গ্রাফিক্স: সোমোশ্রী দাস
অর্ণব দাস, বারাকপুর: বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বেলঘরিয়ার জনবহুল রাস্তায় স্ত্রীর গায়ে আগুন লাগিয়ে খুনের চেষ্টার অভিযোগ ঘিরে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল শুক্রবার। কিন্তু ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চিত্র বদল! অগ্নিদগ্ধ মহিলার বয়ান আরও সন্দেহ উসকে দিল তদন্তকারীদের। ওই মহিলা স্বামীর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ করলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অকুস্থল থেকে কাউকে বাইক বা অন্য গাড়িতে করে কাউকে পালাতে দেখেননি। এছাড়া পারিপার্শ্বিক অন্যান্য প্রমাণও ইঙ্গিত করছিল, ঘটনা অন্য কিছু। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ এখন প্রায় নিশ্চিত, কোনও হত্যার পরিকল্পনা হয়নি, আত্মহত্যার চেষ্টায় গায়ে আগুন দেন ওই মহিলা। তাঁর মানসিক স্থিতি নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় কামারহাটি পুরসভার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের আর্যনগর অনুপমা রোডের আচমকাই অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এক মহিলাকে। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিল, সঙ্গীতা নামের মহিলা খড়দহ থেকে বেলঘরিয়ায় বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলেন। সেখান থেকে বেরলে তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলা হয়। কাঠগড়ায় তোলা হয় তাঁর স্বামী ও দুই বন্ধুকে। প্রাথমিকভাবে এই অভিযোগের ভিত্তিতে স্বামী নিলয় সরকারকে রাতে আটক করে পুলিশ। তাঁকে জেরা করে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার সময় নিলয় আদৌ সেখানে ছিলেন না, ছিলেন ভবানীপুরের অফিসে।
এতে বিভ্রান্তি বেড়ে যাওয়ায় সঙ্গীতার পরিবারকে খবর দেয় বেলঘরিয়া থানার পুলিশ। খবর পাওয়া মাত্রই তাঁর মা-বাবা কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে ছুটে আসেন। কিন্তু এহেন চাঞ্চল্যকর ঘটনায় বাপের বাড়ির তরফে থানায় খুনের চেষ্টার অভিযোগের বদলে পুলিশের কাছে মেয়ের মানসিক অসুস্থতার কথা জানানো হয়। শ্বশুরবাড়ির তরফেও পুলিশকে জানানো হয় যে সঙ্গীতা আগে চারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। একবার খড়দহ রেল স্টেশনে একই কায়দায় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। সেসময় উপস্থিত লোকজন তাঁকে বাঁচান। তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে এমনই জানান শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা।
এর পর শনিবার সঙ্গীতার শারীরিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হওয়ায় তাঁর বয়ান নেয় পুলিশ। তাতেই সন্দেহ আরও উসকে ওঠে। বেলঘরিয়ায় তিনি বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলেন বলে জানালেও সেই বন্ধুর নাম, ঠিকানা বলতে পারেনি। পাশাপাশি বন্ধুর বাড়িতে ‘নাইটি’ পরে যাওয়া নিয়েও তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন ছিল। এছাড়া তাঁর আরও নানা বক্তব্যে অসংগতি পান তদন্তকারীরা। আর এর পরেই পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত হয় যে হত্যার চেষ্টা নয়, গায়ে আগুন নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা হয়েছিল।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে বারাকপুর কমিশনারেটের ডিসি (সাউথ) অনুপম সিং বলেন, “জখম মহিলার বয়ান যাচাই করলে অসঙ্গতি পাওয়া গিয়েছিল। জখম মহিলার মা-বাবার বক্তব্য অনুসারে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, চিকিৎসা চলছে। বিয়ের পরেও উনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলেও জানা গিয়েছে। তাই মানসিক সমস্যা থেকে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা বলেই প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে। গুরুত্ব সহকারে তদন্ত চলছে। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি ঘটনাস্থল সংলগ্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তবে মানসিক সমস্যা থেকে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের স্বামীর উপর দোষ চাপানোর মত এই ঘটনায় হতবাক সকলে। এনিয়ে মনোবিদ ডাঃ তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত বলেন, “এই ধরনের মানসিক সমস্যায় অবাস্তব, অলীক কল্পনা আসতেই পারে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা কাছের মানুষকে শত্রু বলে মনে করে। অডিটরি হ্যালুসিনেশনে রোগী যেন শুনতে পান, সেই শত্রু তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এমনও শুনতে পারেন, কাছের কেউ বলছে, এত যন্ত্রণা সহ্য করার থেকে মরে শত্রুর নামে দোষ দেওয়া ভালো। তবে, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, চিকিৎসার মধ্যে থাকলে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে ওঁর বর্তমান মানসিক অবস্থা কী ছিল, সেটা চিকিৎসকই বলতে পারবেন। তবে অবশ্যই মানসিক রোগ নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.