কিশোর ঘোষ: মুছে ফেলা হচ্ছে শেখ মুজিবর রহমানের যাবতীয় স্মৃতি, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিলে নেমে আসছে শাস্তির খাঁড়া। ভাঙচুর হচ্ছে মন্দিরে। খুন হচ্ছেন প্রবীণ পুরোহিত। প্রশাসনের অনুমতি সত্ত্বেও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে লালন স্মরণোৎসব, বসন্ত উৎসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুসলিম কৃতিদের নামের ভবনগুলির নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে। ভালোবাসা দিবসে ভাঙচুর হচ্ছে ফুলের দোকানে। এভাবেই মহম্মদ ইউনুসের বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জামাত, তৌহিদি জনতার মতো মৌলবাদীরা। এই তৌহিদি জনতার বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে ‘আপত্তিকর’ কবিতা পোস্ট করে জেলবন্দি বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ কবি সোহেল হাসান গালিব। যদিও হাসিনা বিরোধী এবং ধার্মিক চরিত্রের বলেই পরিচিত গালিব। তারপরেও প্রশাসনের রোষানলে পড়লেন কেন?
‘জুলাই বিপ্লবে’র সময় থেকে এই কবির ফেসবুক পোস্ট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তিনি শেখ হাসিনার শাসনকালের ফ্যাসিবাদের সমালোচক। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন গালিব। তাঁর লেখালিখির মধ্যে ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ নয়, বরং আনুগত্যই লক্ষ্য করা যায়। এর পরেও মৌলবাদীদের রক্তচক্ষু এড়াতে পারলেন না একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক এবং ঢাকার ইডেন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সোহেল হাসান গালিব। সম্প্রতি ফেসবুকে ‘তৌহিদি জনতা’ শিরোনামে একটি কবিতা পোস্ট করেন তিনি। সেই লেখায় বেশ কিছু ‘ইতর’ শব্দ প্রয়োগ করেন। কবিতাটিতে ছিল সংবেদনশীল ধর্মীয় অনুসঙ্গ। রে রে করে ওঠে মৌলবাদীরা। ধর্মের ধ্বজাধারীরা চরম শাস্তির দাবি তোলেন কবির। গালিবের বিরুদ্ধে মিছিল বের করে উত্তেজিত জনতা। অন্যদিকে নিচু স্বরে হলেও বাকস্বাধীনতার প্রশ্ন তুলেছেন এবং তুলছেন পদ্মাপাড়ের শিক্ষিত জনতা।
সূত্রের খবর, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা নাগাদ গ্রেপ্তার করা হয় গালিবকে। প্রাথমিকভাবে তাঁকে ঢাকার মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। শুক্রবার বিকেলে তাঁকে এফআইআর বিহীন একটি মামলায় চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়েছিল বলেও খবর। জানা গিয়েছে, ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’র নামে বন্দি রয়েছেন তিনি। কীসের নিরাপত্তা? জামাত, তৌহিদি জনতার মতো উগ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলা চালাতে পারে, এই ভয় জনিত নিরাপত্তা। অনেকেরই বক্তব্য, গালিব তাঁর কবিতায় ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেননি আদৌ। বরং সাম্প্রতিক বাংলাদেশে যে অরাজকতা, হিংসা ও হানাহানি চলছে, নিরীহ সংখ্যালঘুরা টার্গেট হচ্ছে, মুজিবের বাড়ি ভেঙে ফেলা, জয় বাংলা স্লোগানে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে সর্বস্তরে বাঙালি জাতিসত্তাকে মুছে ফেলার চক্রান্ত শুরু হয়েছে, বিতর্কিত কবিতায় সেই তালিবানি শাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। তৌহিদি জনতার মতো ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে মত প্রকাশ করেন তিনি।
হিন্দুদের মতোই আজকের বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিপন্থী’ জনতার বক্তব্য, তৌহিদি জনতার বিরুদ্ধেই ‘জরুরি রাগ ও ঘৃণা’ প্রকাশ করেছেন গালিব। যেহেতু তিনি হাসিনা বিরোধী হলেও, মানবিকতা, মুক্ত চেতনা, সর্বোপরি বাংলাদেশ বিরোধী নন। উল্লেখ্য, গালিবের গ্রেপ্তারির খবর নিশ্চিত করতে তাঁর সময়ের বাংলাদেশের এক তরুণ কবি ও সাংবাদিকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কবি ও সাংবাদিক গালিবের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে চাননি। ভয়ে ভয়ে বলেন—“নিরাপত্তা হেফাজতের নামে গ্রেপ্তার হয়েছে গালিব।” খানিক থমকে বলেন, “ওঁকে সাবধান হতে বলেছিলাম, হলেন না!” শঙ্কিত হয়ে আরও বলেন, “কাল আমিও (গ্রেপ্তার) হতে পারি।”
তাহলে কি সোহেল হাসান গালিবের মতোই ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার বিরোধী এই তরুণ কবিও? না। বরং উগ্র মৌলবাদের সিঁড়ি বেয়ে, ধানসিঁড়ি নদী তীরে হিংসা ছড়িয়ে ‘তৌহিদি জনতা’র মতো যে গোষ্ঠীগুলি আজ ক্ষমতায়, তাদের বিরুদ্ধে কথাই বলাই আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় গুনাহ!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.