মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। আর এ সবের মধ‌্যে পাঁচ-ছ’জন খুদে খেলছে। হকি খেলছে! 

[আরও পড়ুন: সাজিকে সরালে কল্যাণেরও সরে যাওয়া উচিত, বিস্ফোরণ বাইচুংয়ের]

 

Advertisement

বুঝলাম কেন বিরসা মুন্ডা স্টেডিয়ামে ভারতীয় হকি টিম খেলতে নামার সময় কুড়ি হাজার প্লাস দর্শক প্রতি ম‌্যাচে খেলা দেখতে এসেছিলেন। বিস্ময় আরও বাড়ল নানারকম গলিঘুঁজি ঘুরে আর একটা ছবি চোখে পড়ার। চোখ ধাঁধানো দু-দু’টো হকি টার্ফ। আর দু’টোতেই হকি ম‌্যাচ চলছে! তদারকিতে দু’জন। প্রথম জন, লাজারাস বার্লা, ভারতের প্রাক্তন হকি প্লেয়ার। আর দ্বিতীয় জন, বিজে কারিয়াপ্পা। যিনি গ্রাহাম রিড আকস্মিক দায়িত্ব ছাড়ার পর ভারতীয় টিমের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রো লিগ শুরুর আগে। একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম পানপোশ স্পোর্টস হোস্টেল। যার দেওয়াল আবারও অসাধারণ। সেখানে ধ‌্যানচাঁদ থেকে দ‌্যুতিচাঁদ, অভিনব বিন্দ্রা থেকে মহেন্দ্র সিং ধোনি–প্রত‌্যেকের ম‌্যুরাল রয়েছে।
পানপোশ হোস্টেলের গরিমা বড় কম নয়। গত দু’দশক ধরে পঁচাত্তরজন জাতীয় প্লেয়ারের জন্ম দিয়েছে এই হোস্টেল! আমরা সেখানে ঢোকামাত্র কয়েক জন কিশোরী আমাদের অভ‌্যর্থনা জানাল। যাদের পরনে হকির পোশাক। একটু পর পুরুষদের টিমের সঙ্গে খেলতে নামবে তারা। যারা আমাদের দেখে একটু অবাকই হয়েছে মনে হল। ঠিক তখনই কালুচরণ চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় করানো হল। ২০২১ সালের বিজু পট্টনায়েক পুরস্কারপ্রাপ্তর সঙ্গে। পানপোশে কালুচরণ চৌধুরীকে কালু স‌্যর বলে ডাকা হয়। পানপোশে যিনি আছেন সাতাশি সাল থেকে। বর্তমান হকি ইন্ডিয়া প্রেসিডেন্ট দিলীপ তিরকের কোচ ছিলেন যিনি। এবং চা নিয়ে বলতে কালু স‌্যর প্রথম আমাকে ঝটকাটা দিলেন।
‘‘অমিত রোহিতদাস এই হোস্টেলের ছেলে,’’ বললেন কালু স‌্যর। ‘‘আপনারা নিশ্চয়ই ওকে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে দেখেছেন। আমাদের হোস্টেল থেকে পঁচাত্তরজন প্লেয়ার দেশের হয়ে খেলেছে। এখনও কয়েক জন আছে জাতীয় ক‌্যাম্পে।’’ সে সংখ‌র চেয়েও আমার বেশি করে জানতে ইচ্ছে করছিল কালু স‌্যরকে নিয়ে। যিনি প্রকৃতার্থে দ্রোণাচার্য। কিন্তু কখনও প্রাপ‌্য প্রচার পাননি।
‘‘আগে এখানে পুরোটাই ফাঁকা জমি ছিল,’’ হাসতে হাসতে বলছিলেন কালু স‌্যর। পানপোশের মাঠেই দিলীর তিরকের সঙ্গে দেখা হয় কালু স‌্যরের। ‘‘দিলীপ প্রথমে স্ট্রাইকার ছিল, জানেন? কিন্তু ফরোয়ার্ড লাইনে তখন জায়গা ছিল না। মিডফিল্ডেও না। শেষে ডিফেন্ডার হিসেবে ট্রায়াল দিল দিলীপ। বাকিটা ইতিহাস।’’
ঠিক তখনই লাজারাসকে শুনলাম, চেঁচিয়ে এক কিশোরী প্লেয়ারকে কোনও নির্দেশ দিতে। বার্লা ততক্ষণে আবার মধ‌্যবয়স্ক পুরুষ টিমের হয়ে খেলছেন, খেলতে খেলতে কোচিংও করাচ্ছেন। বার্লা কালু স‌্যরের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। আজও। ‘‘কী প্রতিভা ছিল, সত‌্যি! একবার ক‌্যাম্পে ফিরে শুনলাম, বার্লা পালিয়েছে। বাড়ি খুব টানত ওকে। শোনামাত্র স্কুটারে চেপে পাকড়াও করলাম। কিন্তু বার্লা তার পর আবার পালায়,’’ ফের হাসেন কালু স‌্যর। ‘‘ওর মাত্র একটা প‌্যান্ট ছিল। সেটা পরেই পালিয়ে গিয়েছিল। আমিও বুঝতে পেরেছিলাম যে, শুধুমাত্র খেলতে এসো বললে হবে না। এদের আর্থিক দিকটাও দেখতে হবে। বার্লাকে আবার ধরে এনে নিয়ে যাই সরকারি দোকানে। টি শার্ট, প‌্যান্ট কিনে দিই। দিলীপ এবং লাজারাসের ডিফেন্স ছিল নিশ্চিদ্র।”
নয়ের দশকে লাজারাস, দিলীপ যেমন, এখন তেমনি হল অমিত রুইদাস। কালু স‌্যর বলছিলেন, “শর্ট কর্নারে ওর মতো দ্রুতগতির কাউকে দেখিনি। পুরোঅলরাউন্ড প্লেয়ার।” এই মুহূর্তে দেশের অনেক উঠতি প্লেয়ারদের কাছে রোলমডেল হলেন অমিত। সুন্দরগড়ের মতো একটা প্রত্যন্ত জেলা থেকে উঠে এসে ভারতীয় দলের সহ অধিনায়ক হওয়া সহজ কথা নয়। কীভাবে প্রতিভাবান তরুণ তুর্কিকে পানপোশ সাহায্যের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল অমিত রোহিদাস।
