সাবির জানান, মুর্শিদাবাদ: শহর থেকে গ্রাম। মোটরবাইক নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকার দিন শেষ। একটু অসতর্ক থাকলেই বাইক উধাও। এই চক্রের পিছনে কারা রয়েছে? কীভাবে চুরি হয়? তার খোঁজে সংবাদ প্রতিদিন-এর অন্তর্তদন্ত। আজ মুর্শিদাবাদ জেলার বাইক চুরি নিয়ে প্রতিবেদন। তবে অন্যান্য জেলাতেও খানিকটা একই কায়দায় চুরি হয়।
দৃশ্য ১ : বহরমপুর ফৌজদারি কোর্টের সামনে ভদ্রলোক তাঁর সাধের বাইকটি রেখে অফিসের কাজে ভেতরে গেলেন৷ কোর্টের বাইরে মানুষের কোলাহল। সার সার দিয়ে রাখা লাল, নীল, কালো বাইক৷ সুটেড-বুটেড একজন লোক এসে একটি বাইকে বসলেন। দিব্যি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন। পথচলতি মানুষ কে আর কার খোঁজ রাখেন? কাজ থেকে ফিরে বাইক মালিক দেখেন সব বাইক আছে, শুধু তাঁর দু-চাকা হাওয়া৷ কপাল চাপড়েও আর কোনও উপায় নেই। অগত্যা পুলিশের কাছে খবর দেওয়া।
[ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের নাম করে ফোন, প্রতারকদের থেকে সাবধান]
দৃশ্য ২: চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে খোশ মেজাজে আড্ডা দিচ্ছিলেন এক যুবক। কাছেই ছিল তাঁর মোটরবাইক। মালিক দেখলেন তার চোখের সামনেই বাইকের ক্লাচ ঘুরিয়ে অপরিচিত একজন তাঁর গাড়িটি কার্যত উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল৷ পিছু ধাওয়া করেও লাভ হল না৷ সেই আবার পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের৷
দৃশ্য ৩: বাড়ির পাশে বাইক স্ট্যান্ড করে রেখে দুপুরে একটু ঘুমিয়েছেন। বেশ অাঁটসাঁট জায়গায় বাইক রেখে নিশ্চিন্ত অবসর যাপন৷ বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখলেন বাইক নেই। উধাও। চুরির অভিযোগ দায়ের করতে হাঁটতে হাঁটতে থানায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই৷ হাতে রইল চাবি কিন্তু উধাও বাইক৷ হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকে না আর৷
[লণ্ঠন অন্ধকার, অসাধু চক্রের ‘হাতযশে’ কেরোসিনে চলছে বাস]
মোটের উপর মুর্শিদাবাদ জেলাতে এই তিন রকমভাবে বাইক চুরি হয় বলে পুলিশের খাতায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে৷ জেলার সীমান্তবর্তী সামশেরগঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা, রানিতলা, ডোমকল, জলঙ্গি ছাড়াও বেলডাঙা এবং বহরমপুর থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাইক চুরি হয়৷ হিসেব বলছে, জেলায় প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে বাইক চুরি যাচ্ছে। তবে এই চুরির উপদ্রব সিজনের উপর নির্ভর করে৷ গরমকালে বেশি৷ শীতকালে কম৷ চাহিদা অনুযায়ী এর তারতম্য হয়৷ আবার পুলিশি তৎপরতা বাড়লে বেশ কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকে বাইক চোরেরা৷ তবে, পুলিশ স্বীকার করেছে, বাইক চুরি একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি৷
বাইকের চাহিদার বিষয়টি কেমন তা জানতে চাওয়া হলে জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, চুরির বাইক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায়৷ কখনও কখনও চলে যায় ঝাড়খণ্ডেও৷ আবার জেলার বাইরে ঘুরে বেড়ায় চুরির বাইকগুলিও৷ বাইক একবার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশে চলে গেলে পুলিশের কিছু করার থাকে না৷ ভিন রাজ্য ঝাড়খণ্ড থেকেও বাইক উদ্ধার করা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ বলে পুলিশই জানিয়েছে৷
[সরকার পাঠাচ্ছে খাদ্যসামগ্রী, কোন চক্র উধাও করছে রেশনের চাল-গম?]
