Advertisement
Advertisement
Electoral Bond

ফিরবে ‘সুটকেস সংস্কৃতি’?

কী এই ‘সু‌টকেস সংস্কৃতি’?

Supreme Court 'banned' electoral bonds, now will 'suitcase culture' will return politics?। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:February 20, 2024 2:18 pm
  • Updated:February 20, 2024 2:18 pm

নির্বাচনী বন্ড বাতিল করল সুপ্রিম কোর্ট। অভিযোগ, গত সাত বছরে এই নির্বাচনী বন্ডের দৌলতে দেশে ‘স‌্যাঙাত তন্ত্র’ তথা শাসক দলের বন্ধু শিল্পগোষ্ঠীকে বরাত পাইয়ে দেওয়া আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এবার কি স্বচ্ছতা আসবে? লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond) সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) ‘নিষিদ্ধ’ করে দেওয়ার পরে কি ফের রাজনীতিতে ‘সু‌টকেস সংস্কৃতি’ ফিরবে? এই প্রশ্ন বিভিন্ন মহল থেকে নিক্ষেপ করা শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে যখন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি নির্বাচনী বন্ডের ধারণাটি বাজারে নিয়ে এলেন, তখন যুক্তি হিসাবে ওই ‘সু‌টকেস সংস্কৃতি’ বন্ধ করার কথাই বলা হয়েছিল। ‘সু‌টকেস সংস্কৃতি’-র সঙ্গে দেশ একসময় বিশেষভাবে পরিচিত ছিল।

Advertisement

লাইসেন্স, পারমিট-রাজ যুগে সরকারি দফতরে ব‌্যবসায়ীদের সু‌টকেস নিয়ে ঢুকতে দেখা যেত। পরে কেন্দ্রের সরকারকে বঁাচাতেও সু‌টকেসের খেলা হয়েছে। নয়ের দশকের গোড়ায় শেয়ার ব‌্যবসায়ী হর্ষদ মেহেতার সু‌টকেস বিখ‌্যাত হয়েছিল। দু’টি সু‌টকেসে করে এক কোটি টাকা তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের বাসভবনে পৌঁছে দেন বলে অভিযোগ করেছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির করেছিলেন সেই দুই সুটকেসও। যদিও প্রধানমন্ত্রীকে সুটকেসে ঘুষ দেওয়ার কাহিনি আদালতে প্রামাণিত হয়নি। হর্ষদকে তিনি কখনও দেখেননি বলেই রাওয়ের দাবি ছিল। ‘নির্বাচনী বন্ড’ আনার যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছিল, এরপর আর ‌ব‌্যবসায়ীদের রাজনৈতিক দলকে মোটা টাকা দিতে সু‌টকেসের প্রয়োজন হবে না। স্টেট ব‌্যাঙ্কে গিয়ে সাদা টাকায় বন্ড কিনে তা গোপনেই রাজনৈতিক দলকে দিতে পারবেন ব‌্যবসায়ীরা।

Advertisement

[আরও পড়ুন: মমতার পথেই মোদি! কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি নিয়ে মানুষের ঘরে পৌঁছনোর বার্তা মন্ত্রীদের]

অভিযোগ উঠেছে, গত সাত বছরে এই নির্বাচনী বন্ডের দৌলতে দেশে ‘স‌্যাঙাত তন্ত্র’ তথা শাসক দলের বন্ধু শিল্পগোষ্ঠীকে বরাত পাইয়ে দেওয়া আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরনোর পর জানা গিয়েছে, গত ছ’টি অর্থবছরে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনী বন্ডের মাধ‌্যমে ব‌্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি পেয়েছে। এই ১২ হাজার কোটির মধে‌্য প্রায় ৫৫ শতাংশ, অর্থাৎ সাড়ে ছ’-হাজার কোটি একাই পেয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি।

