সহিষ্ণুতার বিদায়ঘণ্টা বেজে গিয়েছে৷ ভারতের নয়া নীতি, মারের পাল্টা মার, আরও মার৷ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর একধাক্কায় চাঙ্গা সীমান্তের জওয়ানরা৷ বলছেন, “দুশমন শিকার, আমরা শিকারী৷” কী এমন ভোকাল টনিক দিলেন প্রধানমন্ত্রী? উত্তর খুঁজলেন দীপেন্দু পাল৷
এলওসি, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, রি-ইনফোর্সমেন্ট- গত ২৯ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এই জাতীয় শব্দগুচ্ছের ব্যবহার জাতীয় সংবাদমাধ্যমে হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে৷ সৌজন্যে অবশ্যই ছাপান্ন ইঞ্চির ছাতিওয়ালা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ গত ১৮ সেপ্টেম্বর জম্মু ও কাশ্মীরের উরি শহরে সেনা ছাউনিতে লস্কর জঙ্গি হামলার বদলা নিতে ২৮ সেপ্টেম্বরের ভোররাতে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে অন্তত ২০ জন লস্কর জঙ্গিকে নিকেশ করে আসে ভারতীয় সেনার প্যারা-কমান্ডোরা৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর- এত বড় মাপের অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মোদিকে দেশের সবচেয়ে সাহসী প্রধানমন্ত্রীর উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন৷ আর যাবেন নাই বা কেন, এর আগে দেশের কোন প্রধানমন্ত্রী সাহস দেখিয়েছেন শত্রুরাষ্ট্রের সীমান্তে ঢুকে জঙ্গিদের লঞ্চপ্যাড গুঁড়িয়ে দেওয়ার? দুর্ভাগ্য এই, যে দেশটার নাম ভারতবর্ষ! তাই জঙ্গিদের হত্যা করেও প্রশংসা নয়, বরং সমালোচনা জোটে প্রধানমন্ত্রীর কপালে! রাহুল গান্ধীর মতো নেতা, যিনি মহিলা কলেজে ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়ামে বক্তৃতা দিতে গিয়ে হাসির খোরাক হন, তিনিও এই সুযোগে মাঠে নেমে পড়েছেন৷ তাঁর দাবি, সেনার কৃতিত্বে ভাগ বসাচ্ছেন মোদি, আরএসএস৷ অথচ মনোহর পারিক্কর স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের একশো শতাংশ কৃতিত্বই সেনার৷ আর সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে হামলা চালানোর মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য খানিকটা হাততালি পাওয়ার যোগ্য মোদি৷ তাঁর নির্দেশেই সীমান্তে কর্তব্যরত জওয়ানদের এখন মূলমন্ত্র- “দুশমন শিকার, আমরা শিকারী৷”
এই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন মায়াবতী ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও৷ কংগ্রেস আবার ভাসিয়ে তুলতে চাইছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ‘অপারেশন জিঞ্জার’-এর সাফল্যকেও৷ কিন্তু প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি অপারেশন লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিনোদ ভাটিয়া স্পষ্ট করে দিয়েছেন, জিঞ্জারের তুলনায় চলতি বছরের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক অনেক বেশি জটিল ও ব্যাপক স্কেলের৷ মোদি অবশ্য এই সব সমালোচনার থেকে বহু ক্রোশ দূরের গ্রহে অবস্থান করেন৷ মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্কের উষ্ণতার আঁচ উসকে দিয়ে সকলের চোখের আড়ালে মাস্টারস্ট্রোকটি কিন্তু হেঁকে ফেলেছেন তিনি৷ নর্থ ব্লকের বড় কর্তারা তাঁকে খবর দিয়েছিলেন, অস্ত্রশস্ত্র কিনতে ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের নয়া সখ্যতায় ঈর্ষায় জ্বলছিল ইসলামাবাদ৷ তারা এই সুযোগে রাশিয়ার সঙ্গে মাখামাখিটা বাড়িয়ে ফেলতে চাইছিল৷ কিন্তু মোদি সেই সুযোগ দিলেন না৷ ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নতুন