ছেলেমেয়ের স্কুলের শিক্ষক বাড়ির দরজায়! ভোরে বই-পাঠের সংস্কৃতি ফেরাতেই তাঁদের বিশেষ উদ্যোগ। প্রয়োজনে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি।
এমন একটা সময় ছিল, যখন বাঙালি গেরস্তবাড়ির ছেলেমেয়েরা ভোর হতে-না-হতে আর সন্ধের শঙ্খ বাজতেই পড়তে বসত। তখনও বাঙালির যৌথ পরিবার ভেঙে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে যায়নি। সুতরাং বাড়িতে ছোটদের শাসনে রাখার মতো কাকা-কাকি, জ্যাঠা-জেঠির অভাব ছিল না। সকাল-সন্ধে ছোটদের বইমুখো হতে হতই। এখন তো বেশির ভাগ বাঙালির সংসার বলতে খুপরি খুপরি ফ্ল্যাটবাড়িতে বাবা-মা আর দু’-একটি সন্তান। আর বাবা-মা দু’জনেই যদি রোজগেরে হন, তাহলে সকাল-সন্ধে মোবাইল-মায়ায় ডুবে না থেকে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় মন দেবে, এতটা আশা করা যায় কি?
বরং বলা যায়, ভোরবেলা আর সন্ধেবেলা ছোটদের বইখাতা নিয়ে বসার সংস্কৃতি প্রায় উঠেই গিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির ছেলেমেয়েরা বইপত্র নিয়ে লেখাপড়ায় মন দিচ্ছে– এই দৃশ্য অনেক পুরনো অ্যালবামে হলুদ ছবির মতো বেঁচে আছে আজও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ছড়ায়– ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল… শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।’ যে-ছবি ও মেজাজ ফুটে উঠেছে এই ছড়ায়, সেটা এখনকার স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে একেবারে ভোরবেলার চেনা ছবি আর মেজাজের সঙ্গে মেলে না।
সম্প্রতি, স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভোরের আলো ফুটতেই নিজ-নিজ পাঠে নিবেশের এক নতুন রূপকথা তৈরি হয়েছে। এবং এই অবিশ্বাস্য প্রয়াস আসানসোলের কিছু মঙ্গলকামী শিক্ষক-শিক্ষিকার। সকাল হতেই তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে চলে এসে করা নাড়ছেন। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী দরজা খুলছেন। ছেলেমেয়ের স্কুলের শিক্ষক বাড়ির দরজায়! কী ব্যাপার!
তাঁরা অবাক কিংবা অনিশ্চিত। স্কুল টিচার হেসে বলছেন, ‘মেয়ে উঠেছে, না, এখনও ঘুমচ্ছে?’ মা-বাবা জানাচ্ছেন, ‘এই সবে উঠল। কিছুতেই উঠতে চায় না।’ ততক্ষণে ছাত্রী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক বললেন, ‘সামনেই সিবিএসসি পরীক্ষা। এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে হবে? ভোরবেলায় যতটা পারো সময় দাও লেখাপড়ায়। আর আগামী একমাস মোবাইল ঘঁাটা একদম বন্ধ রাখো। তুমি কিন্তু দু’-একটা বিষয়ে অন্যদের থেকে পিছিয়ে আছ! আমরা স্কুলের ছেলেমেয়েদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছি।
কারা কোন বিষয়ে একটু কাঁচা তাও আমরা খোঁজ রেখেছি। যখন যা হেল্প চাইবে, পাবে। আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে। রেজাল্ট কিন্তু ভাল করতেই হবে। আর তার জন্য দরকার লেখাপড়াকে আরও অনেক বেশি সময় দেওয়া। ভোরে উঠেই মোবাইল নয়। এই কথাটা মনে রেখো। লেখাপড়ার বেস্ট টাইম ভোরে। অতএব, ভরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতেই হবে।’
গত দু’-মাস ধরেই এভাবে বাড়ির দরজায় শিক্ষক-শিক্ষিকার কড়া নাড়া চলছে। ঘুম ভাঙাছেন ছাত্রছাত্রীদের। তাঁদের একটাই অভিপ্রায়: বাংলায় ফিরুক ভোরের আলো ফুটতেই নিজ-নিজ পাঠে মন দেওয়ার যুগ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.