রিন্টু ব্রহ্ম, কালনা: মানসিক রোগে আক্রান্ত মহিলার ‘ভূত’ রোগ ছাড়াতে ফের ওঝা। কালনায় চলে আসা ভূতের ভয়ের ‘ট্রেন্ড’ এখনও রমরমা। পাড়ার শিক্ষিত লোকের মাঝেই তিনদিন ধরে চলল কুসংস্কারের তাণ্ডব। প্রকাশ্য দিবালোকে ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তেলপোড়া, জলপোড়া খাওয়ানোর সঙ্গে গৃহবধূকে জুতো চিবানো-সহ চলল নানা অমানবিক কর্মকাণ্ড। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির যুগে স্মার্টফোন হাতে নিয়ে সমস্ত ঘটনা দেখেও এগিয়ে এল না কেউই। স্থানীয়দের অন্ধবিশ্বাস, এক বছর আগে মৃত স্থানীয় দুই যুবকের প্রেতাত্মাই ভর করেছিল ওই গৃহবধূর উপর। যার কারণেই নাকি ঘনঘন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছিল তাঁর । যেই ঘটনা নিয়েই ফের আতঙ্ক ছড়িয়েছে কালনার পূর্ব সাতগাছিয়ার মাঝের পাড়াতে। এর আগে হাট কালনার গ্রামকালনায় ভূতের ভয়, শহরে ডাঙাপাড়ায় নিশির ডাক ও সাপের কামড়ের ওঝার তাণ্ডবের মতো নানা কুসংস্কারের ঘটনা মানুষের মনে ভিতির সঞ্চার করেছিল। যা নিয়েই ইতিমধ্যেই কুসংস্কারের ভূত তাড়াতে মাঠে নেমেছে কালনা প্রশাসন।
[ইতিউতি রক্তের ছোপ, ‘অশরীরী’র আতঙ্কে সিটিয়ে সিউড়ির গ্রাম]
ঘটনার সূত্রপাত দিন পনেরো আগে। পূর্ব সাতগাছিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা গৃহবধূ পল্লবী হালদার সন্ধ্যায় গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময়ই একটি অন্ধকার রাস্তার পাশে একটি ঝোপ দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি। যার পরেই তিনি বাড়ি এসে বলতে থাকেন, বছর খানেক আগে মৃত দুই যুবক প্রকাশ বিশ্বাস ও মঙ্গল বিশ্বাসের ছায়া দেখেছে তিনি। যার ভয়েই ক্রমে অসুস্থ হতে থাকেন ওই গৃহবধূ। ওই গৃহবধূ বলেন, “সেই প্রেতাত্মার ছায়া দেখেই ভয় পেয়েছি”। কিছু দিনের মধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে ওই গৃহবধূর । তাঁর স্বামী কালু হালদার জানান, কয়েক দিন ধরেই ঘনঘন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন ওই তাঁর বউ । ডাক্তার দেখিয়েও কোনও কাজ হচ্ছিল না। তাঁরা কালনার একটি চিকিৎসকের কাছেও কয়েক বার গিয়েছিলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ শরীর সুস্থ না হওয়ায় তাঁরা ওঝার কাছে শরণাপন্ন হন। ওই পরিবারের কর্তা তথা গৃহবধূর শ্বশুর গোবিন্দ হালদার বলেন, “আমার গৃহবধুকে ডাক্তার দেখিয়েও সুস্থ করতে পারিনি। ওকে ভূতে ধরেছিল। তাই আমরা স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ওঝা ডাকি। স্থানীয় কয়েক জন ওঝা এসে গত বৃহস্পতিবার থেকে ঝাড়ফুঁক শুরু করে। যা তিনদিন ধরে চলে”।
[পরপর কন্যাসন্তান, মায়ের কোল থেকে দুধের শিশুকে আছড়ে মারল বাবা]
প্রতিবেশী গৃহবধূ রুমা বারুই জানান, এই বাড়ির বারান্দাতেই চলে ঝাড়ফুঁক। শৈলেন মণ্ডল নামে এক ওঝা সেই ঝাড়ফুঁক করেন। তেল পোড়া, জল পোড়া, মন্ত্রপাঠ-সহ নানা ঘটনা চলতে থাকে। ভূত তাড়াতে ওঝা গৃহবধূকে ঝাড়ফুঁক করতে করতে বলেন মুখে করে জুতো নিয়ে কয়েকশো মিটার দূরে রেল লাইনের ধারে ফেলে দিয়ে আসতে। সেই কথা মতো ওই গৃহবধূ পরপর দুদিন সেই জুতো মুখে নিয়ে ওঝার আদেশ পালন করেন স্থানীয়দের দাবি, ওঝার এই কেরামতির ফলেই নাকি ওই মহিলার ভূত তাড়ানো গিয়েছে। শারীরিক ভাবেই সুস্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে ওঝা শৈলেন হালদার দাবি করেন, “ওই মহিলার শরীরে ওই মৃত যুবক বসবাস করছিল। আমি গিয়েই সেই ভূত বের করেছি। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আগামী দিনে তাঁর আর কোনও অসুবিধা হবে না”। এই ঘটনা নিয়েই সরব হয়েছে কালনার শিক্ষিত মানুষজন। কালনা হাসপাতালের সুপার কৃষ্ণচন্দ্র বড়াই বলেন, “ওই গৃহবধূ মানসিক রোগী। তাঁকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। তাঁর সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন। ভূত বলে কিছু হয় না। সকলকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর ভরসা রাখতে হবে”। কালনা বিজ্ঞান মঞ্চের অন্যতম সদস্য শিক্ষক তাপস কার্ফা বলেন, “এটি একটি মানসিক রোগ। এই ঘটনায় গোটা পাড়াই এই রোগে আক্রান্ত। অশিক্ষা থেকেই এই অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার আসে। তাই অশিক্ষা দূর করে প্রচার চালাতে হবে”। ঘটনার কথা জানতে পেরে কালনা মহকুমা শাসক নীতেশ ঢালি বলেন, “আমরা আগেও প্রচার করেছি। এই বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি। ওই এলাকাতেও আরও কুসংস্কার বিরোধী প্রচার চালানো হবে”। কালনা-২ ব্লকের বিডিও মিলন দেবগরিয়া বলেন, “আমরা প্রশাসনের তরফে ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে ওই এলাকায় গিয়ে প্রচার চালানো হবে”।