মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ সস্ত্রীক দিলীপ ঘোষের
চারধাম, চারধাম-ই। কিন্তু তাই বলে সব ঈশ্বরের গৃহ-ই ধাম। মন্দির। কোথাও কিছু ভুল হয়নি। পুরী পুরীর মহিমা নিয়েই থাকবে। বাংলার মানুষের বাড়তি প্রাপ্তি দিঘার রথ দেখা আর কলা বেচা। মন্দিরকে মেনে দিলীপবাবুর লাইনে না এলে কী হবে বিজেপির? অন্তর্যামী হয়ে হাসছেন মমতা। বিজেপির প্ল্যান ভেস্তে দিতেই তাঁর ছিল মন্দির-কৌশল। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
গত বছর ঠিক এই সময় লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর প্রকাশ্যে এসে নরেন্দ্র মোদি ‘জয় শ্রীরাম’ নয়, বলেছিলেন ‘জয় জগন্নাথ’। কারণ, রাম মন্দির নির্মাণের পরও উত্তরপ্রদেশে বিপর্যয়ে দিল্লির টলমল গদি পোক্ত করে দিয়েছিল, শ্রীজগন্নাথের অাপনভূম ওড়িশা। ওই রাজ্য থেকে বিজেপি যদি ২০টি লোকসভা আসন না জিততে পারত তাহলে মোদির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়তো সম্ভব হত না। স্বাভাবিকভাবেই সেদিন তঁার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল স্বস্তির স্বর, ‘জয় জগন্নাথ’।
মজার কথা হল, বছর ঘুরতেই সেই জগন্নাথই যত অস্বস্তির কারণ বঙ্গ বিজেপির। দিঘায় অপূর্ব শৈলীর জগন্নাথ মন্দির গড়ে মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের কতটা পুণ্যলাভ হল তা জানার অাগেই দেখা গেল, বিজেপির ঘরে অাগুন লাগিয়ে দিয়েছে সমুদ্রপাড়ে আরও এক ‘দারুব্রহ্ম’-র প্রাণপ্রতিষ্ঠা। মন্দিরই বিজেপির রাজনীতি। হিন্দুত্ব তাদের সম্বল। শুধুমাত্র রাম মন্দির আন্দোলন বিজেপিকে দেশে ২ থেকে ৩০০ পার করেছে। আজ সেই মন্দিরই বাংলায় যত সমস্যার কারণ। স্বয়ং জগন্নাথের মন্দিরকে ‘মন্দির’ বলে মানতে নারাজ রাজ্য বিজেপি নেতাদের একটি অংশ। স্রেফ মমতার বিরোধিতা করার জন্য মন্দিরের বিরুদ্ধে সরব তারা।
হিন্দুত্ব সম্বল একটি দলের অঞ্চলিক শাখার এই ভুল রাজনীতি বুমেরাং হবে কি না তা সময় বলবে। আদতে নিজেদের অদূরদর্শিতায় দিঘার মন্দিরের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিলেন সুকান্ত মজুমদাররা। মানুষ আরও বেশি করে উৎসাহী হয়ে উঠেছে দিঘার প্রতি। ঢল নামছে প্রতিদিন। যদি মন্দিরকে স্বাগত জানানো হত, তা হলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত! বাংলার হিন্দুরা জগন্নাথের নামে কতটা বিভোর তঁারা কি জানেন না? সামশেরগঞ্জে ভাঙা মন্দির গড়ার কথা বলব, আবার দিঘার মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার ওড়িয়া মন্ত্রীর হুমকিতে হাততালি দেব– এ কেমন হিন্দুত্ব!
আসলে বৈভব সূর্যবংশীর মতো বিধ্বংসী হয়ে সব এলোমেলো করেছেন প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। মমতার উদ্বোধন করা মন্দিরে সস্ত্রীক হাজির হয়ে চমকে দিয়েছেন। মন্দির নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করতেই বিজেপিতে সমুদ্রমন্থন। সেই মন্থনে গেরুয়া অভ্যন্তর থেকে যে নর্দমার পঁাক উঠতে শুরু করেছে, তা অারও কত দুর্গন্ধ ছড়াবে কেউ জানে না।
তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, মূলত মমতার দল থেকে অাসা নেতাদের চাপেই দিলীপবাবু দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। প্রাক্তন তৃণমূলীরাই দিলীপবাবুর উপর খড়গহস্ত। যে ভাষায় তঁাকে অাক্রমণ করা হল, তাতে রাজনৈতিক মহল অবাক। রাজ্যে বিজেপির সর্বাধিক সাফল্যের কারিগর যিনি, যিনি প্রথম রামনবমীর মিছিলে মহরমের টাচ এনেছিলেন, যিনি প্রথম গদা হাতে হনুমান জয়ন্তী পালন করে হিন্দুত্বের জিগির তুলে দু’টি লোকসভা আসনকে ১৮তে নিয়ে গিয়েছিলেন, তঁাকে বিজেপি ‘শেখাচ্ছেন’ তৃণমূল থেকে অাসা নেতারা!