১৯৯৪-তে প্রথম টার্ফ পিচ পায় পানপোশ। সেটা শুধুমাত্র ছেলেদের অনুশীলনের জন্য। মেয়েরা নাকি সেই সময় এতটা উৎসাহী ছিলেন না খেলাটা নিয়ে। কালুচরণ চৌধুরীই বলছিলেন। ধীরে ধীরে ছবিটা বদলাতে থাকে। হোস্টেলের মেয়েদের মধ্যে হকির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বর্তমানে সেটাই সামাজিক দিক থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠার বড় মঞ্চ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও খেলাটায় এখনও বেশি অর্থ নেই। যা আছে, তা হল, সম্মান আর ভালোবাসা।
“এখন মেয়েরাও খেলে। আমি চাই, আমাদের এখান থেকে যত বেশি সংখ্যক মেয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করুক,’’ বলছিলেন কালু স‌্যর। সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘স্পোর্টস সায়েন্স ও টেকনলজি-র ব্যাপারে এখনও এখানকার খুদে হকি অনুরাগীদের ধারণা স্পষ্ট নয়। অধিকাংশই যে এখানকার আদিবাসী পরিবার থেকে আসে। হকি তাদের কাছে একটা স্বচ্ছল জীবন ধারণের উপায় মাত্র। হকি-স্টিক তাদের কাছে জাদুদণ্ড।”
পানপোশে একসময় কিছু ছিল না। আজ সব আছে। আল্ট্রা-মর্ডান টার্ফ, স্পোর্টস হোস্টেল, শিক্ষার্থীদের জন্য সুষম খাদ্য– সব। গত বছর, এখান থেকে দু’টো দল, ছেলে ও মেয়েদের মালয়েশিয়ায় এক্সপোজার-টুরও করে এসেছে। স্পোর্টস-সেক্রেটারি ভিনিল কৃষ্ণ, সেই কথাই বলছিলেন। “গত কয়েক বছরে রাজ্য সরকারের তৎপরতায় সবকিছু রাতারাতি বদলে গিয়েছে। নতুন টার্ফ বসেছে। সবকিছুই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফসল। ভুবনেশ্বরে তাই জাতীয় ক্যাম্প হলে এখানে প্রশিক্ষণ নিতে সমস্যা হয় না। ঘাস ও টার্ফে যাতে ছেলে ও মেয়েরা সমানভাবে প্রশিক্ষণ নিতে পারে, তার জন্য নির্দিষ্ট সূচি রয়েছে।”
এত শত পালাবদলের মধ্যেও যা ধ্রুবক, যা অপরিবর্তনীয় তা হল, কালুচরণ চৌধুরি। সেই ১৯৮৭ থেকে ২০১৪– পানপোশকে বুকে আগলে রেখেছেন তিনি। তার হাত ধরেই উঠে এসেছেন তিরকে, লাজারাস, ইগনেস তিরকে। আর এখন? অমিত রোহিদাসের মতো তারকা। এখন ২০০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে নতুন স্বপ্নে বিভোর তিনি। আশা একটাই, এই খুদে শিক্ষার্থীই একদিন সাফল্যের আলো জ্বালবেন ভারতীয় হকির, বিশ্বমঞ্চে। কালু স্যর বলছিলেন, “কোভিডের কারণে আমাদের স্কাউটিং বন্ধ ছিল। যে কারণে দু’বছর সাপ্লাই লাইন গড়েই ওঠেনি। কত প্রতিভা, বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা হয়নি এই সময়টায়। ভাবলেই কষ্ট লাগে। তবে সেই দুর্যোগ কাটতেই আমরা নতুন উদ্যোমে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। দেখা যাক।”
২০১৪ থেকে ২০২২– দীর্ঘ আট বছর ভুবনেশ্বরে হকি নিয়ে কাজ করার পর কালু স্যর এক্সটেনশন নিয়ে ফিরে এসেছেন পানপোশে, যেখান থেকে তাঁর কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। ধাত্রীপুত্র হিসেবে তাঁরও তো ফিরিয়ে দেওয়ার আছে। সেই স্বপ্নে বিভোর কালু স্যর– ভারতীয় হকির নীরব সাধক। শুধু কালু স্যর নন, ধন্যবাদ প্রাপ্য ওড়িশা সরকারেরও। যে স্বপ্নকে সামনে রেখে তাদের এই কর্মযজ্ঞ, তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। নতুন ভারত গড়ার ক্ষেত্রে দিশা দেখাচ্ছে কলিঙ্গ রাজ্য, আজকের ওড়িশা।

Advertisement

(সাইমন অ‌্যান্ড শুস্টার্স দ্বারা প্রকাশিত ‘ওড়িশা অ‌্যান্ড স্পোর্টস: আ স্টোরি অপ হোপ অ‌্যান্ড গ্লোরি’ থেকে নেওয়া নির্বাচিত অংশ)

 

[আরও পড়ুন: বিমানে ঠিক কী হয়েছিল মায়াঙ্কের? আসল ঘটনা জানালেন কর্নাটক দলের টিম ম্যানেজার]

 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