আদানি গোষ্ঠীকে ঘিরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে স‌্যাঙাত তন্ত্রের অভিযোগ সবচেয়ে জোরালো। সম্প্রতি আমেরিকার ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ সংস্থা’-র রিপোর্ট প্রকাশে‌্য অাসার পর ওই অভিযোগ অারও ইন্ধন পেয়েছে। ২০১৪ সালে মোদি যখন নির্বাচনী প্রচার করছিলেন, তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, তিনি আদানি শিল্পগোষ্ঠীর উড়ানে চেপে কেন নির্বাচনী প্রচার করছেন? মোদির আমলে বন্দর থেকে বিমানবন্দর, খনি, বিদু‌্যৎ কেন্দ্র, সড়ক ইত‌্যাদি অজস্র রাষ্ট্রীয় সম্পদ আদানি গোষ্ঠীর হাতে উঠেছে। পরিকাঠামো নির্মাণের অজুহাতে আদানিদের হাতে দেশটাই মোদি বেচে দিচ্ছেন বলে বিরোধীরা টানা একদশক ধরে অভিযোগ করে অাসছে। হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি-র প্রশ্রয়ে আদানিরা শেয়ার বাজারেও ব‌্যাপক কারচুপি করে নিজেদের কোম্পানির শেয়ার দর বিপুল বাড়িয়ে নিয়েছে।

[আরও পড়ুন: মমতার পথেই মোদি! কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি নিয়ে মানুষের ঘরে পৌঁছনোর বার্তা মন্ত্রীদের]

এই ‘ক্রোনি ক‌্যাপিটালিজম’ তথা স‌্যাঙাত তন্ত্রের নিরিখেই দেখতে হবে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশকে। জনগণের তথ‌্য জানার অধিকারকে লঙ্ঘন করা ছাড়াও নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের অন‌্যতম যুক্তি ছিল ‘কু‌ইড প্রো কো’। সাদা কথায় যার অর্থ: টাকার বিনিময়ে সরকারের নীতি তৈরি।

সুপ্রিম কোর্টের বক্তব‌্য, নির্বাচনী বন্ড এই ‘কুইড প্রো কো’-র সুযোগ করে দিচ্ছে। গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলো শাসক দলের তহবিলে টাকা ঢেলে নিজেদের স্বার্থে‌ সরকারের নীতি তৈরি করে নিচ্ছে। ভারতে ‘স‌্যাঙাত তন্ত্র’ বা ‘কুইড প্রো কো’-র অভিযোগ কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে মোটেও নতুন নয়। সাতের দশকের গোড়ায় যখন ধীরুভাই আম্বানির হাত ধরে আম্বানি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল, তখনও ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ‘স‌্যাঙাত তন্ত্র’ গড়ার অভিযোগ উঠেছিল। ‘কুইড প্রো কো’-র মাধ‌্যমে আম্বানিরা ওই সময় পলিয়েস্টার আমদানির ছাড়পত্র পেয়েছিল বলে ইন্দিরার রাজনৈতিক বিরোধীদের অভিযোগ ছিল। বিজেপি গত ছ’-বছরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ‌্যমে যে সাড়ে ছ’-হাজার কোটি টাকা পেয়েছে, তার সিংহভাগ যদি দেখা যায় কোনও একটি গোষ্ঠীর কাছ থেকে এসেছে, তাহলে ফের ‘কুইড প্রো কো’ প্রমাণিত হবে।

এই ‘কুইড প্রো কো’ সংবিধানের সমান অধিকারের ধারণার বিরুদ্ধে বলে অভিমত শীর্ষ অাদালতের। নির্বাচনী বন্ড সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারার তথ‌্য জানার অধিকারকে লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ করে প্রথম মামলা হয়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের অাগে এই মামলা হয়েছিল। কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের পাল্টা দাবি ছিল, রাজনীতির পরিসরে কালো টাকার রমরমা বন্ধ করতেই তারা ১৯(২) ধারার বলে নির্বাচনী বন্ডের গোপনীয়তা রাখতে চায়। ১৯(২) ধারায় বলা অাছে জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে সরকার ক্ষেত্রবিশেষে নাগরিকের তথ‌্য জানার অধিকার খর্ব করতে পারে। সরকারের দাবি ছিল, একমাত্র বেনামী বন্ডের মাধ‌্যমে রাজনৈতিক দলকে টাকা দেওয়ার সুযোগ থাকলেই অার কেউ সু‌্যটকেস ভর্তি নগদ অানবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সরকারের এই যুক্তি মানতে চায়নি।

