সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়: ২০১৪ সাল। বছর তিনেক আগেও সিলেটের সাদামাটা ‘মুক্তমনা’ তরুণ সামশাদ ছিল মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার। এমনকী, ধর্মকর্মেও তার খুব একটা গরজ ছিল না। বরং বলা যেতে পারে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ নিয়েই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত সামশাদের। পরিবারেও ছিল না ধর্মীয় কোনও গোঁড়ামি। ছিল সচ্ছলতা। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কৃতী এই ছাত্রের জীবনের চাকাটা হঠাৎ করে ঘুরে গেল তিন বছর আগে। তার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হল চরম ধর্মীয় গোঁড়ামি। এরপর কোনও একদিন চোখ বন্ধ করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল জেহাদি গোপন ডেরায়। সেখানেই ‘আনসার বাংলা টিম’-এর অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার সামশাদ রাতারাতি বনে গেল কট্টরপন্থী জেহাদি।
শেখ সামশাদ থেকে হয়ে উঠল সামশাদ মিয়া। স্বভাবেও মিশুকে ছিল বাংলাদেশের সিলেটের তরুণ সামশাদ। চোখেমুখে ছিল দেশের নামী ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। তাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কয়েক বছর আগে সামশাদ ভর্তি হয় সিলেটেরই একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ধর্মকর্মে প্রথম থেকেই তার মন ছিল না। ধর্মীয় দিক থেকে সে অনেকটাই ছিল ‘মুক্তমনা’। এমনকী, নিয়মিত নমাজও পড়ত না সে। মসজিদে যেত বছরে দু’একবার, রোজও নয়।
এই অবস্থায় সিলেটের কলেজেই সামশাদের সঙ্গে আলাপ হয় মামুন নামে আরও এক ছাত্রের। কলেজে মামুন ছিল সামশাদের সিনিয়র। মামুনের মধ্যে ছিল চরম ধর্মীয় গোঁড়ামি। সামশাদের ধর্মীয় নিরপেক্ষতা দেখে অবাক হয়েছিল মামুন। তার উপর সামশাদের মেধা দেখে তাকে ‘টার্গেট’ করে নেয় মামুন। তখন থেকেই ভেবে নেয়, যেভাবেই হোক সামশাদকে ধার্মিক করে আনতে হবে জেহাদিদের ছাতার তলায়। জঙ্গি কার্যকলাপের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে সামশাদের এই মেধাকেই। তখনই দিনের পর দিন সামশাদের মগজ ধোলাই করতে থাকে মামুন। এই মগজ ধোলাইয়ের ফলে প্রথমে প্রতি জুম্মাবারে মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়া শুরু করে সামশাদ।
এরপরেও চলতে থাকে মামুনের মগজ ধোলাই। মামুনের কথায় ক্রমশ ধার্মিক হয়ে উঠতে শুরু করে সামশাদ। পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে সে পড়ে থাকত মসজিদেই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই ছেড়ে সে মুখ গুঁজে থাকত ধর্মীয় গ্রন্থাগারগুলিতে। এই অবস্থায় মামুন একদিন তাকে চোখ বেঁধে এক গোপন ডেরায় নিয়ে যায় সামশাদকে। সেখানে একটি গুরুগম্ভীর গলা শুনতে পায় সে। পরে জানতে পারে সেই গলাই ছিল ‘আনসার বাংলাদেশ টিম’-এর শীর্ষ নেতা মেজর জিয়ার। এই মেজর জিয়াই তাকে জেহাদি মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। জেহাদি মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার পরেই সামশাদকে ভারতে গিয়ে জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ার ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেয় ‘আনসার বাংলা টিম’-এর শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই নির্দেশ মেনে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে দালালের মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে কোনওরকম নথি ছাড়াই এদেশে ঢোকে সামশাদ। সীমান্ত পেরিয়ে ঢোকার পরেই নিজের ইঞ্জিনিয়ারের পরিচয় গোপন করে ফেলে সে। পরিচয় গোপন করে সামশাদ মিয়া প্রথমে চলে যায় হায়দরাবাদের মানেগুড়ায়। সেখানে একটি মাংস তৈরির কারখানায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে শুরু করে সে। সেখানেই অন্যান্য বাংলাদেশি শ্রমিকের সঙ্গে তার আলাপ হয়। তিন মাস পরেই মানেগুড়ার ওই কারখানায় তালা ঝুলে যায়। এরপর হায়দরাবাদ ছেড়ে সামশাদ চলে আসে কর্নাটকের বেলগাঁওয়ে। সেখানেও একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ শুরু করে সামশাদ।
বেলগাঁওয়েই সে তৈরি করে জাল আধার কার্ড। এই কার্ড দেখিয়েই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলে সে। লালবাজারের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স বা এসটিএফের গোয়েন্দারা তদন্তে দেখেছেন, সামশাদের ওই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় পাঁচ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা ঢুকেছিল। যা লেনদেন হয়েছিল হাওয়ালার মাধ্যমে। কর্নাটকের পর সে চলে যায় পুণায়। সেখানেও একটি বহুতল নির্মাণ সংস্থায় রাজমিস্ত্রির কাজ করত। এই কাজের আড়ালেই চলত তার জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরি করার কাজ। পুণের পর বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে সে দশমীর দিন চলে আসে কলকাতায়। হায়দরাবাদ, পুণে, কর্নাটকের পর এবার তার ‘টার্গেট’ ছিল কলকাতা। হায়দরাবাদের একটি কারখানায় কাজ করতে করতেই সামশেদের সঙ্গে আলাপ হয় ‘আনসার বাংলা টিম’-এর আরও এক বাংলাদেশি জঙ্গি রিয়াজুল ইসলামের। সেখান থেকেই তারা দু’জনেই বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ মতো কাজ করতে থাকে। তাদের কাছ থেকে কলকাতার জনবহুল স্থান, ধর্মতলা, ইডেন, হাওড়া ব্রিজ-সহ কলকাতার বেশকিছু নামী স্কুলের নকশা পাওয়া যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.