Advertisement
Advertisement
Corona virus

সম্পাদকীয়: আত্মশাসন জারি থাক

পজিটিভিটির হার এক শতাংশের নীচে গেলেও, করোনা চলে গেল, এমনটা ভাবা বড় ভুল হবে।

Np place for complacency in fight against corona pandemic | Sangbad Pratidin

ফাইল ছবি

Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:May 27, 2021 2:42 pm
  • Updated:May 27, 2021 2:42 pm

সুতীর্থ চক্রবর্তী: প্রকৃতিতে আমরা ঠিক একবছর আগের পুনরাবৃত্তি দেখছি। সেই কোভিডের প্রবল সংক্রমণ। তীব্র গরমের একটা স্পেলের পর বঙ্গোপসাগরে ঘনিয়ে ওঠা সেই ঘূর্ণিঝড়। প্রকৃতিতে যে পুনরাবৃত্তি আমরা প্রত‌্যক্ষ করছি, সেই পুনরাবৃত্তি যেন আমাদের আচরণে না ঘটে, তা খেয়াল রাখতে হবে।

[আরও পড়ুন: বাইডেনের আমলে প্রথম আমেরিকা সফরে জয়শংকর, বৈঠক রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিবের সঙ্গেও]

কড়া বিধি-নিষেধের পর গত সাত-আটদিনে কিছুটা থমকে করোনার সংক্রমণ। সংক্রমণের গ্রাফ স্থায়ীভাবেই নামবে কি না, তা বলা যাবে আরও সাত-আটদিন পর। কিন্তু এবার আমাদের গতবারের মতো কোনওভাবেই শৈথিল্য দেখালে চলবে না। পূর্ণ লকডাউন না করেও রাজ্যের মুখ‌্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে কড়া বিধি-নিষেধ বহাল রেখেছেন, তা প্রশংসনীয়। লকডাউনের দমবন্ধ করা পরিবেশ নেই, অথচ আত্মশাসনের জেরে লকডাউনের উপকারিতা পুরোপুরি মিলছে। উপকারিতা যে মিলছে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, গত সাত-আটদিন ধরে রাজ্যের মোট সংক্রমণের গতি কিছুটা কম। পজিটিভিটির রেটও খানিকটা কমেছে। অর্থাৎ, যা টেস্ট হচ্ছে, তার তুলনায় পজিটিভ হওয়ার সংখ‌্যা অল্প অল্প করে নেমে যাওয়া। এই পজিটিভিটির রেট কমতে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

Advertisement

তবে, পজিটিভিটির রেট ১০ শতাংশের নীচে চলে গেলেই আমরা যেন ভাবতে না শুরু করি, কড়া বিধি-নিষেধ শিথিল করা দরকার। গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার অন্তত পজিটিভিটির হার প্রায় শূন্যের কাছে যাওয়া না পর্যন্ত কড়া বিধি-নিষেধ রাখা উচিত। সপ্তাহ তিনেকের লকডাউনের পর রাজধানী দিল্লিতে পজিটিভিটির হার প্রায় এক শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। পজিটিভিটির হার এতটা কমায় সেখানে দাবি উঠেছে, লকডাউন পুরোপুরি তুলে নেওয়ার। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার এখন ধীরে ধীরে আনলক প্রক্রিয়া প্রবর্তনের কথা বলছে। দিল্লি যদি ফের পুরোপুরি আনলক পর্বে চলে যায়, তাহলে ভুল করবে। আমাদেরও এই বিষয়টায় সচেতন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আত্মশাসন গুরুত্বপূর্ণ। কড়া বিধি-নিষেধ চালুর দিনে ‘আত্মশাসন’ শব্দটির অনবদ্য প্রয়োগ করেছেন আমাদের মুখ্যসচিব। পজিটিভিটির হার এক শতাংশের নীচে গেলেও, করোনা (Corona Virus) চলে গেল, এমনটা ভাবা বড় ভুল হবে। যে-ভুলটা গতবার হয়েছিল। সংক্রমণ কিছুটা কমতেই অর্থনীতি বাঁচাতে হইহই করে নেমে যাওয়া হয়েছিল।

Advertisement

রাজ্যের কড়া বিধি-নিষেধে মূল অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখার পুরোপুরি প্রচেষ্টা রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে যাতে বিধি-নিষেধের কোনও প্রভাব না পড়ে, তা রাজ‌্য সরকার সুনিশ্চিত করেছে। কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে সমগ্র গ্রামীণ অর্থনীতি। কড়া বিধি-নিষেধের প্রভাব সেখানেও পড়ছে না। রাজে‌্যর ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ যে এই গ্রামীণ ক্ষেত্রে যুক্ত, তা মাথায় রাখা দরকার। শহরের অর্থনীতির কিছু ক্ষেত্রে কড়া বিধি-নিষেধের প্রভাব নিশ্চিত করেই রয়েছে। কিন্তু সেগুলিকে অগ্রাধিকার দিলে এখন চলবে না। দিনে তিন ঘণ্টা এখন বেচা-কেনা- ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতিতে চলছে। সংক্রমণ কমলে এই সময়টা কিছু বাড়ানোর কথা ভাবা যেতে পারে। এটা দেশজুড়ে হওয়া উচিত। ‘সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ গত মাসে যে-হিসাব দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, নতুন করে সাড়ে ৭৩ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছে। দেশের ৯৮ শতাংশ এলাকাতেই লকডাউন অথবা কড়া বিধি-নিষেধ চলছে। ফলে মে মাসের হিসাবে যে কর্মহীনতা তথা বেকারত্বের হার কিছুটা বাড়বে, তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু তাতে এই মুহূর্তে বিচলিত হয়ে লাভ নেই। গতবার বেকারত্বের এই তথ্যে বিচলিত হয়ে সরকার দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক করায় আমরা কোভিডের এই দ্বিতীয় তরঙ্গের বিপদের মুখে পড়েছি। এটা ভেবে দেখুন, দ্বিতীয় তরঙ্গে দেশজুড়ে আমরা অসংখ‌্য এমন মানুষকে হারিয়েছি, যাদের এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল না। লকডাউন বা কড়া বিধি-নিষেধে এখন যেটুকু বেকারত্ব হবে, তা হয়তো অর্থনীতি স্বাভাবিক হলে দ্রুত পূরণ হবে। কিন্তু যে প্রাণগুলো এই দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাতে চলে যাচ্ছে, তার পূরণ তো কোনওভাবেই সম্ভব নয়। তাই অর্থনীতির অজুহাত দিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ার পুনরাবৃত্তি যেন এবার না ঘটে। আত্মশাসনের মধ্য দিয়ে আমরা যেন বলিষ্ঠভাবে সংকল্প গ্রহণ করি, আগে নির্মূল করতে হবে করোনাকে।

