নিজস্ব সংবাদদাতা, হুগলি: বালির গৃহবধূ পারমিতা বক্সির মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে আলিপুর থেকে স্বামী কৌস্তভ বক্সিকে গ্রেপ্তার করল উত্তরপাড়া থানার পুলিশ। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ও বধূ নির্যাতনের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ২৭ অক্টোবর উত্তরপাড়ার মাখলায় বাপের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন পারমিতা। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ সেই খবর প্রকাশিত হতেই চারদিকে আলোড়ন পড়ে যায়। পারমিতার স্কুল-কলেজের বন্ধুরা একজোট হয়ে এই জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদ জানান। অবশেষে মূল অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হওয়ায় পারমিতার আত্মার শান্তি পাবে বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাঁর সহপাঠীরা।
পারমিতা মহারাষ্ট্রের পুণেতে একটি কোম্পানির অ্যাডমিনের কাজ করতেন। ২৪ নভেম্বর ২০১৬ বালির বাসিন্দা কৌস্তভ বক্সির সঙ্গে পারমিতার বিয়ে হয়। এরপরই কৌস্তভ স্ত্রীকে পুণে নিয়ে গিয়ে নিজের পরিচিত একটি কোম্পানিতে অ্যাডমিনের কাজে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে বেঙ্গালুরুতে ফিরে যায়। পারমিতার চাকরি একদমই পছন্দের ছিল না। স্বামীর সঙ্গে সংসার করাই তাঁর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু চাকরি ছাড়লে তাকে ডিভোর্স দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে কৌস্তভ, শ্বশুর কৃষ্ণেন্দু, শাশুড়ি ছন্দা ও ননদ কমলিকা বক্সি শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার শুরু করেন। পারমিতাকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন অর্থ উপার্জনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। পারমিতা এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পুণের চাকরি ছেড়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তরপাড়ার মাখলায় বাপের বাড়ি চলে আসে। এরপর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পারমিতা অক্টোবরের ২৭ তারিখ বাপের বাড়িতে গলায় দড়ি গিয়ে আত্মহত্যা করে।
পারমিতা মৃত্যুর জন্য স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনেকে দায়ী করে ডায়েরীতে লিখে রেখে যায়। বাপের বাড়ি থেকে স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে উত্তরপাড়া থানায় বধূ নির্যাতন ও আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করার পরই শ্বশুরবাড়ির লোকজন বালি ছেড়ে পালিয়ে যান। গৃহবধূর স্বামী কৌস্তভ দীর্ঘদিন ধরে আলিপুরে বোনের হবু শ্বশুরবাড়িতে লুকিয়ে ছিল। মঙ্গলবার রাতে বোনের হবু শ্বশুরের সঙ্গে আলিপুরের বাড়ি থেকে কৌস্তভ ব্যক্তিগত কাজে বাইরে বেরোয়। উত্তরপাড়া থানার পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আলিপুর থেকে কৌস্তভকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। বুধবার ধৃতকে শ্রীরামপুর মহকুমা আদালতে তোলা হয়।
পারমিতা। যাঁর নামের মানে হল পূণর্তা, তাঁর সবকিছু ঘিরে শুধুই শূন্যতা। কন্যা। আত্মমুখী জীবনযাপন। বিয়ের পর চাওয়া বলতে স্বামী, সন্তান-সহ সুখী গৃহকোণ। কিন্তু তাঁর স্বামীর উচ্চবিত্ত জীবনচর্যা ঘিরে ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা তাঁকে এনে ফেলেছিল কর্পোরেট কর্ম-বৃত্তে। সন্তানহীন, প্রেমহীন যে আবহে বড়ই অক্সিজেনের অভাব বোধ হচ্ছিল পারমিতার। চাকরি ছাড়তে চেয়ে, পুণে থেকে বেঙ্গালুরুতে তাঁর ভালবাসার মানুষটির কাছে ফিরতে চেয়ে মার খেতে হয়েছে। এমনকী জেল খাটতে হয়েছে স্বামীর অভিযোগের ভিত্তিতে। শেষ পর্যন্ত উত্তরপাড়ায় সেই যে রেখে গিয়েছিল স্বামী, আর নিয়ে যায়নি। উলটে ডিভোর্সের নোটিস পাঠিয়ে দিয়েছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ভেঙে যাওয়া মন। অপমানের বোঝা হালকা হওয়ার পথ না পেয়ে জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে ইতি টানেন হুগলির উত্তরপাড়ার মাখলার ৩০ বছরের পারমিতা। যিনি বড় হয়েছেন পালক বাবা-মার কাছে। যাঁরা শিখিয়েছিলেন, মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র। সেই মন্ত্র জপে ‘বাবা’ কালীপদ দাস অভিযোগ করেন জামাই কৌস্তুভ বক্সি, শ্বশুর কৃষ্ণেন্দু, শাশুড়ি ছন্দা ও ননদ কমলিকার বিরুদ্ধে।
পারমিতার সুইসাইডাল নোটে লেখা, “তোমার জন্যই আমার এই চরম পরিণতি। তোমার হয়তো কোনও শাস্তি হবে না। কিন্তু মনের অনুতাপে তুমি শেষ হবে। ভাল থেকো।” তাঁর ডায়েরি বলছে আরও অনেক কিছু। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, কীভাবে পুণেতে তাঁকে জোর করে পরিচিত একটি অফিসে কাজে ঢুকিয়ে কৌস্তুভ বেঙ্গালুরুতে কাজ নিয়ে চলে যান, প্রতিবাদ করায় সহকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়, মিথ্যা অভিযোগে জেল যেতে হয়, সবই লেখা রয়েছে। গতবছর ২৪ নভেম্বর রেজিস্ট্রি বিয়ের পর পারমিতাকে নিয়ে কৌস্তুভ পুণে চলে যায়। সেখানে পারমিতা চাকরি করতে না চাওয়ায় বারবার মারধর করা হয়। শেষ পর্যন্ত চাকরি করলে মাইনের সব টাকা বালিতে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে হত পারমিতাকে। এ নিয়ে ঝামেলা চলাকালীন কৌস্তুভ পুণেতে আসে ও স্ত্রীকে মারধর করে। অর্থ নয়, চাকরি নয়, সুখী গৃহকোণ তাঁর কাছে মুক্ত আকাশ, সে কথা বললেই ডিভোর্সের হুমকি দেওয়া হত। শেষ পর্যন্ত শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে পারমিতা। ঠিক করে চাকরি ছেড়ে দেবে। তাঁর মা বনানী দেবীর আরও অভিযোগ, এক সময় কৌস্তুভ পুণেতে এসে অফিসের লোকজনকে নিয়ে মারধর করে থানায় পারমিতার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযাগ করে। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এতে পুরোপুরি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পারমিতা চাকরি ছেড়ে দেয়। কৌস্তুভ পারমিতাকে পুণে থেকে নিয়ে এসে ১৫ অক্টোবর এখানে রেখে যায়। বলে যায়, ৩ মাস বাদে এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু কথা রাখেনি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.