৬ মার্চের মধে‌্য স্টেট ব‌্যাঙ্ককে বলা হয়েছে নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত সমস্ত তথ‌্য নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। কিন্তু স্টেট ব‌্যাঙ্কের কাছে আদৌ এ-সংক্রান্ত তথ‌্য কতটা আছে, তা নিয়ে ধেঁায়াশা রয়েছে। কারণ, এই বন্ড চালুর সময় বলা হয়েছিল স্টেট ব‌্যাঙ্ক বন্ডের উপর লিখবে না যে, এই বন্ড কে কিনল কিংবা কে ভাঙাল। ফলে বন্ড কে কিনল, সেই তথ‌্য স্টেট ব‌্যাঙ্কের কাছে মিললেও, কার বন্ড কে ভাঙাল, সেই তথ‌্য না-ও মিলতে পারে। স্টেট ব‌্যাঙ্ক ছাড়া এই তথ‌্য আর কারও পাওয়ার অধিকার নেই। কারণ, নির্বাচনী বন্ডের গোপনীয়তাকে দৃঢ় করার জন‌্য কেন্দ্র একইসঙ্গে কোম্পানি আইন, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং আয়কর আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করেছিল। এই সংশোধনের ফলে কোম্পানির দায় নেই বন্ড কাকে দেওয়া হল তার তথ‌্য রাখার। আবার রাজনৈতিক দলগুলিরও দায় নেই নির্বাচন কমিশনকে বা আয়কর দফতরকে এটা জানানোর যে, কোন সংস্থার থেকে তারা কত টাকা পেল।

স্টেট ব‌্যাঙ্ক যদি ৬ মার্চের মধে‌্য নির্বাচন কমিশনকে কার বন্ড কে ভাঙাল, এই তথ‌্য না-দিতে পারে, তাহলে ১৩ মার্চ সাধারণ মানুষের জানা সম্ভব নয়, বিজেপি বা অন‌্য রাজনৈতিক দলগুলি কোন কোম্পানির থেকে কত টাকা পেল? দ্বিতীয়ত, এই বন্ড চালু করার সময় মোদি সরকার কোম্পানি আইনে যে সংশোধন করেছিল, তাতে ক্ষতির মুখে দঁাড়ানো সংস্থাগুলিও রাজনৈতিক দলকে যত খুশি চঁাদা বা অনুদান দিতে পারে। এখন যদি দেশের বড় বড় বাণিজ‌্য সংস্থা ভুয়া সংস্থা তথা শেল কোম্পানির মাধ‌্যমে বন্ড কিনে তা রাজনৈতিক দলগুলিকে দিয়ে থাকে, তাহলেও প্রকৃত তথ‌্য মিলবে না। ভুয়া সংস্থার মাধ‌্যমে দেশের শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। ভুয়া সংস্থায় লগ্নির নামে ব‌্যবসায়ীদের টাকা বিদেশেও পাচার হয়। এক্ষেত্রে যে ভুয়া সংস্থা বা শেল কোম্পানির মাধ‌্যমে নির্বাচনী বন্ডের লেনদেন হয়নি, তা এখনই বলা যাবে না।

ফলে যারা মনে করছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আগামী ১৩ মার্চ ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যাবে, তারা হতাশও হতে পারে। কেন্দ্র যদি ‘সু‌টকেস সংস্কৃতি’ ফিরবে এই অাশঙ্কা দেখিয়ে অর্ডিন‌্যান্স করে বন্ডের তথ‌্য প্রকাশ অাটকে দেয়, তাহলেও হতাশ হতে হবে। কালো টাকা ও রাজনীতির অঁাতঁাত যেমন সহজে দূর হবে না, তেমন সুপ্রিম কোর্টের এই একটি নির্দেশেই স‌্যাঙাত তন্ত্র দ্রুত বিলোপ হবে এমন আশা করা অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