বাংলাদেশে নৌকার ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয় তা এই চুরি হওয়া বাইকের ইঞ্জিন থেকেই নেওয়া হয় বলেই জানা গিয়েছে৷ এক্ষেত্রে হিরো এবং পালসার বাইকের ইঞ্জিনের চাহিদাই বেশি৷ স্বাভাবিকভাবে সীমান্ত লাগোয়া এই জেলায় যে বাইকগুলি চুরি গিয়েছে, তারমধ্যে এই দুই কোম্পানির বাইকের সংখ্যাই বেশি৷ ইদানীংকালে যন্ত্রচালিত ভ্যান রিকশা চালু হওয়ার পর বাইক চুরির হিড়িক বেড়েছে৷ আবার অবৈধভাবে গাড়ির কাগজ তৈরি করে চোরাই গাড়িগুলি কম দামে কেনার প্রবণতা একশ্রেণির মানুষের মধ্যে রয়েছে৷ মুর্শিদাবাদে অবৈধ গাড়ির কাগজ তৈরি করা বেশ কয়েকটি চক্র পুলিশ ইতিমধ্যেই পাকড়াও করেছে৷
তদন্তকারীদের ব্যাখ্যা গাড়ি পাচার হয় আবার দু’রকমভাবে৷
এক) চোর বাইক চালিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছে যায় সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই৷
দুই) চুরি হওয়া বাইক খুলে খণ্ড খণ্ড করা হয়৷ এবং তারপর বস্তাবন্দি করে তা পাচার করা হয়৷ দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করা হয় মূলত বাংলাদেশে বাইক পাচারের ক্ষেত্রে৷ বাইক বস্তাবন্দি করতে ব্যবহার করা হয় সীমান্তের বেশকিছু পরিত্যক্ত গোডাউন৷ কয়েকটি গোডাউন পুলিশ খুঁজেও পেয়েছে৷
যত রহস্য ‘মাস্টার কি’
কিন্তু একটি মূল্যবান বাইকের লক খুলে কীভাবে এত সহজে বাইক চুরি করা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তরে এক থানার ওসি বলেন, বাইক চোরদের কাছে একটি ‘মাস্টার কি’ থাকে৷ তা দিয়ে খুব সহজে যে কোনও বাইকের তালা খুলতে পারে তারা৷ ওই ‘মাস্টার কি’-টি ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো দেখতে৷ এবং বেশ শক্ত ৷ সেটি বাইকের লকে ঢুকিয়ে মোচড় দিতে হয় ৷
[পাচারের ছক বদল, অনলাইনে বিক্রি হাতির দাঁত-সাপের বিষ]
পুলিশের দাওয়াই
বাইক চুরি আটকাতে পুলিশের বক্তব্য বাইক মালিকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে৷ অন্যদিকে শুধুমাত্র লকের উপর নির্ভর না করে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হবে৷ পুলিশের পক্ষ থেকে বাইক চোরদের ধরতে ইতিমধ্যেই বহরমপুর শহরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে৷ তারপর অবশ্য এই চুরি অনেকটাই কমেছে৷ এ ব্যাপারে জেলার পুলিশ সুপার শ্রী মুকেশ বলেন, বাইক চুরি আটকাতে পুলিশ সারা বছর ধরে কাজ করে৷ প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন থানায় চুরি যাওয়া বাইক উারও হয়েছে৷ এমনকী ভিন রাজ্য থেকেও বাইক উারের নজির পুলিশের রয়েছে।
[সিরাপের হাত ধরে নেশা, কোড নেমেই সক্রিয় চক্র]
বাইক চুরির রমরমা
সামশেরগঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা, রানিতলা, ডোমকল, জলঙ্গি ছাড়াও বেলডাঙা এবং বহরমপুর থানা এলাকা।
কোথায় যাচ্ছে চুরির বাইক?
সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাচার৷ কখনও কখনও চলে যায় ঝাড়খণ্ডে৷ জেলার বাইরে পাচার হয় চুরির বাইকগুলিও৷
চুরির পদ্ধতি
বাইক চোর ‘মাস্টার কি’ ব্যবহার করে বাইক চুরি হয়। সেই বাইক চলে যায় সীমান্তবর্তী গোডাউনে। সেখানে পার্টস আলাদা হয়ে যায়
বস্তাবন্দি হয়ে পার্টস চলে যায় বাংলাদেশে।
কেন পার্টস গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশে নৌকার ইঞ্জিনে বাইকের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। যন্ত্রচালিত ভ্যানেও চুরি করা বাইকের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.