দিলীপ ঘোষ মেঠো লোক। মুখে সোনার চামচ নেই। ন্যাকা ন্যাকা জবাব তিনি কোনওদিনই দেন না। কুকথা বললেও অনুতপ্ত হন না। স্বভাবতই তঁার প্রত্যাঘাত তীব্র বিতর্কিত শব্দময়।
বোঝা গেল অনেক দিন ধরে তিনি আহত। দঁাতে দঁাত চেপে সময়ের অপেক্ষা করছিলেন। সুযোগ এসে যেতেই নখ-দঁাত বের করলেন। তিনি যেন ব্রেক ফেল করা ফেরারি গাড়ি। দুরন্ত গতিতে ছুটছেন। চরম কিছু হওয়ার অাগে ক্রমশ স্পিড বাড়ছে। এই সময় তঁাকে রোখা না হলে কত ধ্বংসলীলা চলবে কেউ জানে না। প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ঝুলি থেকে এক এক করে বেড়াল বের করছেন। তাতে বেঅাব্রু হয়ে পড়ছে নেতাদের ঘর-সংসার। অালোর পিছনে অন্ধকার। নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট হলে সবার ভাবমূর্তি নষ্ট করার হুমকি।
এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দিল্লির নেতৃত্ব দিলীপবাবুকে নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা স্পষ্ট করে বোঝা না গেলেও অারএসএস শিবিরের প্রায় সব নেতাই কিন্তু অদ্ভুত রকম চুপ। যঁারা দিলীপবাবুর বিয়েতে গিয়েছিলেন, তঁাদের কেউ-ই একটিও কথা বলেননি। কেউ দিলীপবাবুকে চুপ করতে বলেছেন বলেও মনে হচ্ছে না। তঁারা কি মজা দেখছেন?
স্বাভাবিকভাবেই এই পরিসরে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে দিলীপবাবু নাকি তৃণমূলে যেতে পারেন। জল্পনা স্বাভাবিক। অাপাতত সেই দাবি দিলীপবাবু উড়িয়ে দিলেও রাজনীতিতে সব সম্ভব। একটা ছাতা ছাড়লে আর একটা অাশ্রয় তো চাই। কিন্তু মনে হয়, এত দ্রুত এই নাটকের যবনিকা পতন হবে না। দিলীপবাবুকে থামানোর চেষ্টা হবে। কারণ, তিনি দলে থাকলে বিজেপির কতটা লাভ হবে জানি না, কিন্তু তঁাকে বাইরে রাখা বিজেপির পক্ষে সুখকর নাও হতে পারে।
২০২৬-এ লক্ষ্য বিজেপির। ২০২৬-এ বিজেপির লক্ষ্য বাংলা দখল। দিল্লি এসে গিয়েছে। কিন্তু বাংলা হাতে নেই। এই নিয়ে দুঃখের শেষ নেই কেন্দ্রীয় নেতাদের। শ্যামাপ্রসাদের মাটি দখলে অাসল বাধা মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়। তঁাকে কিছুতেই হারানো যাচ্ছে না। পর পর ভোটে মমতার সামাজিক কর্মকাণ্ডে ভূপতিত হওয়ার পর স্ট্র্যাটেজি বদল। দু’টি পথ নেওয়া হয়েছে, এক, ক্রমাগত ‘মিম’ তৈরি করে মমতার ইমেজ অাঘাত করা। তঁাকে হিন্দু-বিরোধী প্রতিপন্ন করা। দুই, মূলত হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে প্রবল মেরুকরণের উদে্যাগ। সেই লক্ষে্য যেভাবে গত কয়েক মাস ধরে ‘হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই’ প্রচার চলছিল তা কখনও দেখা যায়নি। ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতির বাংলায় সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছিল। ধুলিয়ানের দাঙ্গা ও পহেলগঁাওয়ে হিন্দু নিধনের পর বিজেপি অাদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। বাংলাদেশ কাণ্ডও হাতিয়ার।