অস্ত্রশস্ত্রের চুক্তি ঝালিয়ে নিলেন৷ আমেরিকা তো আগে থেকেই ভারতের পাশে ছিল, এখন রাশিয়াকেও পাশে পেয়ে চিন ও পাকিস্তানকে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পূর্ণতা নিয়ে কড়া বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ এস-৪০০ ট্রিআম্ফ লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম, কামভ-২৮ হেলিকপ্টার ও আরও নতুন সুখোই ৩০-এমকেআই কেনার চুক্তি চূড়ান্ত হবে গোয়ায়৷ ফিফথ জেনারেশন ফাইটার এয়ারক্রাফট কামভ-২২৬ লাইট চপারকে আরও উন্নত করার কথাও হচ্ছে৷ এই চুক্তি সম্পাদিত হলে এটাই হবে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বৃহত্তম অস্ত্র-চুক্তি৷ সবথেকে বড় কথা, সেনার সাজ-সরঞ্জামকে উন্নত করতে এখন শুধু ডিআরডিও নয়, আসরে নেমে পড়েছে দেশের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরোও৷ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সাফল্যের পিছনে কিন্তু এ দেশের বৈজ্ঞানিকদেরও অবদান রয়েছে৷ শুধু হাতে নয়, প্রয়োজনে পাকিস্তানকে ভাতে (পড়ুন জলে) মারারও ক্ষমতা রয়েছে ভারতের৷ কিন্তু এখনই সিন্ধু জলবন্টন চুক্তি বাতিলের পথে হাঁটছে না ভারত৷ তবে এই চুক্তি নিয়ে পাকিস্তানের উপর চাপ বজায় রেখে যাবে নয়াদিল্লি৷ এই চুক্তির আওতায় যে তিনটি নদী থেকে বেশি জল পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়, সেই তিন নদীর জল বৃহত্তর ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে ভারত৷ একা ভারতেরই জন্য ইসলামাবাদকে সার্ক সম্মেলন বাতিল করতে হয়েছে৷ কারণ, উরি হামলার পর এক কথায় নয়াদিল্লির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অন্যান্য সার্কভূক্ত রাষ্ট্রগুলি৷
পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলার যে আঁটসাঁট পরিকল্পনা করে ফেলেছেন মোদি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাঁর সঙ্গে তুলনা চলে একজনেরই৷ তিনি রুশ সর্বাধিনায়ক ভ্লাদিমির পুতিন৷ এই পুতিনই আইএসআইএস জঙ্গিদের শক্ত ঘাঁটি সিরিয়ার রাক্কায় বিপুল সেনা অভিযানের প্রস্তুতি সেরে রেখেছিলেন৷ প্যারিস হামলার পর প্রায় ১,৫০,০০০ জন রুশ সেনা তৈরি ছিল যে কোনও মুহূর্তে সিরিয়ার জঙ্গি-রাজধানীতে হামলা চালাতে৷ এমনকী, আইএস জঙ্গিদের সমূলে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনে চিরশত্রু আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী মহাজোটেও অংশ নিতে প্রস্তুত ছিলেন পুতিন৷ আইএস-এর বিরুদ্ধে তাঁর হুঙ্কার, “রাশিয়ায় একটাও বোমা পড়লে প্রতি আধঘন্টায় এক একজন করে মুসলিম মারব৷” কিন্তু এ দেশের প্রধানমন্ত্রী একবারও মুখে সে কথা বলেননি৷ কারণ, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র৷ তবু মোদির কপালে জুটে যায় কট্টর হিন্দুত্ববাদীর তকমা৷ লখনউয়ের দশেরা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করে মোদি শুধু এটুকুই বলেছেন, আমরা প্রতি বছর রাবণের মূর্তি জ্বালাই, কিন্তু তার থেকে কি কিছু শিক্ষা নিই? মানুষের ভিতরেই লুকিয়ে থাকা অশুভই যে রাবণ! ভারত বুদ্ধের (জ্ঞান)দেশ, যুদ্ধের নয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ মানবতার শত্রু। দেশের ১২৫ কোটি মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক সুরে কথা বললে এই রাবণকে দমন করা যায়।” মুখে না বললেও মোদি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সন্ত্রাসকে সাহায্য করে, সন্ত্রাসে মদত দেয় যে পাকিস্তান, তাদের কোনও ভাবেই ছাড়া হবে না। প্রয়োজনে আবার সীমান্ত পেরিয়ে হামলা হবে৷