করোনা নির্মূল করতে গেলে পজিটিভিটির হার শূন্যে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সুনিশ্চিত করতে হবে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষের টিকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের ইমিউনিটি থাকলে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙবে। ৫০-৬০ শতাংশ লোকের টিকাদানের কাজ শেষ করা গেলে ৭০ শতাংশ ইমিউনিটির লক্ষে পৌঁছনো সম্ভব, তবে কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গের সম্ভাবনাটি রোখা যাবে। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলি ৫০ শতাংশের বেশি টিকাকরণের কাজ শেষ করার পরই লকডাউন শিথিল করার বিষয়ে বিবেচনা করছে। গত বছর আমরা যখন করোনা চলে গিয়েছে ভেবে লকডাউন শিথিল করছিলাম, তখন কিন্তু প্রথম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পুরোমাত্রায় লকডাউন চালু ছিল। যদিও সেসব দেশের জনসংখ‌্যা আমাদের তুলনায় অনেক কম। জনঘনত্বও আরও কম। স্বাস্থ‌্য পরিকাঠামো অনেক উন্নত।

গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যে কোনও শিক্ষাই নিইনি, তেমন নয়। দ্বিতীয় তরঙ্গ মোকাবিলার কাজ অনেক সহজ হয়েছে সাধারণ মানুষ করোনা মোকাবিলায় মানবিক হাত বাড়িয়ে দেওয়ায়। পাড়ায় পাড়ায় এবার যেভাবে মানুষ সংক্রমিতদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, ততটা গতবার দেখা যায়নি। গতবার সংক্রমিত হয়ে পড়ার ভয় মানুষের অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এবার মানুষ বুঝেছে, পরস্পরের হাত ধরে মানবিক স্পর্শ দিয়ে করোনাকে অনেক সহজে মোকাবিলা করা সম্ভব। গতবারের এই শিক্ষাকে যেমন আমার গ্রহণ করেছি, তেমনই আত্মশাসনের শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে।

গত একবছরে অতিমারী মোকাবিলায় আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে অন্তত স্বাস্থ‌্য পরিকাঠামো যে অনেক উন্নত হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। আজ এই রাজ্যে বহু গ্রামীণ হাসপাতাল বা স্বাস্থ‌্যকেন্দ্রে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর দেখা যাচ্ছে- যা কিছু বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। মাথায় রাখতে হবে, যে-বামেরা আজ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে কেরলের উদাহরণ টানছে, দীর্ঘ ৩৪ বছরের তাদের জমানায় এই রাজ্যের বহু মহকুমা স্তরের হাসপাতালে ইসিজি মেশিন পর্যন্ত ছিল না, আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর তো দূরের কথা। প্রশ্ন তুললে বলা হত, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর দিয়ে কী হবে? মফস্‌সলে মানুষের মৃত্যু হয় আন্ত্রিক ও সাপে কাটায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনস্বাস্থ‌্য পরিকাঠামোয় গুরুত্ব দেওয়ায় এখন রাজ্যের স্বাস্থ‌্য অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভাল ও উন্নত। মফস্‌সলে হাসপাতালে পরিকাঠামো বেড়েছে। বেড়েছে ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা। এটুকু উন্নতি হয়েছিল বলেই আমরা দেশের একাধিক বড় রাজ্যের চেয়ে কোভিড মোকাবিলায় সফল।

কোভিডের এই দ্বিতীয় তরঙ্গের মধ্যে আবার সেই আমফানের মতো দুর্যোগ আসতে দেখে নৈরাশ্যে ডুবে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, প্রকৃতি যতই একবছর আগের রূপ দেখাক, আমরা আমাদের আচরণের ক্ষেত্রে কোনও পুনরাবৃত্তির রাস্তায় হাঁটব না। অর্থনীতি নিয়ে অযথা বিচলিত হয়ে কড়া বিধি-নিষেধ রাতারাতি তুলে নেওয়ার জায়গায় যাব না। আগে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে রাজ্যের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের টিকাকরণ, কোভিডের পজিটিভিটির হারকে শূন্যের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং গ্রামেগঞ্জে স্বাস্থ‌্য পরিকাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। এ রাজ্যের মানুষ তার পাশের বিপন্ন মানুষের প্রতি আজ মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে বড় আশাব‌্যঞ্জক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। ফলে অতিমারীর পরাজয় নিশ্চিত। শুধু প্রয়োজন আজকের এই আত্মশাসন।

[আরও পড়ুন: মেহুল চোকসিকে ফেরত নিতে নারাজ অ্যান্টিগা, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফেরানো হতে পারে ভারতে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