বাকি রইল মমতার ইমেজ। হিন্দু ভাবাবেগ উসকে দিতে তঁাকে ‘মুসলমানপন্থী’ বলে প্রচার করা হচ্ছে সুকৌশলে। শাণ্ডিল্য গোত্রের বন্দে্যাপাধ্যায় পদবির ব্রাহ্মণকন্যাকে বাংলার বাইরে ‘মুসলমান’ বলেই প্রচার করা হচ্ছে বহু দিন ধরেই। গোয়া, গুজরাত, ভোপাল, কানপুর ইত্যাদি নানা জায়গায় গিয়ে অামি নিজের কানে শুনেছি। এই বাংলায়ও এমন প্রচার শুরু হয় যে, মমতা হিন্দুবিরোধী। তিনি মুসলমানদের তোষণ করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ইফতারে যাওয়ার ছবি, রেড রোডে নমাজে যাওয়ার ছবি দিয়ে মিম করা হয়। এমনকী, জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের দিন তীব্র রোদের হাত থেকে বঁাচতে তিনি যে সাদা কাপড়টি দিয়ে মাথা ঢেকেছিলেন তা নিয়েও বলা হয়, ওটা নাকি ‘হিজাব’! কী সাংঘাতিক মিথ্যা প্রচার! হাজার হাজার মানুষ সেদিন একই কাপড় মাথায় দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে কুড়ি-বাইশ হাজার গামছা কাপড় অানিয়েছিলেন রোদের হাত থেকে অতিথিদের বঁাচাতে।
ঠিক এমন সময় বিয়ে করে বসলেন দিলীপ ঘোষ। বিজেপির অন্দরে তীব্র অভিঘাত শুরু হয়। খেই হারিয়ে যায় মেরুকরণের প্রচারে। মিডিয়া ঝঁাপিয়ে পড়ে দিলীপ-রিঙ্কুর। বিয়েপর্ব মিটতে না মিটতেই মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সোজা দিঘা চলে যাওয়া। সঙ্গে স্ত্রী রিঙ্কু। মিডিয়ার তীব্র অালো গিয়ে পড়ে। অার চুপ থাকতে পারেননি বিজেপিতে তৃণমূলছুট নেতারা। শুরু হয় দিলীপবাবুকে অাক্রমণ। সঙ্গে সঙ্গে সোজা ব্যাটে জবাব। এর জেরে জল কোন দিকে গড়ায় তা দেখার।
কিন্তু মন্দির রাজনীতিতে ভুল পদক্ষেপ বিজেপির। যত তঁারা বলছেন এটা মন্দির নয়, তত ভিড় বাড়ছে দিঘায়। যত তঁারা জগন্নাথকে নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, তত হিন্দুত্বের প্রচার ধাক্কা খাচ্ছে। জগন্নাথের মূর্তি পুরীর নবকলেবরের নিমকাঠের কি না তা নিয়ে বিতর্ক করে মুখ পুড়েছে। ওড়িশার এক বিজেপি নেতা হুমকি দিয়েছেন, দিঘার মন্দির নাকি গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। হাস্যকর অাস্ফালন। এসবে মন্দিরের মাহাত্ম্য আরও বাড়বে। দিঘায় অাগামী রথে নয়নপথগামীর যাত্রা দেখতে ভিড় চওড়া হবে।
অার ধাম? ভুল ব্যাখ্যা। চারধাম, চারধাম-ই। কিন্তু তাই বলে সব ঈশ্বরের গৃহ-ই ধাম। মন্দির। কোথাও কিছু ভুল হয়নি। পুরী পুরীর মহিমা নিয়েই থাকবে। বাংলার মানুষের বাড়তি প্রাপ্তি দিঘার রথ দেখা অার কলা বেচা। মন্দিরকে মেনে দিলীপবাবুর লাইনে না এলে কী হবে বিজেপির? অন্তর্যামী হয়ে হাসছেন মমতা। বিজেপির প্ল্যান ভেস্তে দিতেই তঁার ছিল মন্দির-কৌশল। সেটা যে গেরুয়া শিবিরকে দ্বিখণ্ডিত করে দেবে তিনিও ভাবেননি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.